পাসপোর্ট-ভিসাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেই সুদূর পশ্চিম সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়ার সীমান্ত-ঘেঁষা রাশিয়ার বৈকাল হ্রদ, কিরঘিজস্তান, তুর্কমেনেস্তান প্রভৃতি অঞ্চল থেকে নয় নয় করে ৬৫-৭০ হাজার কিলোমিটার আকাশপথ পাড়ি দিয়ে শীতের মরশুমে সে উড়ে আসে আমাদের এই বঙ্গদেশের এক হ্রদে। সে রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড। আমাদের আদরের নাম চোবরা হাঁস।
ওই হ্রদেই চোখে পড়তে পারে পার্পল মুরহেন, বাংলায় এসে উনি কামপাখি নাম ধারণ করেন। এই পাখিটি আসে ফ্রান্স, পর্তুগাল থেকে। ইউরোপের নানা অঞ্চল থেকে আগমন ঘটে লিটল গ্রিব বা ডুবুরি পাখির। ইউরোপ এবং উত্তর এশিয়া থেকে আসে কমন কুট, বাংলা নামে জলকুক্কুট।
ওরা রাষ্ট্র জানে না, দেশের নাম জানে না, মানুষ নামক জীবটির দাগিয়ে দেওয়া সীমানা মানে না। ওরা পরিবেশ বোঝে, আবহাওয়া বোঝে, বেঁচে থাকার লড়াইটা জানে। আকাশে দুটি পাখা মেলে উড়ে চলার সেই রোমাঞ্চ ওরা ছাড়া আর কে-ই বা জানবে।
ইউরোপ, চিন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, এমনকী অস্ট্রেলিয়া ও ফিজি থেকে আগত পক্ষীকূলের সমাবেশ ঘটে, এখানে, ওই হ্রদে, হ্রদ-সংলগ্ন এলাকায়, এই শীতে। পরিযায়ী পাখিদের সঙ্গে মিলমিশে উৎসবে মাতে এখানকার কাস্তেচরা, মাছরাঙা, পানকৌড়ি। সে এক মহান মিলনক্ষেত্র।
পুবে নবদ্বীপ, পশ্চিমে কাটোয়া, আর এই এই দুই পুরনো শহরের মাঝে বর্ধমান ও নদীয়ার প্রায় সীমান্তে পূর্ব বর্ধমানের অন্তর্গত শান্ত পূর্বস্থলী (চুপির চর নামেও পরিচিত) অঞ্চলটি শীতে সরগরম হয়ে ওঠে চেনা-আচেনা অসংখ্য পাখির কলকাকালিতে। ওই পূর্বস্থলীতেই অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদটির অবস্থান। আয়তনে প্রায় সাড়ে ৩ বর্গ কিলোমিটার। একটি খালের মাধ্যমে হ্রদটির সঙ্গে সংযোগ রয়েছে ভাগীরথী তথা গঙ্গার। পূর্বস্থলীর পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে ভাগীরথী। হ্রদ-সংলগ্ন চুপি, কাষ্ঠশালী গ্রামের বাসিন্দারা সারা বছর আপেক্ষা করে থাকেন ওই জলাশয় ও তাকে ঘিরে দেশি-বিদেশী পক্ষী-সম্মেলনের জন্য। অন্তত ৭০ প্রজাতির দেশি-বিদেশী পাখির দেখা মেলে এখানে।
গঙ্গা অববাহিকার উর্বর পলি আর পর্যাপ্ত জলের যোগানের ফলে বর্ধমানের পূর্বস্থলী বড় সবুজ। ধান, পাট, সরষে, আলু-সহ বিবিধ সবজি এবং ফলে-ফুলে পূর্বস্থলী যেন উপচে পড়া লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। জলে মাছ, ডাঙায় নানা গোত্রের পোকামাকড়, ফল, পাখপাখালির খাদ্যের আভাব নেই চুপির চরে।
দেখা মিলতে পারে যে-সব পাখির
সাধারণত নভেম্বর মাস থেকে চুপির চরে পাখি আসতে শুরু করে। মাঝ-নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক পাখি দেখার সুযোগ থাকে। তারপর পরিযায়ী পাখিরা ফিরতে শুরু করে। আবার তো তাদের পাড়ি দিতে হবে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ। ওই মাঝ-নভেম্বর থেকে মাঝ-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যে-সব পাখি দেখার সুযোগ থাকে চুপির চরে তাদের একটা তালিকা তৈরি করতে হলে তা হবে এরকমটিঃ কমন কুট, কমন মুরহেন, রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড, ব্ল্যাক হেডেড আইবিস, লেসার হুইসলিং ডাক, ফুলভাস হুইসলিং ডাক, বাম সোয়ালো, ইন্টারমিডিয়েট ইগ্রেট, গ্রেট ইগ্রেট, স্পটেড রেড শ্যাঙ্ক, গ্রিন শ্যাঙ্ক, গ্রে হেরন, ওপেন-বিলড স্টর্ক, ফেজেন্ট টেলড জ্যাকানা, ইউরেশিয়ান মার্শ হ্যারিয়ার, মার্শ স্যান্ডপাইপার, ব্রোঞ্জ-উয়িংড জ্যাকানা, পায়েড কিংফিশার, কটন পিগমি গুজ, লিটল কমরান্ট ইত্যাদি। আভিজ্ঞ পাখি-পর্যবেক্ষকদের চোখে, ক্যামেরায় আরও পাখি, অন্য প্রজাতির পাখি ধরা পড়তেই পারে।
অত্যন্ত আশাপ্রদ কথাটি হল, চুপির চর এলাকায় কোনও কোনও পরিযায়ী পাখির থেকে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। চুপির চরের পরিবেশ রক্ষার তাগিদ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছেন নবীবক্স শেখ। তাঁর কথায়, চুপির চরে পরিযায়ী পাখিদের স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক মানুষজনের সচেতনতা ও পাখির প্রতি আন্তরিক ভালোবাসাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। এই পক্ষীকুল যে পূর্বস্থলীর জীবন্ত সম্পদ, গর্বও বটে।
বেড়ানোর কথা
কাছ থেকে পাখি দেখা ও ফটো তোলার জন্য দাঁড-টানা নৌকায় চড়ে হ্রদের বুকে ভেসে পড়ুন। জলাশয়ের কোন কোন এলাকায় কোন কোন পাখি দেখার সম্ভাবনা বেশি তা মাঝিরাই ভালো জানেন। একটি নৌকায় দু’জন করে চড়তে পারবেন। ঘন্টাপিছু ভাড়া ১৫০ টাকা। হ্রদের পার থেকেও পক্ষী দর্শন হতে পারে। তবে নৌকায় চড়ে হ্রদের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কাছ থেকে পাখি দেখা, ছবি তোলার রোমাঞ্চ ও মজাটাই অন্যরকম।
গ্রামের পথে সরষে, ধান, সবজি খেত, ফুল-বাগিচার ধার ধরে হাঁটুন। ফুসফুসের দূষণমুক্তি ঘটবে। চাইলে ছিপ নিয়ে বসে যেতে পারেন হ্রদের ধারে।
শুধু শীতেই তো নয়, পূর্বস্থলী যাওয়া যায় বছরভরই। হ্যাঁ শীতের মরশুমে পূর্বস্থলীর বিশেষ আকর্ষণ ওই পরিযায়ী পক্ষীকুল। অন্য মরশুমেও পূর্বস্থলী যথেষ্ট আকর্ষণীয়। শান্ত পূর্বস্থলীর সবুজ খেতে ভাগীরথী থেকে আসা নির্দোষ বাতাস ঢেউ খেলে যায় গ্রীষ্মে। পাখি তখনো থাকে। দেশীয় পাখির দেখা মিলবে জলে, গাছে, খেতে। পাখি বোঝে কোনটা তাদের আপনভূমি। বর্ষায় বিশাল হ্রদ জুড়ে বৃষ্টিপাতের দৃশ্য অনির্বচনীয় দৃশ্যপট রচনা করে।
আরেকটা তথ্য, পূর্বস্থলীর আম নিয়ে। পূর্বস্থলীতে বিঘের পর বিঘে জমি জুড়ে আমের বাগানগুলিতে ফলে স্বাদে-গন্ধে অতি উন্নত গুণমানের আম্রপালী, রানি, হিমসাগর, ল্যাংড়া। পূর্বস্থলী সাংস্কৃতিক মঞ্চ বছর আড়াইয়েক আগে আঞ্চলিক আম-উৎসবের সূচনা করে। পরে নিউটাউনে আয়োজিত রাজ্য আম উৎসবে বর্ধমান জেলার স্টলে প্রদর্শিত পূর্বস্থলীর আম রসিকজনের মন কেড়ে নিয়েছে। ওই পাকা আমের টানেও গ্রীষ্ম-বর্ষায় কত পাখি ডেরা বাঁধে পূর্বস্থলীতে।
কাছেপিঠে
পূর্বস্থলীতে থেকেই বেড়িয়ে নেওয়া যায় কয়েকটি দর্শনীয় জায়গা। যেমন, শ্রীবাটি। বর্ধমান জেলার কাটোয়া-২ ব্লকের অন্তর্গত শ্রীবাটিতে ১৮০২ থেকে ১৮৩৬ সালের মধ্যে টেরাকোটা শৈলীতে তৈরি মন্দিরগুলিতে নানা দেবদেবী, যুদ্ধের দৃশ্য, তৎকালীন প্রাত্যহিক জীবনের নানা ছবির মোটিফ-সহ আসাধারণ সব প্যানেল দেখে বিস্মিত হতে হয়। কাল গ্রাস করেছে বেশিরভাগ মন্দিরকেই। যে ক’টি মন্দির এখনো টিকে আছে, সেগুলির দেওয়ালের সূক্ষ্ম কাজ অতীতের শ্রীবাটির অনন্য টেরাকোটা শিল্পের সাক্ষ্য বহন করছে। পূর্বস্থলী থেকে শ্রীবাটি ২৫ কিলোমিটার।
পূর্বস্থলী থেকে মায়াপুরের ইস্কন মন্দির ও নবদ্বীপ ১৫ কিলোমিটার। পূর্বস্থলীর কাছেই বাংলার ঐতিহ্যশালী কাঠের পুতুল তৈরির জন্য বিখ্যাত নতুনগ্রাম থেকেও বেড়িয়ে আসা যায়। নতুনগ্রামে কাঠিয়াবাবার আশ্রম এবং কাছাকাছি কপিল মুণির আশ্রম দর্শন করে আসতে পারেন।
যাওয়ার পথ
ট্রেনপথে যেতে চাইলে কাটোয়াগামী ট্রেনে উঠে নামতে হবে পূর্বস্থলী স্টেশনে। হাওড়া থেকে সময় লাগে আড়াই ঘন্টা। স্টেশন থেকে চুপির চরে যাওয়ার টোটো পাওয়া যাবে। ভাড়া ২০-৩০ টাকা।
সড়কপথে কলকাতা থেকে পূর্বস্থলী ১২০-১৩০ কিলোমিটার। নিজেদের গাড়িতে গেলে ব্যারাকপুর এবং কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ঈশ্বর গুপ্ত সেতু পেরিয়ে চলে আসুন ত্রিবেণী। তারপর সপ্তগ্রাম-ত্রিবেণী-কালনা-কাটোয়া (এস টি কে কে) রোড ধরে কালনা, ধাত্রীগ্রাম, সমুদ্রগড় হয়ে চলে আসুন পূর্বস্থলী। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সরণী ধরে এই যাত্রাও কম আকর্ষণীয় নয়। যাওয়া বা আসার পথে বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দিরটি দেখে নিতে পারেন।
থাকার ব্যবস্থা
চুপির হ্রদের পারেই সুসজ্জিত উদ্যানের মধ্যে রয়েছে চুপি কাষ্ঠশালী পাখিরালয়ের সমস্ত সুবিধাযুক্ত চারটি গার্ডেন কটেজ ও দুটি ম্যাঙ্গো অর্চার্ড কটেজ। রয়েছে চিলড্রেন্স পার্ক, ওয়াচটাওয়ার। সবক’টি কটেজেরই অবস্থান লেকের ধারে। ২ জন একটি ঘরে থাকলে সারাদিনের খাওয়াদাওয়া-সহ দিনপ্রতি মাথাপিছু খরচ ১৪৪০ টাকা। একটি ঘরে ৩ জন থাকলে খাওয়াদাওয়া-সহ দিনপ্রতি মাথাপিছু খরচ ১২৪৫ টাকা। গ্রীষ্মে এসি নন-এসি, দুই রকমের কটেজ-ই পাওয়া যাবে। এসি ঘরের ভাড়া সামান্য বেশি। ৩ থেকে ১০ বছর বয়সের বাচ্চাদের জন্য খরচে অনেকটাই ছাড় আছে। ৩ বছরের নীচের শিশুদের জন্য কোনও খরচ লাগে না। যোগাযোগের নম্বরঃ ৯০৭৩৫-৬৫৭২৩।