পশ্চিম হিমালয়ের প্রায় ৮০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এক উপত্যকা। তুষারাচ্ছাদিত সব পর্বতশৃঙ্গ চতুর্দিকে। পাহাড়ের উপর দিকে তুষার চিতা, হিমালয়ের বাদামী ভাল্লুক দেখা যায়। মধ্য এশিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রলম্বিত রেশম পথের অংশ গুরেজ উপত্যকা বছরের অর্ধেক সময় অগম্য হয়ে ওঠে জমে বরফের কারণে। ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত ঘেঁষা গুরেজ উপত্যকার একদিক দিয়ে সমান্তরাল ভাবে চলে গেছে নিয়ন্ত্রণ রেখা (লাইন অব কন্ট্রোল)। তার দু’পাশে দিবানিশি সতর্ক সেনা প্রহারা। নিয়ন্ত্রণ রেখার অন্যদিকে পাকিস্তানের সব পাহাড়। সেখানে ওৎ পেতে থাকে পাক সেনারা। এই পরিবেশের মধ্যেই চলতে থাকে জীবনের প্রবাহ। পর্বতবেষ্টীত উপত্যকায় গ্রীষ্মে চাষ হয়, পশুপালন হয়। তখন ঝলমল করে ওঠে গোটা উপত্যকা। নদী, ঝর্ণা, বাগিচা, অরণ্য, পাহাড়, পাখি, ফুল, আঞ্চলিক সংস্কৃতি, মানুষ, সবমিলিয়ে গ্রীষ্মের গুরেজে উৎসবের মেজাজ। উত্তর কাশ্মীরে ভারত-পাকিস্তান সিমান্ত ঘেঁষা গুরেজ শ্রীনগর থেকে ১২৩ কিলোমিটার।
পূর্বাপর
১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পর থেকেই কাশ্মীরের অধিকার নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের পরিণতিতে ১৯৪৯-এ ভাগ হল কাশ্মীর। গুরেজ উপত্যকা পড়ল ভারতের অন্তর্গত কাশ্মীরে। তাতেও কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক সমস্যার নিরসন হয়নি। গোলাবারুদ আর সেনা জওয়ানদের ভারী বুটের আওয়াজে বারবার কেঁপে উঠেছে উপত্যকা। ২০০৭ সাল পর্যন্ত পর্যটকদের গুরেজ উপত্যকায় যাওয়ার অনুমতি ছিল না। ২০০৭-এর পর থেকে পর্যটকরা গুরেজ যাচ্ছেন। এর একটা ফল হয়েছে এই যে, গুরেজ ভ্যালির মানুষজন পর্যটন অর্থনীতির স্বাদ পাচ্ছেন। উপত্যকায় পর্যটকদের পদার্পণ ঘটলে তাঁরা খুশি হন। সামরিক জওয়ানরাও খুশি হন বাইরের লোকের দেখা পেয়ে। সময়-সুযোগ পেলে গল্প জোড়েন। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
কেন যাবেন গুরেজে
ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৫২ বছর আগে ব্রিটিশ লেখক স্যর ওয়াল্টার লরেন্স গুরেজ উপত্যকায় গিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, কাশ্মীরের অসাধারণ সুন্দর জায়গাগুলির মধ্যে গুরেজ একটি। সুউচ্চ সব পাহাড়ে ঘেরা গুরেজ ভ্যালির মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত কিষেণগঙ্গা নদীর কলধ্বনি
গুরেজের ওই পরিবেশে যেন স্বর্গীয় সুরলহরী। স্যর লরেন্স জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, গুরেজ উপতক্যাক একসময় কাশ্মীরের বিশিষ্ট পর্যটন ঠিকানা হয়ে উঠবে।
ভূস্বর্গের সব রুপ রস গন্ধ বর্ণের ডালি নিয়ে গুরেজ পর্যটকদের জন্য অপেক্ষায় থাকে এখন। যদি সন্ত্রাসের কথা বলেন তবে বলা যেতে পারে, কাশ্মীরের অনেক জায়গা যখন সন্ত্রাসকবলিত, তখনও গুরেজ শান্ত থেকেছে সাম্প্রতিককালে। উপত্যকার মানুষজন শান্তিপ্রিয়। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি হওয়ায় গুরেজ উপত্যকা অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তপোক্ত।
নিষ্কলুষ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য তো বটেই, হিমালয়ের কোলে পাকিস্তানের সীমানা লাগোয়া এক উপত্যকার মানুষের জীবনচর্চার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। প্রধাণত দার্দ জনজাতির মানুষের বসবাস গুরেজে। শিনা ভাষায় কথা বলেন তাঁরা। গুরেজের বর্তমান দার্দদের পূর্বপুরুষেরা এসেছিলেন অধুনা পাকিস্তানের অন্তর্গত গিলগিট উপত্যকা থেকে। দার্দ সম্রাট ইউসুফ শাহ চক গুরেজ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে কাশ্মীরে আসার পর সম্রাট আকবর তাঁকে বন্দি করেছিলেন। কথিত আছে, ইউসুফ শাহ চক গ্রেপ্তার হওয়ার পরে তাঁর প্রেয়সী হাব্বা খাতুন মনের দুঃখে গুরেজ উপত্যকার একটি পাহাড়ের পদদেশে আনমনা হয়ে ঘুরে বেড়াতেন। পাহাড়টি এখন হাব্বা খাতুন পাহাড় নামে খ্যাত। হাব্বা খাতুন কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন সেই আমলে।
দুই যুযুধান দেশের বিপজ্জনক সীমান্ত, কাঁটাতারের বেড়া, সেনা কনভয়; এ সব ছাপিয়ে আপনি পৌঁছাবেন এক আশ্চর্য করা অচিনপুরে। সেখানে গাঢ় সবুজ ঘাসের কার্পেটের ওপর দিয়ে বয়ে চলে ঝর্ণা। কিষেণগঙ্গা নদী অনেক ইতিহাসের সাক্ষী অচেনা সব বুনো ফুলের ঝাড়। ছোট ছোট আলুর ক্ষেত। জানালায় উঁকি দেওয়া শিশুর লাজুক হাসিমুখ। কাঁটাতারের বেড়ার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখি। চাইলে কিষেণগঙ্গায় ছিপ ফেলে ট্রাউট মাছ ধরা যায়। কিষেণগঙ্গার তীরেই ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা হতে পারে। গুরেজ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অপূর্ব সুন্দর তিলেল গ্রাম। কাঠের গুড়ি দিয়ে তৈরি বাড়িঘর। পাহাড়-ঢালের ফার, পাইনের জঙ্গলের সঙ্গে তালমিল রেখেই যেন তৈরি হয়েছে বাড়িগুলো।
যাওয়ার পথ
প্রথমে আপনাকে পৌঁছে যেতে হবে শ্রীনগর। শ্রীনগর থেকে প্রাইভেট ট্যাক্সি ভাড়া করতে হবে। গুরেজে পর্যটকদের জন্য থাকার ব্যবস্থা রয়েছে দওয়ারে। শ্রীনগর থেকে সুমবল, ব্রার, বন্দিপুর, রাজদান পাস, কাজালওয়ান, ওয়ামপুর হয়ে দওয়ার যাওয়ার পথ। রাস্তার পরিস্থিতি অনুযায়ী সময় লাগবে ৬-৮ ঘন্টা। দূরত্ব ও ট্যাক্সির সাধারণ রেট অনুসারে ভাড়া হতে পারে ৩০০০-৩৫০০০ টাকা। তবে পথের কিছু কিছু অংশ খারাপ হওয়ায় ৫০০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া চাওয়া হতে পারে। কম খরচে যেতে চাইলে দু’দফায় ভেঙ্গে যাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে শ্রীনগরের বাতমুল্লা থেকে বন্দিপোরা (দেড় ঘন্টা) এবং বন্দিপোরা থেকে গুরেজ (সাড়ে ৪ ঘন্টা) যাওয়ার শেয়ার গাড়ি ধরা যেতে পারে। গুরেজ দুটি তহসিলে বিভক্ত। দওয়ার ও তিলেল বা তুলেল। দওয়ার থেকে বারনোই, পুরানা তিলেল, সেখপুরা, দুকার, বাদুগাম হয়ে ঢুকে পড়া যায় গুরেজ উপত্যকার অভ্যন্তরে। সঙ্গে গাইড থাকলে ভালো হয়।
দওয়ারে থাকার ব্যবস্থা
কাকা প্যলেস গেস্ট হাউস, ফোনঃ ০৯৪১৯৬-০০০২৭, ০১৯৫৭-২৫৫২৩২। দি উড ভাইভস, ফোনঃ ০৭৮৮৯৭-০৫৮৮৭। গুরেজ রিট্রিট,ফোনঃ ০৬০০৫৪-৩৩১৭৫।
প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন কাশ্মীর পর্যটনের কলকাতা অফিসে। ঠিকানাঃ ১২, জওহরলাল নেহরু রোড, এসপ্ল্যানেড, কলকাতা-৭০০০১৩। ফোনঃ ০৩৩-২২২৮-৫৭৯১।
কাশ্মীরে দীর্ঘদিন ধরে পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তপন মুখোপাধ্যায়। পর্যটকদের সঙ্গে নিয়ে অনেকবার গেছেন গুরেজ ভ্যালিতে। পরামর্শের জন্য তপনবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন এই নম্বরেঃ৬২৯০৩-৬৩০৪১। তপনবাবুর আফিস শ্রীনগরে।
ফটোঃ তপন মুখোপাধ্যায় (শ্রীনগর, জম্মু-কাশ্মীর)।