উত্তর সিকিমের একটা অঞ্চল। তার একদিকে প্রবাহিত তিস্তা। আরেক প্রান্তে থালুং চু বা থালুং নদী। পশ্চিমে পাহাড়ের ঢেউ। অঞ্চলটা সিকিমের আদি বাসিন্দা লেপচাদের জন্য সংরক্ষিত। অনুমতিপত্র ছাড়া লেপচা সম্প্রদায়ের বাইরের কোনও মানুষ এই অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারেন না।
গ্যাংটক থেকে জংগুর দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। পথে পড়বে সেভেন সিস্টারস ফলস। জংগুতে থাকার ব্যবস্থা হোমস্টে-তে। হোমস্টে থেকেই জংগুতে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্রের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়ে থাকে।
ঢুকে পড়া যাক জংগুতে। পাহাড়, নদী, ঝর্না, উষ্ণ পস্রবণ, বাতাসে দোল খাওয়া সরু সরু কাঠের পুল, লেপচাদের কাছে পবিত্র এক লেক, ছোট একটি মনাস্ট্রি, পাহাড়ের ঢালে ঢালে সবুজ খেত, ফুল, পাখি, এ-সব নিয়ে জংগুর প্রাণদায়ী প্রকৃতি। দূরে থাকবে উন্নতশির কাঞ্চনজঙ্ঘা।
জংগুতে থাকার সময়ে অবশ্যই গ্রামের পথে পথে হেঁটে বেড়াবেন। কাছ থেকে দেখতে পাবেন লেপচা সম্প্রদায়ের মানুষজনের জীবনযাপন, পরিচিত হবেন তাঁদের সংস্কৃতির সঙ্গে। হাইকিংয়ের সুযোগ আছে। হাঁটতে হাঁটতে চলে যান রংয়ুং নদীর ধারে। চাইলে মাছ ধরতে পারেন। দেখবেন লিংজা জলপ্রপাত, থলুং মনাস্ট্রি, খুশেং উপত্যকা ও লেক।
খাওয়ার পাতে থাকবে জঙ্গুরই খেতে ফলানো সবজি। চাইলে চেখে দেখতে পারেন লেপচাদের প্রিয় খাবার। যেমন, সিমব্লে, চুরপি, মাসিয়ুম কো ডাল, লপসি (একপ্রকার আচার), থুকপা ইত্যাদি। ডিম, চিকেনের পদ তো থাকবেই। আপত্তি না থাকলে পর্কের পদও পাওয়া যাবে।
যাওয়ার পথ
এন জে পি অথবা শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি জংগু চলে আসা যায়। সিংতাম রোড ধরে আসতে হবে। সময় লাগবে পাঁচ ঘন্টা। গ্যাংটক থেকে জংগুর দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। গ্যাংটকের বজ্র ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে গাড়ি ভাড়া করে জংগু চলে আসতে পারেন। শেয়ার গাড়িতে মঙ্গন পর্যন্ত এসে সেখান থেকে আরেকটা গাড়িতে জংগু পৌঁছাতে পারেন। মঙ্গন থেকেও শেয়ার গাড়ি পাবেন। মঙ্গন থেকে জংগু ১১ কিলোমিটার। মঙ্গন উত্তর সিকিমের পাহাড়ের কোলের একটি একটি শহর।
থাকার ব্যবস্থা
রয়্যাল জংগু হোমস্টেঃ ফোন ৮০০১৭৫৫৩৯৩। মায়াল লায়াং হোমস্টেঃ ফোন ৯৪৩৪৪৪৬০৮৮। লিংতেম লায়াং হোমস্টেঃ ফোন ৯৫৯৩৭৮১৯২৬। জংগু লি হোমস্টেঃ ফোন ৯৬০৯৮৬৪২৫৫। জংগু দুপদেন লেপচা হোমস্টেঃ ফোন ৯৫৯৩৭৮৩০৪৩। আচুলায় হোমস্টেঃ ফোন ৯৬৭৯২৫১২৩১।
জংগুর গ্রামে গ্রামে
লিংথেম ট্রেকঃ পাসিংডাং জংগুর একটি গ্রাম। মঙ্গন থেকে কাছাকাছি। পাসিংডাং থেকে ট্রেক করে লিংথেম গ্রামে যাওয়া যায়। তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা সময় লাগে। লিংথেম থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার রুপ দেখতে হয় রুদ্ধশ্বাসে। আর দেখবেন বিস্তৃত জংগু উপত্যকা। লেপচারা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে তাঁদের জীবনীশক্তির মূল উৎস বলে মনে করে থাকে। অ্যালপাইন অরণ্যের মধ্যে লিংথেম গ্রামের অবস্থান। একটি মনাস্ট্রি আছে গ্রামে। নাইংমা বৌদ্ধ ধর্মমত অনুসৃত হয় এখানে। বৌদ্ধধর্মের চারটি দর্শনের মধ্যে নাইংমা ধর্মপথ একটি। ডিসেম্বরে এই মনাস্ট্রিতে মুখোশ নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
হি গায়াথাংঃ গ্রামটির অবস্থান লোয়ার জংগুতে। পাসিংডাং থেকে গাড়িতে সহজেই পৌঁছানো যায়। একটি ছোট লেক আছে গ্রামে। লেপচারা বিশ্বাস করে, কোনও দেবীর মাথার উকুন থেকে লেকে ছোট ছোট মাছের উৎপত্তি হয়েছে এই লেকে।। লেপচাদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এই লেক। লেপচারা বিশ্বাস করে, অতিপ্রাকৃতিক কোনও অস্তিত্ব এই দেবীর প্রেমে পড়েন। তাঁদের সন্তানসন্ততি ও পরবর্তী বংশধরেরা হিমো নামে পরিচিত হয়। হি গায়াথাং গ্রামে এই হিমো গোষ্ঠীর সদস্যরাই বসবাস করেন। হি গায়াথাং গ্রামে বসবাসকারী হিমো গোষ্টির লোকেরা বিশ্বাস করেন, লেকের মাছেদের ক্ষতি হলে তাঁদেরও ক্ষতি হবে।
পেনটংঃ জংগুর একদম শেষপ্রান্তে পেনটং গ্রামের অবস্থান। তুষারশুভ্র পর্বতগুলি এখান থেকে অনেক কাছাকাছি। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেক করে যেতে হয় পেনটঙে। দুটি অনুচ্চ পাহাড় দারুণ ভিউপয়েন্ট। এই দুই পাহাড়কে কাঞ্চনজঙ্ঘার দুই রক্ষী বলে মনে করেন লেপচারা। একটি পাহাড়ের নাম টারবি, অন্যটি টার্বট। টারবিকে দেবতা আর টার্বটকে অপদেবতা বলে মনে করা হয়। উপত্যকার উল্টোদিকে সাকিয়ং গ্রাম।
থলুংঃ জংগু থেকে ট্রেক করে যাওয়া যায় থলুং মনাস্ট্রি। গোর্খা আক্রমণের সময় বৌদ্ধ পুঁথি, পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি রক্ষা করার জন্য থলুং মনাস্ট্রি তৈরি করা হয়েছিল। প্রতি তিন বছর অন্তর বসন্তে এইসব মূল্যবান সম্পদ দেখার জন্য ভক্তদের অনুমতি দেওয়া হয়। মনাস্ট্রি চত্বর থেকে একটি জলপ্রপাত চোখে পড়বে। গভীর গর্জের মধ্যে দিয়ে জলপ্রপাতের স্রোত প্রবাহিত হয়।
জংগু ভ্রমণার্থীদের কাছে পুরোপুরি আবিস্কৃত হয়ে গেছে এমন দাবি করা যাবে না। পরিচয়ের অপেক্ষায় রয়েছে জংগুর পাহাড়ি প্রকৃতি, সংস্কৃতি।