২০১৫ সালের অক্টোবর মাস। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে। সেখান থেকে ব্যাঙ্গালোর। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা মহীশূর রাজবাড়ি। কর্নাটক সরকারের তত্ত্বাবধানে রাজবাড়ির একটি অংশ এখন হোটেল। সেখানে উঠলাম। বিকেল থেকে আমরা রাজপ্রাসাদের অন্দরে ঘুরে দেখছি। বছর দশেক আগে আর একবার এসেছিলাম, সে সময় মিউজিয়াম ইত্যাদি খুব ভালো করে দেখেছিলাম। এখন দেখলাম অনেক বিধিনিষেধ, তখন যেগুলো হাত দিয়ে দেখেছিলাম, এখন দূর থেকে দেখতে হয়।
সন্ধ্যার একটু আগে বসল শাস্ত্রীয় সংগীতের আসর। ধীরে ধীরে পুরো রাজপ্রাসাদ আলোকমালায় উদ্ভাসিত হল। নবরাত্রি উপলক্ষে পুরো শহরটাই আলোয় সেজে উঠেছে। রাজকীয় মেজাজ বিচ্ছুরিত হচ্ছে চারিদিকে। তার সঙ্গে শাস্ত্রীয় সংগীতের মূর্ছনা এক অনন্য মার্গে পৌঁছে দিয়েছিল সেই রাতটিকে।।
বন্দিপুর, মধুমালাই ও চম্বলের চন্দন বন পেরিয়ে উটি ঘুরে ২১ অক্টোবর সন্ধ্যায় মহীশূর থেকে ট্রেন ধরেছিলাম হাম্পি আসব বলে। মাইসোর থেকে ট্রেনে হসপেট পৌঁছাতে হবে আগে। সেখান থেকে হাম্পি ১২ কিলোমিটার। ট্রেনটি ব্যাঙ্গালোর থেকে ছাড়ে। তিন মাস আগে প্রথম যেদিন টিকিট খুলেছিল সেদিনই বুক করে নিয়েছিলাম। সকাল সাতটা নাগাদ পোঁছোলাম হসপেট। হাম্পি শহরের কাছেই কমলাপুরে কর্নাটক সরকারের মৌর্য ভুবনেশ্বরী হোটেল আমাদের আশু গন্তব্য। কর্নাটক টুরিজম থেকে বুক করা গাড়ি আমাদের সোজা হোটেলে পৌঁছে দিল। ঐতিহ্য ও আধুনিকনতার সুন্দর সহাবস্থান। একেবারে হাম্পি শহরের প্রবেশদ্বারের বিপরীতে। হোটেল থেকে হাঁটা পথে হাম্পি মিউজিয়াম।
সহ্যাদ্রি পর্বতের সুদূর দক্ষিণ থেকে দুটি ছোট নদী বেরিয়ে এসেছে, তুঙ্গ ও ভদ্রা, কিছু দূর এগোনোর পর মিলেমিশে হয়েছে তুঙ্গভদ্রা। তার যাত্রাপথ জটিল, শিলা সংকুল, সঙ্গী-সাথীও নেই। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর বোন কৃষ্ণার সঙ্গে দেখা। তারপর দুই বোন একসঙ্গে গলা জড়াজড়ি করে অবশেষে দেশের পূর্ব সীমায় বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। তবে ২০০ বছরের জন্য সৌভাগ্যের দিন এসেছিল। তার দক্ষিণ তীরে বিরুপাক্ষ পাষাণ মূর্তি ঘিরে প্রাকার বেষ্ঠিত উন্নত এক নগরী গড়ে উঠেছিল। নাম বিজয়নগর। বর্তমানে হাম্পি নামে পরিচিত। ২০১৫ সালে কর্নাটক ট্যুরিজমের এই হোটেলটি ছাড়া সেসময় কোন হোটেল ছিল না,শুনেছিলাম হাম্পি শহরের ভেতরে পুরনো গ্রামে কিছু কিছু হোমস্টে-র ব্যবস্থা আছে, সবক্ষেত্রেই অগ্রিম বুকিং করা জরুরি।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের (১৩৩৬-১৫৬৫) রাজধানী এই হাম্পি এখন ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন খিলজি দক্ষিণ ভারতের এই সমস্ত অঞ্চল দখল করে নেন। তখন ওইখানকার ভূমিপুত্ররা রুখে দাঁড়ান এবং বিজয়নগর সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন, প্রায় ২২০ বছর বিভিন্ন বংশের হিন্দু রাজারা বংশ পরম্পরায় এখানে রাজত্ব করেছেন।
সঙ্গম বংশীয় হরিহর বক্কার সময়ে রাজত্ব বিস্তার লাভ করে। এরপর শুরু হয় তুলুভা বংশ এবং তাদের পরম্পরা। এই বংশের সর্বশেষ এবং সফল রাজা কৃষ্ণদেব রায়। প্রজাবৎসল রাজা। তাঁর রাজত্বকালে মোট রাজস্বের দুই ভাগ খরচ হতো প্রতিরক্ষা খাতে, একভাগ দান-দাতব্য ইত্যাদি খাতে আর একভাগ সঞ্চিত থাকত প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ ও উদ্ধারকার্যের জন্য। কৃষ্ণদেব রায় ছিলেন বহুমুখী ব্যক্তিত্ব, যেমন বলিষ্ঠ চেহারা তেমন ছিল সংস্কৃত এবং তেলুগু ভাষায় পান্ডিত্য আর রামায়ণ-মহাভারত সম্পর্কিত জ্ঞান। তার জীবদ্দশার শেষ কুড়ি বছর বিজয়নগর সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ। সে সময় প্রজারা যেমন সুখি ছিলেন, রাজভান্ডারও ছিল পরিপূর্ণ। হাম্পি শহরের ১২ কিলোমিটার দূরের তুঙ্গভদ্রার তীরে বেলারি জেলায় হসপেট নামে এক নগরী গড়ে তোলেন তিনি। হসপেট এখন আধুনিক শহর। কলকাতা, ব্যাঙ্গালোর সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগ রয়েছে এই শহরের । হাম্পি যেতে হলে হসপেট যাওয়ার টিকিট করতে হয়।
পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী হোটেলের ঘরে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে সকাল দশটা নাগাদ কর্নাটক টুরিজমের গাড়িটি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। হাম্পি প্রায় ২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জোড়া প্রাচীন শহর। খোলা আকাশের নীচে এক আশ্চর্য মিউজিয়াম। শহরের চারিদিকে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে অসংখ্য স্মৃতিসৌধ। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চলছে এখনো।
প্রথমেই আমাদের গাড়ি গিয়ে দাঁড়ালো বিরুপাক্ষ মন্দিরের সামনে। হাম্পি শহরের এই অংশে লোকসমাগম বেশি। প্রায় সব টুরিস্ট এখানে এসে গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে হাম্পি ভ্রমণ শুরু করেন। আমাদের ড্রাইভার আগেই বলে রেখেছিল, গাইড ছাড়া হাম্পি ভালো করে দেখতে, বুঝতে পারবেন না। বিরুপাক্ষ মন্দিরের সামনে অনেক সরকার অনুমোদিত ও বেসরকারি গাইড মেলে। যেহেতু আমরা সরকারি হোটেলে ছিলাম, সরকারি গাড়ি, তাই ওঁরাই কর্নাটক টুরিজমের কন্ডাক্টেড টুরের গাইডের সঙ্গে আমাদের জুড়ে দিয়েছিলেন। পেয়ে গিয়েছিলাম খোদ সরকারি গাইড। ভদ্রলোক জ্ঞানী, তেমনি আন্তরিক। কখনো-সখনো ছবি তোলার ক্ষ্যাপামির জন্য অন্যমনস্ক হলে স্কুলশিক্ষকের মতন বকাবকি করে ডেকে নিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে বলে দিচ্ছিলেন।
বিরুপাক্ষ মন্দিরটি ১৬৫ ফুট উঁচু, ১৫০ ফুট চওড়া। ১১ তলার বিশাল স্থাপত্য। তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে মন্দির। এই মন্দিরকে অনেকে বিস্তপ্পা মন্দির বলে। কবে কে মন্দির তৈরি করেছেন সেভাবে জানা যায় না। তবে মন্দিরের ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শৈলী দেখলে বোঝা যায় এটি বারবার মেরামত করা হয়েছে। মন্দিরের প্রধান প্রবেশপথ থেকে ১৩৫ ফুট লম্বা ও ৫১০ ফুট চওড়া এক প্রশস্ত প্রাঙ্গন দেখা যায়। রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সময় তৈরি হয় জায়গাটা। এই প্রশস্ত উঠোনের মাঝখান দিয়ে গেছে একটি জলপ্রবাহ, পাথর দিয়ে ঢাকা, ওটি তুঙ্গভদ্রা নদীর প্রবাহ। প্রাঙ্গনের পশ্চিমদিকে রয়েছে একটি শীর্ষ স্তম্ভ, নাম ‘রায়া’ স্তম্ভ। কৃষ্ণদেব রায়ের স্মৃতিতে এটি তৈরি হয়েছিল। এই স্তম্ভ পেরিয়ে আরেকটু ভেতরে ঢুকলেই দেখতে পাওয়া যায় ধ্বজা স্তম্ভ,দীপ স্তম্ভ। বাঁদিকে পাতালেশ্বর নরসিংহ মূর্তি এবং সূর্য নারায়ণের মন্দির, ডানদিকে লক্ষীনারায়ণ এবং মহিষাসুরমর্দিনী মন্দির। তার ঠিক বিপরীতে বিরুপাক্ষ মন্দির।
বিরুপাক্ষ মন্দিরের আরেক নাম পম্পাপতি মন্দির। মন্দিরের দরজায়, ভিতরের ছাদে অসাধারণ সব কারুকার্য রয়েছে। বিরুপাক্ষকে পম্পাপতি বলা হয়, কেননা পম্পাদেবী এই স্থানে বসে শিবের তপস্যা করেছিলেন এবং তার ধ্যানে তুষ্ট হয়ে শিব এখানে শিবলিঙ্গ হিসেবে প্রকট হন। সেইজন্য অনেকে এই স্থানটিকে পম্পাক্ষেত্র বলেন। বিরুপাক্ষ মন্দিরের উত্তরে পম্পাদেবী, ভুবনেশ্বরী দেবীর মন্দির। পম্পাদেবী মন্দিরের বাঁদিকে নবগ্রহ মন্দির। মন্দিরের উত্তর পাশে কনকগিরি গোপুরা, এরই বাঁদিকে মন্মত পুষ্করিণী। এদিক থেকে মন্দিরে প্রবেশ করবার সময় চতুর্থ ধাপে উঠলে ডান দিকে একটি ঘর। সেই ঘরের পুব দিকের একটি ছোট ছিদ্রপথে সূর্যালোক প্রবেশ করলে পিনহোল ক্যামেরার নিয়ম অনুসারে বিপরীত দেওয়ালে বিস্তপ্পা স্তম্ভের উল্টানো ছবি ওঠে। আরো খানিকটা উঠলে বিদ্যারণ্য মন্দির। মন্দিরের সামনে থেকে দূরে তাকালেই চোখে পড়বে মাতঙ্গ পর্বত। সেখানে রয়েছে নন্দীর মূর্তি, যেমন সব শিবমূর্তির সামনে থাকে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলেছেন এই স্থাপত্যটি চালুক্য বংশের সময়কার
।
মাতঙ্গ পর্বত থেকে পশ্চিমে দেখা যায় মন্দির আর উত্তরে তুঙ্গভদ্রা নদী, দক্ষিণে হাতিশালা।হাম্পি থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখবার জন্য এটি একটি অনবদ্য স্থান। মাতঙ্গ পর্বত হাম্পি দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান,কেননা এখান থেকে একদিকে বিরুপাক্ষ মন্দির অন্যদিকে তুঙ্গভদ্রা নদী, রাম মন্দির, বীরভদ্র মন্দির দেখা যায়। এককথায় হাম্পি শহরের ল্যান্ডস্কেপ দেখবার অসাধারণ এক পয়েন্টো বটে। এই পর্বতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রামায়ণের কাহিনি, কথিত আছে কিস্কিন্ধার রাজা সুগ্রীব এই পর্বতে লুকিয়ে ছিলেন।
ক্রমশ: