পশ্চিম সিকিমের ইয়কসাম থেকে জোংরি ছাড়িয়ে কোকচুং, থাংসিং, লামিনি, সমিতি লেক ও জেমাথাং হয়ে ট্রেক-পথ চলে গেছে গোয়েচা লা বা গোয়েচা গিরিবর্ত্ম পর্যন্ত। দেশ-বিদেশের ট্রেকারদের কাছে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে দিয়ে পথ করে নেওয়া এই ট্রেকপথ অত্যন্ত প্রিয়। গোয়েচা লা ১৬,২০০ ফুট। ইয়কসাম থেকে গোয়েচা হয়ে ইয়কসাম, মোট ৬৬ কিলোমিটার পথ।
গোয়েচা লা-র পথে জোংরির অবস্থান ১৩ হাজার ২০০ ফুট উচ্চতায়। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও জোংরি-অভিমুখী পথ থেকে রাথং, পাণ্ডিম, উত্তর ও দক্ষিণ কাব্রু, জফনু প্রভৃতি শৃঙ্গগুলির দেখা পাওয়া যাবে। যাঁরা প্রথম ট্রেক করবেন বা স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি সুন্দর ট্রেক সারতে চান তাঁরা অপেক্ষাকৃত সহজে জোংরি পর্যন্ত ট্রেক করতে পারেন। হিমালয় অভ্যন্তরের চড়াই-উৎরাই পথ, অরণ্য,চারণভূমি, নদী পেরিয়ে জোংরি টপে পৌঁছানো, সে এক রোমাঞ্চকর অভিযান। গোয়েচা লা-র তুলনায় স্বল্প আয়োজনে ইয়কসাম থেকে জোংরি টপ ও জোংরি পাস পর্যন্ত ট্রেক করা যায়।
জোংরি টপ যেন একটা গ্যালারি। এখান থেকে দেখবেন কাঞ্চনজঙ্ঘা, মাউন্ট কাব্রুর দুই শৃঙ্গ, পাণ্ডিম, সিমভো, কুম্ভকর্ণ, কোকথাং, ফ্রে পিকের মতো আকাশছোঁয়া সব পর্বতশিখর।
ইয়কসাম থেকে বাখিম, সোকা হয়ে জোংরি ২৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ ইয়কসাম থেকে জোংরি ট্রেক করে ফের ইয়কসাম ফিরে আসার জন্য মোট ৫০ কিলোমিটার পথ ট্রেক করতে হবে। এ পথে গাড়ির বালাই নেই। বড় দল হলে মাল বহনের জন্য ইয়াক বা খচ্চর ভাড়া পাওয়া যায়। সঙ্গে পোর্টার তো থাকবেই।
অভিজ্ঞ ট্রেকাররা দিন চার-পাঁচেকে ট্রেক সম্পূর্ণ করতে পারেন। হাই অল্টিটিউড ট্রেকপথ এটি। ট্রেকিংয়ে যাঁরা নতুন, তাঁদের একটু বেশি সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে ইয়কসাম থেকে যাত্রা শুরু করে ইয়কসাম ফিরে আসার জন্য ৬-৭ দিনের সময় হাতে নিয়ে ট্রেক-পথে পা রাখতে পারলে ট্রেকে তাড়াহুড়ো করতে হয় না। নিজেদের উদ্যোগে গেলে এনজেপি থেকে ইয়কসাম পৌঁছে যাত্রার ব্যবস্থাপনার জন্য একটা দিন ব্যয় হবে। ফিরে এসে ইয়কসাম বা সিকিমের অন্যত্র বিশ্রাম নিতে চাইলে অতিরিক্ত সময় লাগবে। তারপর এনজেপি যাওয়া ও এনজেপি থেকে ফেরার বিষয়টিও তো হিসেবে রাখতে হবে। অর্থাৎ সবমিলিয়ে অন্তত ১০ দিনের সময় হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরতে হবে। তবে, আবারও বলি, ৪-৫ দিনে ইয়কসাম থেকে যাত্রা শুরু করে জোংরি হয়ে ইয়কসাম ফিরে আসা সম্ভব। সকল সদস্যকেই শারিরীক দিক থেকে সুস্থ ও সাহসী মানসিকতার অধিকারী হতে হবে।
ইয়কসাম থেকেই পোর্টার, গাইড পাওয়া যাবে। শুধু পোর্টার সঙ্গে নিয়েও ট্রেক করতে পারেন। ওঁরাই পথ দেখাবেন। ইয়কসাম পৌঁছে আগে পোর্টার ঠিক করে নেওয়াই ভালো। পরবর্তী কার্যক্রমে ওঁরা নানাভাবে সহায়তা করবেন। ইয়কসামের বাজারে টেন্ট ভাড়া পাওয়া যাবে। সরঞ্জাম, খাবারদাবার সংগ্রহ করতে পোর্টার, গাইডরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সহযোগিতা করবেন। পথে ট্রেকার্স হাট পাওয়া যাবে। তবে ট্রেকিংয়ের মরশুমে অনেক সময়েই স্থান সঙ্কুলান হয় না ট্রেকার্স হাটে। সঙ্গে টেন্ট থাকলে রাতে মাথা গোঁজার অনিশ্চয়তা দূর হয়।
শিলিগুড়ি থেকে ইয়কসাম
ট্রেনে এনজেপি নামলে অটো করে শিলিগুড়ি বাস টার্মিনাসে চলে আসুন। এখান থেকে জোরথাং যাওয়ার শেয়ার গাড়ি পাবেন। শিলিগুড়ি থেকে জোরথাং ৮২ কিলোমিটার। ঘন্টা তিনেক সময় লাগবে। জোরথাং থেকে ইয়কসাম যাওয়ার জন্য গাড়ি রিজার্ভ করে নেওয়াই ভালো। শেয়ার গাড়ি আছে বটে, কিন্তু সে গাড়ি আঞ্চলিকদের অধিকারে চলে যায়। গাড়ির সংখ্যা কম। আর শেয়ার গাড়ি ধরার জন্য দুপুর ১টার আগে জোরথাং পৌঁছাতে হবে। তাই খরচ বেশি হলেও জোরথাং থেকে ইয়কসাম যাওয়ার জন্য রিজার্ভ গাড়িই শ্রেয়।
রাত্রিটা কাটবে ইয়কসামে। নিজেদের উদ্যোগে গেলে যোগাযোগে, যোগাড়যন্ত্রে পরের দিনটাও ইয়কসামে কেটে যাবে। ‘তিন জ্ঞানী সান্ন্যাসীর মিলনক্ষেত্র’ (ইয়কসাম মানে)। ১৬৪১ সালে এখানেই গোড়াপত্তন হয়েছিল চোগিয়াল রাজবংশের। ইয়কসাম সিকিমের প্রথম রাজধানী। ফেরার পথে ইয়কসামটা বেড়িয়ে নিতে পারেন। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গরিমা
জড়িয়ে রয়েছে ইয়কসামের সঙ্গে।
থ্রোন অফ নরবুগ্যাঙ এবং দুবদি ও কার্তক গুম্পা, ইয়কসাম টেম্পল, ইয়াংথাং রিনপোচে স্মারকস্থল সিকিমের ধর্মীয় সংস্কৃতি ও সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের পরিচয় দেয়। ইয়কসাম হিমালয়ের অন্দরে প্রবেশের পথও বটে।
ট্রেকপথে
৫৮৪০ ফুট উচ্চতার ইয়কসামে কাঞ্চনজঙ্ঘা পার্কে প্রবেশের ফি, ক্যাম্পিং ফি ইত্যাদি মিটিয়ে যাত্রা শুরু। হালকা চড়াই পথে চলতে চলতে ঢুকে পড়বেন হালকা জঙ্গলের পথে। ৮ কিলোমিটার দূরে সাচেন। পেরতে হবে পাহ খোলার উপরের একটা সুন্দর পুল। ৩ থেকে ৪ ঘন্টায় পৌঁছাবেন সাচেন। উচ্চতা ৭২৯০ ফুট।।
এই সাচেনে অনেকে থেকে যান রাতে। অনেকে থাকেন না। বিশ্রাম নিয়ে হাঁটা শুরু করেন। সাচেন থেকে সোকা ৮ কিলোমিটার। মোট ১৬ কিলোমিটারের হাঁটা, ইয়কসাম থেকে সোকা।
মন খোলার সেতু, সবুজ উপত্যকা, কত পাহাড়ি জলধারা দেখতে দেখতে পথ চলা। অনেক নীচে দেখা দেবে প্রেকচু নদী। পরতে পরতে খুলতে থাকবে আশ্চর্য করা সব ছবি, সূক্ষ্মতায়, বিশালতায়। প্রেকচু সেতু পেরনোর আগে মিনতক খোলার উপর তৃতীয় পুলটি। অর্থাৎ সোঁকার আগে পেরতে হবে মোট চারটি সেতু।
প্রেকচু সেতুর পর থেকে উঠতে হবে খাড়াই পথ ধরে। একটু কষ্টসাধ্য চড়াই পথ। বিশ্রাম বাখিমে পৌঁছে। এখানে গলা ভেজানোর জন্য চা-টা পাবেন। বাখিম থেকে ফের দেড় কিলোমিটার তীব্র চড়াই পথ বেয়ে পৌঁছাবেন সোকায়। ৯৭০০ ফুট উচ্চতায় সোকা একটি ছোট্ট গ্রাম। ওই উচ্চতায় চাষের খেত দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে। দোকানপাট, ট্রেকার্স হাট, বৌদ্ধ গোম্পা, আর কিছু বাড়িঘর নিয়ে সোকা। এখান থেকে পাণ্ডিম, জফনু, তেনজিং খাং শৃঙ্গ আর আরালাং রেঞ্জ সুন্দর দেখা যায়। ক্যাম্পিংয়ের জন ভালো জায়গা আছে সোকায়। দুর্দান্ত চড়াই পথ পেরিয়ে এসে প্রথম দিন, সাচেনে প্রথম রাত কাটালে দ্বিতীয় দিন সোকায় রাত্রিবাস।
পরের দিন সোকা গ্রাম ছাড়িয়ে আবারও চড়াই পথে যাত্রা। কনিফারের অরণ্যের মধ্যে দিয়ে পথ। সোকা থেকে চলে আসবেন ফেদংয়ে। এপ্রিল-মে মাসে এ পথ রঙিন হয়ে থাকে রডোডেনড্রনের ফুলে ফুলে। সোকা থেকে ফেদং হয়ে জোংরি ৯ কিলোমিটার। প্রায় পুরোটাই চড়াই পথ। সময় নিয়ে হাঁটবেন। শ্বাসকষ্ট হলে বিশ্রাম নেবেন। সোকা থেকে জোংরি পৌঁছাতে ঘন্টা পাঁচেক সময় তো লাগবেই।
পৌঁছেছেন জোংরিতে। উঠে এসেছেন ১৩,২০০ ফুট উচ্চতায়। তাঁবু টাঙানোর জন্য ভালো ক্যাম্পসাইট আছে। রাতের আহার সেরে এ দিন তাড়াতাড়ি শয্যা নিন। পরের দিন কাকভোরে উঠতে হবে
অন্ধকার থাকতেই জোংরি ভিউপয়েন্টের উদ্দেশে যাত্রা করতে হবে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা তখন। অনেক সময় ঝোড়ো বাতাস বয় জোংরির উপরিভাগে। ঠাণ্ডা-প্রতিরোধক ভালো ব্যবস্থা থাকা দরকার।
জোংরি টপ থেকে কাঞ্চনকঙ্ঘার এক আশ্চর্যকর রূপ দেখবেন। এ ছাড়াও দেখা যাবে কাবরু, সিংভো, পাণ্ডিম, কোকথাং, নরসিং প্রভৃতি পর্বতশৃঙ্গ। আকাশ পরিষ্কার থাকলে ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায় জোংরি টপ থেকে। আপনার জোংরি আসা যে সার্থক হবে সে-কথা হলফ করেই বলা চলে।
ফিরে আসুন ক্যাম্পে। প্রাতরাশ পর্ব সেরে বেরিয়ে পড়ুন জোংরি পাসের উদ্দেশে। জোংরি পাস থেকে উত্তর ও দক্ষিণ কাব্রু, রাথং শৃঙ্গ ও ফ্রে পিক দেখা যাবে অনেক বড় আকারে। সারা জীবন ক্যাম্পসাইট থেকে জোংরি পাস যাতায়াতে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা সময় লাগবে। ক্যাম্পে ফিরে খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম, একটু হাঁটাহাঁটি, রাতে ভালো ঘুম।
পরের দিন ব্রেকফাস্ট সেরে জোংরি থেকে সোকায় নেমে আসা। সোকায় রাত্রিবাস। তার পরের দিন সোকা থেকে সরাসরি ইয়কসামে ফিরে আসা।
ইয়কসাম থেকে জোংরি ট্রেকপথে ক্যাম্পসাইট পাবেন সাচেন, সোকা ও জোংরিতে। ট্রেকিংয়ের আদর্শ মরশুম মার্চের মাঝামাঝি সময় থকে মাঝ-জুন এবং মাঝ-সেপ্টেম্বরের থেকে নভেম্বর।
খরচ কেমন? ৭ দিনের হিসেবে মাথাপিছু অন্তত ১০-১২ হাজার টাকা। এই খরচের মধ্যে ট্রেনে যাতায়াতের খরচ ধরা নেই। ইয়কসামে থাকা, খাওয়াদাওয়া, ফি, টেন্ট, স্লিপিং ব্যাগ ইত্যাদির ভাড়া, পোর্টারের পারিশ্রমিক ইত্যাদির মতো খরচগুলি এই অঙ্কের অন্তর্ভুক্ত। ইয়কসামের আঞ্চলিক ডেরা থেকে পোর্টার, গাইড পেয়ে যাবেন। যে হোটেল বা হোমস্টে থাকবেন, সেখান থেকেও পোর্টার, গাইডের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।
ট্রেক এজেন্সি
চাইলে কোনও নির্ভরযোগ্য এজেন্সির ব্যবস্থাপনাতেও ট্রেকিংয়ের আয়োজন হতে পারে। কয়েকটি এজেন্সিঃ ডিজায়ার আর্থ ট্রেক অ্যান্ড এক্সপিডিশন (ইয়কসাম), ফোনঃ ৯৭৩৩০৫২৯১৯।
গ্লেসিয়ার ট্রেকস অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার, (ইয়কসাম), ফোনঃ ৭৪০৭২৪৮২০০।
সিকিম অ্যাডভেঞ্চারস ট্রেক গাইড সার্ভিসেস, (ইয়কসাম), ফোনঃ ৮৭৬৮০২৭০১৭
হিমালয়ান ট্রেকার (কলকাতা), ফোনঃ ৯৮৩৬১৩৩১৬৬।
ইয়কসামে থাকার ব্যবস্থা
হোটেল রেড প্যালেস, ফোনঃ ৯৭৩৩০৭৭০১৩। ইয়কসাম ভিলেজ হোমস্টে, ফোনঃ ৯৬৪৭১১১১২৬। লিম্বু হোমস্টে, ফোনঃ ৮৩৪৮১৬৭৭৬৩। লাভিজম হোমস্টে ৯৬৪৭১১১১২৬।