দূরভাষ-মাধ্যমে কথাবার্তার মাঝেই প্রশ্নটা উঠল-
– “খাওয়াদাওয়ার খরচ কেমন ?”
ফোনের অন্য প্রান্তে নৈঃশব্দ ।
– “প্রণবেশবাবু শুনতে পাচ্ছেন ?”
অতঃপর উত্তর পাওয়া গেল, চটজলদি উত্তর নয়, ফোনের অপর প্রান্ত থেকে সংশয়জড়িত যে কথাগুলো ভেসে এল তা এরকম, “কী বলি বলুন তো, মানে, আমাদের এখানে শুধু বেড়ানোর জন্য লোকজন তো তেমন আসেন না, সুন্দরবনের ভ্রমণাঞ্চলের তালিকার মধ্যেও পড়ে না কুমিরমারী, অন্তত এখনো। অ্যাসোসিয়েশনের কাজের সঙ্গে যুক্ত যাঁরা, তারাই সাধারণত আসেন, থাকেন, সাধারণ খাবারদাবারই খাওয়া হয়।”
খোলাসা করে বলা যাক। জায়গাটা সুন্দরবনের কুমিরমারী। রায়মঙ্গল, কোরানখালি, সারতা নদীতে ঘেরা কুমিরমারী সুন্দরবনের অনেক দ্বীপের মধ্যে একটি। গোসাবা ব্লকের অন্তর্গত কুমিরমারীর উত্তরে সন্দেশখালি, পশ্চিমে ক্যানিং। বিশাল চওড়া রায়মঙ্গল নদীর ওপারে যোগেশগঞ্জ, হেমনগর। কাছাকাছি গ্রাম ছোট মোল্লাখালি, সাতজেলিয়া, কচুখালি, লাহিড়িপুর, বিপ্রদাসপুর। দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে বাগনা ফরেস্ট রেঞ্জ আফিস।
২০১৯ থেকে ২০২১, এই তিন বছরের মধ্যে পরপর ফণী, বুলবুল, আম্পান, ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করেছে ভারত-বাংলাদেশ জুড়ে গোটা সুন্দরবনকেই। কিন্তু ধ্বংস আর সৃষ্টি হাত ধরাধরি করে চলে যে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্যে। প্রয়োজনে নদী তার গতিপথ বদলায়। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের বীজের দল নদীর ধারায় বহু মাইল ভেসে গিয়ে নতুন বনের পত্তন করে। ভয়ানক সব ঝড়-ঝঞ্ঝার বিপরীতে ঢালের মতো দাঁড়িয়ে ওই সুন্দরবন রক্ষা করে চলেছে শুধু কলকাতা নয়, গোটা পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশের এক বিরাট অংশকে।
জীবন এখানে কঠিন। লড়াই করে প্রকৃতি, গাছপালা, পশুপাখি। লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় সুন্দরবনের মানুষকে। সেই লড়াইয়ে শামিল রয়েছে ‘সুন্দরবনস গ্রিন এনভায়রনমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’-ও। নেতৃত্বে রয়েছেন লেখার শুরুতে উল্লেখিত প্রণবেশবাবু। প্রণবেশ মাইতি।
ম্যানগ্রোভ অরণ্যের প্রসার ও বনরক্ষায় আঞ্চলিক মানুষকে সঙ্গী করে নেওয়া, নদীগুলোকে দূষণমুক্ত রাখা, পরিবেশ-আবহাওয়া-প্রকৃতি অনুসারে আঞ্চলিক মানুষজনের জীবীকা নির্বাহের দিক-নির্দেশ করা, কচিকাঁচাদের ওই শৈশব থেকেই সুন্দরবনের প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত করা, ওদের জন্য পাঠশালা চালানো, এমন হরেক কাজ করে থাকে সুন্দরবনস গ্রিন এনভায়রনমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। সংস্থার কর্মকাণ্ড চলে কুমিরমারী দ্বীপে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কুমিরমারী গ্রাম পঞ্চায়েতও।
কেন যাবেন কুমিরমারী
কুমিরমারী দ্বীপে যাওয়ার জন্য প্রথমে পৌঁছাতে হবে ধামাখালি। রায়মঙ্গল থেকে ধেয়ে আসা বাতাস সস্নেহে আপনাকে আলিঙ্গন করবে। ধামাখালিতে মাছের কাঁটা তথা আড়ত আছে একটি। হাতে সময় থাকলে উঁকি মারতে পারেন একবার। সুন্দরবনের নদীগুলির মাছের সেই বিপুল সম্ভার বাঙালিকে মাতিয়ে দেবে।
ওই ধামাখালি থেকেই আপনাকে চড়ে বসতে হবে মোটর বোট বা চলতি কথায় ভটভটিতে। পাশাপাশি, আগে-পিছে এসে বসবেন আরও যাত্রী। জায়গা করে নেবে কিছু মালপত্র। ওঁরা পর্যটক নন। সুন্দরবনের নানা এলাকার বাসিন্দা। অনেকেই নেমে যাবেন বিভিন্ন ঘাটে। উঠবেনও নতুন যাত্রী। আলাপ জমবে ধীরে ধীরে। কত তথ্য পাবেন তাঁদের কাছ থেকে। আপনার দূর-দ্বীপ-ভ্রমণ কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। চলেছেন বিশাল রায়মঙ্গল নদীতে ভেসে। পেরিয়ে চলেছেন দু’পারের কত গ্রাম, চাষের খেত, বনভূমি। আড়াই থেকে তিন ঘন্টার সেই জলযাত্রা একটা অভিজ্ঞতা তো বটেই।
জলযাত্রা শেষে আপনি পৌঁছাবেন নদীবেষ্টিত কুমিরমারী দ্বীপে। আপনি সামগ্রিক ভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ ও ম্যানগ্রোভ অরণ্যের অভ্যন্তরে অবস্থান করছেন এখন। বাঘের বসতি-অঞ্চল নয় কুমীরমারী। তবে বাঘের চমকপ্রদ নানা গল্পগাছা শুনতে পাবেন এখানে। কুমীরমারীর বাগনা ফরেস্ট রেঞ্জ আফিসের অদূরে শ্যামাপদ মণ্ডলের বাড়ি।। দেখা হয়ে গেলে তাঁর কাছ থেকে শুনতে পাবেন বড়মিঞার গরমাগরম কাহিনি। ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসের কর্মীদের সঙ্গে আলাপ জমাতে পারলে শুনবেন বাঘের কত কথা। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বাঘবন এই সুন্দরবন। বাঘ, বাদাবনের দেবী বনবিবি, বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়, কুমিরের দেবতা কালু রায়ের কথা, কথকতা, উপাখ্যান এখানে যে মুখে মুখে ফিরবে তাতে আর আশ্চর্য কী।
কুমিরমারীতে ১৮ থেকে ২০ হাজার মানুষের বসবাস। চাষ-আবাদ প্রধাণ জীবীকা। কিছু মানুষ নদীতে মাছ ধরেন। কিছু গ্রামবাসী মাছ ধরার ট্রলারের কর্মী হিসেবে সমুদ্রে যান। সুগন্ধী ধান ফলে এখানে। সবজি ফলে নানা প্রকার। গ্রামে বেড়ান। দেখুন বাদাবনের একটি দ্বীপভূমির মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার নানা ছবি। কথা বলুন গ্রামের মানুষের সঙ্গে। চাষবাস দেখুন। নদীর ধারে গিয়ে বসুন। নদী-পারের বাঁধের পথ ধরে হাঁটুন। বিশুদ্ধ বাতাসে আপনি পরিশুদ্ধ হবেন। শুদ্ধ অক্সিজেন আপনার ফুসফুসের স্বাস্থ্য ফেরাবে। এই দুঃসহ কোভিডকালে ওই বিশুদ্ধ বাতাস আর অক্সিজেনটা খুব জরুরি।
ঝটিকা সফরে বাঘের দেখা না পেয়ে চোখ ব্যথা ও মেজাজ খারাপ করা নয়। বরং সুন্দরবনস গ্রিন এনভায়রনমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের বাচ্চাদের সঙ্গে পাঠশালায় গিয়ে বসুন। মন ভালো হয়ে যাবে। সুন্দরবনের সন্তান, ওঁদের আঁকা ছবিতে ফুটে ওঠে সুন্দরবনের গাছ, পাখি, নদী, বুনো ফুল, নৌকা। আপনি ওই কচিকাঁচাদের মধ্যে বসে ওঁদের গল্প শোনাতে পারেন, স্বপ্ন দেখাতে পারেন, গান শোনাতে ও শেখাতে পারেন, ছবি আঁকা শেখাতে পারেন। প্রণবেশবাবু জানালেন, “আগ্রহী যে-কেউই বেড়াতে আসতে পারেন কুমিরমারীতে। নিষ্কলুষ প্রকৃতির প্রতি যাঁদের টান রয়েছে তাঁদের ভালোই লাগবে। সুন্দরবনের অন্দরের এক দ্বীপে মানুষের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখার, জানার সুযোগটাও রয়েছে। শিক্ষকতার পেশায় যাঁরা রয়েছেন তাঁরা যদি এখানে আসেন, তবে আমাদের এখানকার শিক্ষকদের সঙ্গে পরিবেশ, পরিস্থিতি অনুসারে বাচ্চাদের উপযোগী শিক্ষা প্রদানের বাস্তবোচিত পদ্ধতি-প্রকরণ নিয়ে মতের আদানপ্রদান হতে পারে।”
পাখি পর্যবেক্ষণে আগ্রহ আছে? তাহলে কুমিরমারীতে প্রাপ্তির তালিকা আরও দীর্ঘ হবে। কতরকমের মাছরাঙা, ম্যানগ্রোভ হুইসলার, ব্রাউন ফিশ আউল, গ্রেটার অ্যাডজুট্যান্ট, শঙ্খচিলের মতো বিহঙ্গকুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যেতেই পারে। চাইলে ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে নদীতে ভেসে পড়তে পারেন খানিকক্ষণের জন্য। পাখি দেখার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
আর খাওয়াদাওয়া? সুন্দরবনের সুদূর ওই দ্বীপে সাধারণই অসাধারণ। খেত থেকে সদ্য তুলে আনা শাক-সবজি, নদী-পুকুর থেকে ধরা তাজা মাছ, দেশি মুরগি বা হাঁসের ডিম, মুরগির মাংস। সঙ্গে সুগন্ধী চালের ভাত।
“খাওয়াদাওয়ার খরচ কেমন?” এই প্রশ্ন দিয়েই তো শুরু হয়েছিল লেখাটি। প্রণবেশবাবু জিভের ডগায় থাকা ‘রেট’ বলতে পারেননি। অবশেষে, আলোচনায় এটাই সাব্যস্ত হল যে, খাদ্য আনুসারে নায্য মূল্য ধার্য হবে। হ্যাঁ, আরেকটা কথা, কুমিরমারীতে পাবেন যথার্থই সুন্দরবনের মধু। বাক্সে পালন করা মৌমাছি কর্তৃক উৎপাদিত মধু নয়। জঙ্গলের নিভৃত সব এলাকা থেকে সেই মধু সংগ্রহ করে আনেন মৌলেরা। স্বাদে-গন্ধে প্রচলিত মধু থেকে ভিন্নতর, শরীরের পক্ষে নানাভাবে উপকারীও বটে।
থাকার ব্যবস্থা
হোটেল, রিসর্ট নেই এখানে। থাকার জন্য আছে সুন্দরবনস গ্রিন এনভায়রনমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সবুজে ঘেরা দুটি ঘর। পরিচ্ছন্ন সাধারণ আবাস। প্রতিটি ঘরে একটি বাচ্চা-সহ দু’জন করে পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি থাকতে পারেন। দুটি ঘরে ৫-৬ জন থাকতে পারবেন। সামনে বারান্দা, তারপর উঠোন। ঘরের ভাড়া দিনপ্রতি ৫০০ টাকা।
প্রণবেশবাবু জানাচ্ছেন,”কলকাতা ও সংলগ্ন নানা অঞ্চল থেকে লোকজন আসেন এখানে, মহিলারাও আসেন। অ্যাসোসিয়েশনের নানা কাজে আসেন তাঁরা। অনেক সময় সঙ্গে আসেন বন্ধু-আত্মীয়। নিরাপত্তা নিয়ে বিন্দুমাত্র দুঃশ্চিন্তার কারণ নেই। গ্রিন এনভায়রনমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের অতিথিরা আঞ্চলিক মানুষজনের ভালোবাসা ও সম্মান পেয়ে থাকেন।”
যাওয়ার পথ
কুমিরমারী যাওয়ার জন্য প্রথমে পৌঁছাতে হবে ধামাখালি। সায়েন্স সিটি থেকে ঘটকপুকুর, সরবেড়িয়া হয়ে ধামাখালি। দূরত্ব কমবেশি ৭০ কিলোমিটার। সায়েন্স সিটির পুর্ব প্রান্তে রুবির দিকে যাওয়ার সেতুটি যেখানে (ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসে) শুরু হচ্ছে সেখানে (ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসে) দাঁড়ালে ধামাখালিগামী বাস পাবেন। বারাসাত থেকে ডিএন-১৬/১ বাসটি সায়েন্স সিটি হয়ে ধামাখালি যায়। সায়েন্স সিটি থেকে ঘটকপুকুরের দিকে শেয়ার গাড়ি যায়। চাইলে সেই শেয়ার গাড়িতে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বাস ধরতে পারেন। সরাসরি বাসে সায়েন্স সিটি থেকে ধামাখালি যেতে সময় লাগবে আড়াই থেকে পৌনে ৩ ঘন্টা।
আবার সকাল সকাল শিয়ালাদা স্টেশনের দক্ষিণ শাখা থেকে ক্যানিং লোকাল ধরতে পারেন। আড়াই ঘন্টা সময় লাগবে ক্যানিং পৌঁছাতে। ক্যানিং থেকে ধামাখালি ২৭ কিলোমিটার। ক্যানিং থেকে ধামাখালি যাওয়ার জন্য বাস, অটো দুই-ই পাবেন। এ পথে দেখা হয়ে যাবে মাতলা নদীর সঙ্গে।
ধামাখালিতে চা-টা খেয়ে, কুমিরমারীগামী ভটভটিতে উঠে বসুন। হাতে যথেষ্ট সময় না থাকলে ধামাখালির মাছের আড়ত দেখার পরিকল্পনা থাকলে তা ত্যাগ করুন। ধামাখালি থেকে জলযানে কুমিরমারী আড়াই থেকে তিন ঘন্টার পথ। কুমিরমারীর নদীঘাট থেকে ভ্যানরিক্সায় সুন্দরবনস গ্রিন এনভায়রনমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের অতিথিনিবাসে পৌঁছাতে মিনিট ১৫ সময় লাগবে।
সুন্দরবনস গ্রিন এনভায়রনমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরঃ ৯৮৩১৬-৪৭২৯৯।