রাঁচিতে উঠেছি ঝাড়খণ্ড সরকারের পর্যটন বিভাগের বিরসা বিহার হোটেলে। ঝাঁ চকচকে হোটেল। লাউঞ্জ, রুম, রেস্তোরাঁ, সব জায়গাতেই আধুনিকতার সঙ্গে রুচিবোধের ছাপ। সুবিধা হল, হোটেলটি একেবারে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। সহজে গাড়িঘোড়ার নাগাল পাওয়া যায়। স্টেশনও খুব দূরে নয়। হোটেল থেকে রাঁচি স্টেশন ২ কিলোমিটার।
রাঁচির খ্যাতনামা টি বি স্যানিটোরিয়ামকে কেন্দ্র করে রামকৃষ্ণ মিশন সেবাকেন্দ্রের কর্মকাণ্ডের কিছুটা দেখে এবং মহারাজের সঙ্গে আলাপ সেরে গতকাল রাতে বিরসা বিহারে এসে উঠেছি। বুকিং করা ছিল। এই হোটেলটি শুধু নয়, এ শহরের কলেজ, বিশ্ববিদয়ালয় ও আন্যান্য নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘বিরসা’ নামটি যুক্ত হয়ে রয়েছে। এ রাজ্যের মানুষ সত্যিই পরম শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে রেখেছেন বিরসা মুন্ডাকে। আদিবাসীদের কাছে তিনি ঈশ্বরতুল্য।
১৮৫৭ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে বিরসা মুন্ডার নির্ভিক যোদ্ধা হিসেবে উঠে আসা। যুদ্ধটা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। অরণ্যের অধিকার অরণ্যের ভূমিপুত্রদের। তারা অরণ্য ব্যবহারের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে রাজস্ব দেবে না। এই ছিল অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য অরণ্যের পুত্রের সোচ্চার দাবি। বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে উত্তাল হয়ে ওঠে আন্দোলন। রাজদ্রোহের অভিযোগে ইংরেজ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। কারাবন্দি অবস্থায় মৃত্যু হয় বিরসা মুন্ডার।
রাত্তিরটা বেশ আয়েশেই কাটানো গেল। ব্রেকফাস্টের পরে বেরনোর জন্য, মানে রাচি ও তার আশপাশটা বেড়ানোর জন্য আমরা প্রস্তুত। বেরিয়েও পড়া গেল। রাঁচির এদিক-ওদিক চারটে অসাধারণ জলপ্রপাত আছে, তবে অবস্থান পরস্পরের বিপরীত দিকে। একটা দেখে তারপর আবার রাঁচি ছুঁয়ে অন্যটিতে যাওয়া।
ছোট নাগপুর মালভুমির দক্ষিণাংশে ঝাড়খন্ডের রাজধানী শহর রাঁচির গড় উচ্চতা ২,১৩৫ ফুট। পাহাড়, জঙ্গল, ঝর্ণা, লেক ইত্যাদির সমাহারে এই রাঁচি এক সময় ইংরেজদের অবসর যাপনের প্রিয় জায়গা ছিল। রাঁচির আশেপাশের খনিজের ভাণ্ডারগুলিও ইংরেজদের নজর এড়ায়নি। সামগ্রিক ভাবে রাঁচি ইংরেজদের কাছে ছিল ‘ম্যানচেস্টার অব দি ইস্ট’।
আজ আমাদের প্রথম গন্তব্য জামশেদপুরের দিকে, রাঁচি থেকে ৩৯ কিলোমিটার দূরের সূর্য মন্দির। বেশ পরিচ্ছন্ন মন্দির চত্বর। ভিড় ছিল না। ভালো করে ঘুরে দেখা গেল মন্দিরটি। রথের আকারের মন্দির।
মন্দির আভ্যন্তরে পদ্মফুলের ওপর উপবেশনরত সূর্যদেব। মূর্তীর চারটি হাত। শিব, দুর্গা, বিষ্ণু, গণেশের মূর্তিও আছে মন্দিরে। সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। মন্দির দর্শন সেরে ডাব খেয়ে বেশ তৃপ্তি হল। জানা গেল, বাংলার ডাব।
সূর্য মন্দির থেকে আরও ৩ কিলোমিটার এগিয়ে দশম জলপ্রপাত। এখানে গ্রাম সভার উদ্যোগে ভারতীয় সংবিধান আনুসারে গ্রামের মানুষের নানা অধিকার উল্লেখ করে কিছু বোর্ড টাঙানো রয়েছে দেখলাম। একটু অবাকই হলাম। আগে এরকমটা চোখে পড়েনি।
জলপ্রপাতের মোট ১০টি ধারা। তাই দশম জলপ্রপাত। সকাল সকাল পৌঁছে গিয়েছিলাম। ভিড় নেই। সুন্দর করে বাঁধানো এবং প্রশস্ত ৩০-৪০টা ধাপ নামতেই, আহা সে কী দৃশ্য। বিপুল জলরাশি নেমে আসছে শব্দ করে। সুবর্ণরেখার উপনদী কাঁচি দশম প্রপাতের ধারায় পুষ্ট। নীচে পাথরের অপর জলস্রোতের আঘাতে সৃষ্ট অযুত জলকণা যেন ধোঁয়ার কুণ্ডলীর আকার নিচ্ছে। জব্বলপুরের ধুয়াঁধার জলপ্রপাতের কথা মনে পড়ছিল। প্রপাতের মুখোমুখি আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে। যেন আমাদের জন্যই এত আয়োজন। মনটা আনন্দে ভরে উঠল।
রাঁচি ফিরে বিপরীত দিকে একই পথে দেওরী মন্দির, হুন্ড্রু ও জোনহা জলপ্রপাত। রাজ্যসড়ক-৩৩ ধরে রাঁচি থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে একাদশ শতকে তৈরি দেওরী মন্দির। দেবী দুর্গার অধিষ্ঠান মন্দিরে। প্রতিবেশী নানা রাজ্য থেকে ভক্তরা আসেন মন্দির দর্শনে। মন্দির ও দেবী দর্শন করে চললাম হুন্ড্রু জলপ্রপাতের উদ্দেশে। পথে পড়ল রাঁচির মোরাবাদী রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম পরিচালিত বিশাল এক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র। হুন্ড্রু জলপ্রপাতের কাছে এগিয়ে দিয়ে পথ শেষ।
বাঁ-দিকে একটা ব্রিজ পেরিয়ে পাহাড়ের কোল ঘেঁসে ছোট্ট এক পথ ধরে নেমে আসা যায় জলপ্রপাতের বিপরীতে নীচের দিকটায়। সেখান থেকে ঝর্ণাটিকে দেখা যায় আরেক রূপে।। জলপ্রপাতের প্রবেশপথে নানা প্রকার খাবারের দোকান। স্থানীয়দের নরম কাঠ দিয়ে তৈরি রকমারি হস্তশিল্প সামগ্রীর দোকান দিয়েছেন দেখা গেল। ডানদিকে প্রায় ৭০০ ধাপের সিঁড়ি নেমে গেছে। কষ্ট করে নামা-ওঠা করতে পারলে জলপ্রপাতের দৃশ্যপট মনে থাকবে অনেক দিন। সিঁড়ি দিয়ে নামা-ওঠায় দেড়-দু’ঘন্টা সময় লাগবে। বাঁয়ের ব্রিজ থেকেও হুন্ড্রুর ধারা চোখে পড়বে। তবে নীচে নেমে দেখার তুলনা হয় না।
এরপর জোনহা জলপ্রপাত। গৌতমধারা নামেও পরিচিত। গৌতম বুদ্ধ এখানে এসেছিলেন বলে মনে করা হয়। বন্য প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে ৫০০ সিঁড়ির নিম্নগামী পথ ধরে পৌঁছাতে হয় নীচের দিকে। পরিবেশের সঙ্গে মিলিত হয়ে থাকে কাঁচি নদীর কলকুল আবহসঙ্গীত।
রাঁচি ফেরার পথে ঢুঁ মেরেছিলাম রাঁচির পাগলাগারদ নামে সাধারণ্যে প্রচলিত রাঁচি ইনস্টিটিউট অব নিউরো-সাইকিয়াট্রি আ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেসে (রিনপাস)। মানসিক রোগের চিকিৎসা ক্ষেত্রে কেন্দ্রিয় সরকারের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান এটি। পরিচয় দিতে আউটডোর পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ পাওয়া গেল। ওইদিন কেন্দ্রীয় সরকারের ছুটি থাকায় সবটা ঘুরে দেখা গেল না। একই কারণে দেখতে পাইনি রাঁচির আরেকটি বিশেষ দ্রষ্টব্য আদিবাসী মিউজিয়ামটি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পরে মোরাবাদী টিলার উপরে ‘শান্তিধাম’ নামে একটি বাড়ি তৈরি করে সেখানে থাকতে শুরু করন। ১৯১০ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত বসবাস করেছিলেন। সাল ইত্যাদি এখানকার একটি ফলকে লেখা আছে। পাহাড়টি টেগোর হিল নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৭ সালে। উল্টোদিকে বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়। শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে জগন্নাথ মন্দিরটিও দেখা হল। পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরের আদলেই তৈরি। শহরের অদূরে পাহাড়িয়া মন্দির। শিবের মন্দির। সিঁড়িপথের অনেকগুলো ধাপ ভেঙ্গে মন্দির প্রাঙ্গনে পৌঁছতে হয়। শেষ লপ্তে বিক্রমভাই ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির রাঁচির প্রাসাদোপম বাড়িটিও দেখিয়ে দিল।
ফিরলাম বিরসা বিহারে। এবার ঘরে ফেরার পালা। হাত জোড় করে বিদায় জানালাম সারথী বিক্রমভাইকে। রাতটা বিরসা বিহারেই কাটবে। পরের দিন দুপুরে উঠে বসলাম শতাব্দী এক্সপ্রেসে। ক’দিন ধরে ঝাড়খণ্ড ভ্রমণের নানা ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকল।
ফটোঃ লেখক
প্রথম পর্বের লেখাটি পড়তে পারেন এখানে https://torsa.in/around-ranchi-on-pujo-holidays/
দ্বিতীয় পর্বের লেখাটি পাবেন এখানে https://torsa.in/pujo-holidays-around-rachhi/