(অন্তিম পর্ব)
[পূর্বানুবৃত্তি : বিরুপাক্ষ মন্দির, কোদানদারামা মন্দির, হনুমান মন্দির, অচ্যুত রায় মন্দির, লোকোপাবনা বিশ্ববিদ্যাল্যের ধ্বংসাবশেষ, পুরন্দর মন্তপা, রাজকীয় তুলাদণ্ড, মহানবমী ডিব্বা ও কল্যাণী পুষ্করনী দেখে হাম্পির প্রধান প্রবেশদ্বারের পথে ডানদিকে কৃষ্ণ মন্দির, কমলাপুর রোড ধরে কিছুটা এগিয়ে ডান দিকে বড় শিবলিঙ্গের মন্দির দেখা গেল। কাছেই লক্ষ্মী-নৃসিংহ বিগ্রহ। কমলাপুর রোড ধরে আর একটু এগলেই বীরভদ্র ও পাতালেশ্বর মন্দির। এরপর দেখলাম কমলমহল, অর্থাৎ পদ্মমহল ও হাতিশালা।]
এগিয়ে চলেছি। অদূরে কৃষ্ণদেব রায়ের আমলে, ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হাজরা রাম মন্দির। মন্দিরটির গায়ে রামায়ণের কাহিনি, বিভিন্ন যোগমুদ্রা, দশাবতারের ছবি এবং বৈষ্ণব দেব-দেবী, নানা জীবজন্তু, বাদ্যযন্ত্র ও নর্তক-নর্তকীর ভাস্কর্য রয়েছে। উত্তরে রক্ষীদের থাকার জায়গা। এখানে অনেকগুলো পাথরের স্তম্ভের দেখা পাওয়া যায়।
পূর্ব দিকে বিজয়নগর স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি চন্দ্রশেখর মন্দির। তার পিছনে বিষ্ণু ও সরস্বতী মন্দির। সামনেই রাণীদের স্নান করার জায়গা। জায়গাটিতে মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। জলনিকাশীর ব্যবস্থাও মনযোগ আকর্ষণ করে। রাণীদের বিশ্রামের জায়গা, পোশাক বদলানোর জায়গা, সব মিলিয়ে এলাহি ব্যবস্থা। গাইডের ধারাভাষ্যের সঙ্গে সঙ্গে অতীত যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।
মধ্যাহ্নভোজনের সময় হয়েছে। কর্ণাটক পর্যটনের যে হোটেলে আমরা আছি তার রেস্তোরাঁতেই খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। আশেপাশে অন্য রেস্তোরাঁ নেই। হসপেট থেকে যাঁরা এসেছেন তাঁরাও খেয়ে নিলেন এখানে। দুপুর দুটো নাগাদ আবার বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটাপথে সামনেই হাম্পি মিঊজিয়াম। হাম্পির রাজাদের আমলের পাণ্ডুলিপি, অস্ত্রশস্ত্র, মুদ্রা, বিগ্রহ ইত্যাদি সযত্নে রক্ষিত আছে সংগ্রহশালায়।
মিউজিয়াম থেকে পূর্বদিকে তিন কিলোমিটার দূরে কানাড়া বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসটি ‘দৃক-দৃশ্য বিবেকম’ গ্রন্থের রচয়িতা, দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত মুনি বিদ্যারণ্য-র নামে। এখানে কানাড়া সংস্কৃতি-বিষয়ক গবেষণার কাজ হয়।
কমলাপুর ছেড়ে বিঠালা মন্দির দেখব বলে এগিয়ে চললাম। পথে পড়ল সিস্টার্স স্টোন। বিরাট আকৃতির দুটি পাথর যেন মুখে মুখ লাগিয়ে বসে আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় দুটো মানুষ মুখোমুখি বসে আছে। এ নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে। একবার দুই বোন হাম্পির ধ্বংসাবশেষ দেখতে এসেছিল। দেখা শেষ হলে এক বোন আরেক বোনকে বলল, এত কষ্ট করে এই ধ্বংসাবশেষ দেখতে এলাম, তার চেয়ে বাড়িতে থাকলেই ভালো হত। এই কথা বলার মুহূর্তের মধ্যে দুই বোন পাথরে পরিণত হয়। বিজয়নগরের ধ্বংসাবশেষকে যে কোনওভাবেই উপেক্ষা করা চলে না তা বোঝাতেই যেন এই গল্পগাঁথা।
এরপর আমরা এলাম বিজয় বিঠালা মন্দিরে। মন্দিরের অনেকটা দূরে আমাদের গাড়ি দাঁড় করাতে হল। ব্যাটারিচালিত গাড়িতে মন্দিরের কাছে পৌঁছালাম। পরিবেশ দূষণ রুখতে এই ব্যবস্থা। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে রথের আকৃতির একটি সৌধের সূক্ষ কাজ চমৎকৃত করে। একটু এগতেই মিউজিক্যাল স্তম্ভ দিয়ে ঘেরা বিজয় বিঠালা মন্দির। প্রত্যেকটি স্তম্ভ ভালো করে দেখতে একটা বেলা লেগে যায়।
এই মিউজিক্যাল পিলারগুলো চতুর্দশ শতকে রাজা দ্বিতীয় দেবরায়ের আমলে তৈরি হলেও পরে কৃষ্ণদেব রায় এগুলির রক্ষণাবেক্ষণে যত্নবান হন। মন্দির ঘিরে ৫০টি স্তম্ভ রয়েছে। তারমধ্যে ৮-১০টি স্তম্ভে নানা বাদ্যযন্ত্রর সুর সৃষ্টি হয়। আমাদের গাইড নিজে বাজিয়ে দেখালেন, কোনোওটি থেকে মৃদঙ্গ, কোনোওটি থেকে জলতরঙ্গের মতো সব সুরধ্বনি পাওয়া যেতে লাগল। হাম্পির ধ্বংসাবশেষের মধ্যে উদ্ধার হওয়া নানা বিচারে সেরা তিনটি মন্দিরের মধ্যে বিজয় বিঠালা মন্দির একটি।
বিজয় বিঠালা মন্দির দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে গেল। পশ্চিম আকাশে সূর্যাস্তের সিঁদুরে রং। ক্ষীণস্রোতা তুঙ্গভদ্রায় সেই রঙের আভা। কতকাল আগে এভাবেই সূর্যাস্ত হত এখানে। তখন তুঙ্গভদ্রা প্রশস্ত। তুঙ্গভদ্রা-তীরের হাম্পি গমগম করছে প্রাণে, সম্পদে।
হসপেটে ফেরার পথ ধরলাম। ধ্বংসপ্রাপ্ত হাম্পির অদূরে হসপেট এক আধুনিক নগরী। রাজা কৃষ্ণদেব রায় তাঁর স্ত্রী তিরুমালা দেবীর এই শহরের পত্তন করেছিলেন। হসপেট শহরের বাসিন্দারা এখনও কৃষ্ণদেব রায়কে ভগবান বোধে শ্রদ্ধা করেন। তুঙ্গভদ্রা নদীর ওপর গড়ে তোলা বাঁধ দেখব বলে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে গাড়ি রেখে হেঁটে চলে এলাম বাঁধের কাছে। বাঁধ হয়েছে, নদীও ক্ষীণস্রোতা হয়েছে।
পরদিন সকালে মর্নিং ওয়াকের আছিলায় আরেকবার চলে এলাম হাম্পিতে। আরেকবার দেখব,স্পর্শ করব বলে। প্রহরীদের বিশেষ অনুমতি নিতে হল। প্রধান প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলাম। বেলা ১০টার আগে হাম্পিতে প্রবেশ নিষেধ। হাম্পি দর্শনে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে ২১-২২টি স্থাপত্য দেখানো হয়। কিন্তু আরও অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে আছে এদিক ওদিক। খননকার্য চলছে এখনো। খননস্থলে যাওয়া নিষেধ। অনুরোধ করে সেখানেও এগিয়ে গিয়ে দেখলাম। খনন চালিয়ে সদ্য আবিষ্কৃত হয়েছে একটি স্বরস্বতী মন্দির। অবাক হয়ে গেলাম তার সৌন্দর্যে। আরও যে কত মণিমুক্ত রয়েছে হাম্পির মাটির গর্ভে। অদূরেই এক বিরাট স্নানঘর। পাশে সার দিয়ে অনেকগুলো স্তম্ভ। সেগুলির ফাঁক দিয়ে সূর্যোদয় হল। এভাবেইপ্রায় ৫০০ বছর ধরে প্রাচীণ বিজয়নগর সভ্যতা ও বর্তমানে তার ধ্বংসাবশেষের
ওপর দিয়ে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত হয়ে চলেছে। বয়ে চলেছে সময়।
আবার কখনো হাম্পি দেখতে আসব, এই আশা নিয়ে হাম্পি ও হসপেট শহরকে পিছনে রেখে হায়দ্রাবাদের উদ্দেশে রওনা দিলাম। হায়দ্রাবাদে তিনদিন কাটিয়ে কলকাতায় ফিরব।
* প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের লেখা পাবেন আর্কাইভে।