(দ্বিতীয় পর্ব)
[ পূর্বানুবৃত্তি : প্রাচীন হাম্পি শহরের ভগ্নস্তূপে সূর্যাস্তের পর, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় তুঙ্গভদ্রার তীরে দাঁড়ালে এখনো হাম্পি যেন তার অতীত সৌভাগ্যের দিনগুলির গল্প বলে। হরিহর, বুক্কো, কুমার, কম্পন, দেবরায়, মল্লিকার্জুন, কৃষ্ণদেব রায়দের শাসনকালের কত কাহিনি। নদীর দুই পাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চতুর্দশ শতকের বিজয়নগর সাম্রাজ্যের কত না নিদর্শন। বিরুপাক্ষ মন্দির দেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম অন্যান্য নিদর্শন দেখতে। ]
সুগ্রীব গুহা থেকে একটু এগিয়ে গেলেই দেখতে পাওয়া যায় বৈশ্য রায়ের আমলে তৈরি লোকোপাবনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক দেবী সরস্বতী, অষ্টদল পদ্মের উপর উপবিষ্টা, দু’দিক থেকে দুটি হাতি পবিত্র ঘটে করে মূর্তির মাথায় জল ঢালছে। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ভগ্ন ভবনটির বাঁদিকে হনুমান আর ডানদিকে গরুর পাখি যেন সকলকে আহ্বান জানাচ্ছে।
মাতঙ্গ পর্বত থেকে নেমে ডানদিকে ৬০-৭০ ফুট উঁচুতে কোদানদারামা মন্দির। এখানে পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে নদী বয়ে গেছে, বর্ষাকালে হ্রদের মতো এই জলাধার থেকে উপচে পড়ে জল, প্রচন্ড জলস্রোত পাকদন্ডীর মতো পথে নেমে আসে। তাই অনেকে একে চক্রতীর্থ বলেন।
মন্দিরে প্রায় আট ফুট লম্বা একটি পাথর থেকে তৈরি রাম-সীতা এবং লক্ষ্মণের মূর্তি আছে। পেছনেই যন্ত্র দ্বারকা হনুমান মন্দির। এই মন্দিরের অদূরেই অচ্যুত রায় মন্দির। এই মন্দির তৈরি করেছিলেন রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের ভাই অচ্যুত রায় (১৫১৩-১৫৩৯)। মন্দিরের স্তম্ভের অসাধারণ ভাস্কর্য এবং দরজায় খুব ছোট্ট ছোট্ট আকারের দশ অবতারের ভাস্কর্য দারুণ। আর একদিকে রয়েছে দশভূজা দেবীর মূর্তি। এই দেবীমূর্তিকে ভক্তরা হত্তু কালী আম্মা বলে। মন্দিরের ভিতরে চারিদিক দিয়ে ছোট ছোট দোকানের মতো ঘর, শোনা যায় সে-সময় এখানে দুর্মূল্য হীরে, মণিমাণিক্য বিক্রি হতো। সুলে বাজার বলে খ্যাত ছিল অঞ্চলটি।
আর একটু এগিয়ে গেলেই পুরন্দর মন্তপা বা আশ্রম। পুরন্দর ঋষি ১৫৪০-এর দশকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যে কন্নড় ভাষীদের মধ্যে ভক্তিবাদের প্রসার ঘটিয়েছিলেন। দক্ষিণ ভারতের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রসার ও উন্নতিতেও তাঁর অবদান প্রচুর। তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে মনোরম পরিবেশে এই আশ্রম। বর্ষাকালে নদীর জল আশ্রম এলাকায় ঢুকে যেত। কিন্তু উঁচু উঁচু পিলারের উপর এই মন্তপা তৈরি বলে কোনো অসুবিধা হতো না। চারিদিকে টিলা পাহাড়, বনরাজি ও নদী নিয়ে এক অপূর্ব শান্ত ও মনোরম পরিবেশ। সে সময়ে বিজয়নগরে যাবার জন্য তুঙ্গভদ্রা নদীর ওপর দিয়ে একটি ব্রিজও ছিল, বর্তমানে তার কোনো চিহ্ন নেই।
সেখান থেকে আর একটু পূবে এগিয়ে গেলেই দেখা যায় বেশ উঁচু দুটি পাথরের পিলারের উপর অনুভূমিকভাবে রাখা আর একটি পাথরের দণ্ড। হঠাৎ দেখলে মনে হবে এক বিরাট সিংহদরজা। এটিকে কিংস ব্যালান্স নামে অভিহিত করা হয়। এই রাজকীয় তুলাদণ্ডে দশহারা এবং মহানবমীর সময় একদিকে রাজা বসতেন অন্যদিকে তার ওজনের সমান করে রাখা হতো মণিমুক্তো হীরে ইত্যাদি। সেই মণিমুক্তো পরবর্তীকালে দরিদ্র প্রজাদের মধ্যে দান করে দেওয়া হতো।
একটু এগিয়ে ডান দিকে পড়ল মহানবমী ডিব্বা। মহানবমী বা অন্যান্য পূজা উৎসবের আয়োজন করা হতো এখানে। একশোটি গর্ত আছে এখানে। মনে করা হয়, এগুলি নিশ্চয়ই এল লাগানোর কাজে ব্যবহার করা হতো। পাশেই রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বার। রাজা তার মন্ত্রী ও বিশ্বস্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে এখানে গোপন আলোচনা করতেন।
এরই ঠিক পাশে ৩০০ ফুট লম্বা এবং ১০০ ফুট চওড়া একটি চৌবাচ্চা আছে, হয়তো সেইসময় সুইমিংপুল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখানে চারদিকে পাথরের গোল গোল থালার মতন পাত্র রয়েছে। গাইড বললেন, এই পাত্রে বিষ মেশানো খাবার দিলে, পাথরের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করতো, এবং তা থেকে সহজেই খাদ্য বিষয়ক সুরক্ষা সম্ভব হতো। আপাতদৃষ্টিতে পাথরের থালাগুলির আকার একরকম দেখতে হলেও আওয়াজ করলে ভিন্ন শোনায়।
মহানবমী ডিব্বার অদূরে সমতল থেকে একটু নীচে রয়েছে এক সুন্দর পুষ্করিণী- কল্যাণী পুষ্করিণী। পাঁচটি বড় ধাপ চারদিক দিয়ে ক্রমশ পুকুরের তলদেশ পর্যন্ত চলে গেছে, যত নিচে নেমেছে তত চওড়া ধাপ। এছাড়াও এই পুকুরের স্থাপত্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কাছেই রয়েছে একটি মন্দির। তবে মন্দিরের দেব-দেবীকে চিহ্নিত করা সম্ভব হলো না। কল্যাণী পুষ্করিণীর জল আসবার নালা পাথরের, কারুকার্যখচিত, পুষ্করিণী-র তলদেশ পাথরের। মহানবমী ডিব্বার অদূরে রাস্তার ধারে অবহেলায় পড়ে আছে প্রায় ৪২ ফুট লম্বা ২.৫ ফুট গভীর একটি বিরাট পাথরের দরজা।
কমলাপুর থেকে হেমকুটা যাওয়ার পথে হাম্পির প্রধান প্রবেশদ্বার। সেই পথে ডানদিকে পড়বে কৃষ্ণ মন্দির, এটি ৩০০ ফুট লম্বা ও ২০০ ফুট চওড়া, অপেক্ষাকৃত অক্ষত আছে। গজপতি রাজাকে পরাস্ত করে বিজয় সৌধ হিসেবে কৃষ্ণদেব রায় এই মন্দির তৈরি করেন। মন্দিরের অভ্যন্তরে কৃষ্ণের মূর্তি, যদিও বর্তমানে সে মূর্তি নেই মন্দিরে। হায়দ্রাবাদের মিউজিয়ামে রাখা আছে। এই মন্দিরের নাটমন্দিরটি অসাধারণ, নাটমন্দিরের স্তম্ভটি কৃষ্ণের জীবনের নানা কাহিনী নিয়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত। গর্ভগৃহের চারিদিকেও অসাধারণ ভাস্কর্য। মন্দিরের সামনে একটি বড় পুষ্করিণী এবং তার মাঝখানে একটি মন্তপ।
কমলাপুর রোড ধরে গেলে আরেকটু ডানদিকে বড় শিবলিঙ্গের মন্দির। হাম্পিতে যত শিবলিঙ্গ দেখা যায় তারমধ্যে এটিই সর্বোচ্চ, প্রায় ১২ ফুট উঁচু। শিবলিঙ্গের নিচের অংশ সবসময় জলে ডুবে থাকে।
কয়েক গজ দূরেই ‘লক্ষ্মী-নৃসিংহ‘ বিগ্রহ। এই প্রাচীন শহরে যত বিগ্রহ পাওয়া গেছে তার মধ্যে সবচেয়ে আকৃতিতে বড় ও দীর্ঘ এই মূর্তি। কথিত আছে, রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের আমলে কোনো এক ব্রাহ্মণ ১৫২৮ সালে এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকে একে উগ্র নৃসিংহ বলেন। মূর্তির পিছনে বিস্তৃত সাপের ফণা। সে সময়ে কোনও এক মন্দিরে এই মূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছিল, বর্তমানে সেই মন্দিরের চিহ্ন নেই।
কমলাপুর রোড ধরে আর একটু এগোতেই পথে পড়ল বীরভদ্র মন্দির। জানা যায়, রাজা রাম রায়ের আমলে তৈরি হয়েছিল। প্রথমে একে বলা হতো মুদ্দাভীর্ণ। ক্রমেই পরিচিত হয় উদ্যানা বীরভদ্র নামে।
ধীরে ধীরে দুপুর হচ্ছে আর বাড়ছে রোদ্দুরের তাপ। অক্টোবরের দুপুরে মনে হচ্ছে যেন চৈত্রের গরম। আরেকটু এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল পাতালেশ্বর মন্দির। মন্দিরটি সমতলভূমি থেকে বেশ খানিকটা নীচে, রাজা বুক্ক রায়ের আমলে তৈরি। গর্ভগৃহটির ভিতরে অনেকটা জায়গা, এখনো শিবলিঙ্গ রয়েছে, তারই সামনে রয়েছে নন্দীর মূর্তি। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে একটি জলের প্রবাহ, তাই সবসময় ভিতরে খুব ঠান্ডা, দূর থেকে এসে মনে হচ্ছিল এখানেই বসে থাকি। এই মন্দিরটিকে অনেকে প্রসন্ন-বিরূপাক্ষ মন্দির বলে থাকেন।
এবার চললাম কমল মহল, অর্থাৎ পদ্ম মহল। মহানবমী ডিব্বার দক্ষিণ দিকের ছোট একটি প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে বিরাট খোলা জায়গায় মাঝখানে এই কমল মহল। গঠনে ভারতীয় এবং মুসলিম স্থাপত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। পুরো বাড়িটি চুন-সুড়কি দিয়ে তৈরি। তখনকার দিনে বাড়িটিকে ঠান্ডা রাখবার জন্যে একেবারে উপর থেকে জলের প্রবাহ যাতে নেমে আসে তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিভিন্ন জানলাগুলোতে পর্দা ঝোলানোর ব্যবস্থা রয়েছে। গরমকালে রাজা এখানে এসে থাকতেন।
ধীরে ধীরে ওয়াচ টাওয়ারের মাথায় উঠলে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। কমল মহলের চারিদিকে দুর্গের মতন প্রাচীর। আমরাও কমল মহলে ঠান্ডার আবেশ পেলাম। এরই পাশে রয়েছে হাতিশালা। রাজার নিজস্ব হাতি থাকতো এখানে । হাতিশালাটিও খিলান দেওয়া গম্বুজ আকৃতির বাড়ি। এটি তৈরির ক্ষেত্রেও চুন-সুরকি ব্যবহার এখনো চোখে পড়ে। হাতিশালে হাতি প্রবেশের জন্য যেরকম বড় দরজা তেমনি আবার এক প্রকোষ্ঠ থেকে আর এক প্রকোষ্ঠে যাওয়ার জন্য ভেতর দিয়ে ছোট ছোট দরজা আছে। একদিকে রোদ্দুরের প্রখর তাপ, দুপুর বেড়েছে তাই খিদেও পাচ্ছে, গাইড বললেন আর দুটো জিনিস দেখে নিয়ে আমরা দুপুরের খাবার খেতে যাবো। প্রশস্থ মাঠের মাঝখানে একটি বড় গাছের নিচে ডাব বিক্রি হচ্ছিলো, সকলে কী আনন্দ করে ডাবের জল খেলাম। গরমে কি প্রশান্তি।
ক্রমশ :