সহস্রাধিক বছরের প্রাচীন পুজো। বঙ্গের প্রাচীনতম দুর্গোৎসব। দেবী পূজিত হন মৃন্ময়ী নাম ও রূপে। দেবী মৃন্ময়ী দেবী দুর্গারই আরেক রূপ। সেদিক থেকে দেখতে হলে সারা দেশ তথা বিশ্বের প্রাচীনতম ধারাবাহিক ভাবে চলতে থাকা দুর্গাপুজো। বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে দলমাদল পাড়ায় দেবী মৃন্ময়ী মন্দিরে আয়োজিত হয় এ পুজো। সপ্তমীর ১৪ দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায় পুজোর প্রক্রিয়া। এ বারও হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী সেই পুজোর কথা জানাচ্ছেন শেষ মল্ল রাজা কালিপদ সিংহ ঠাকুরের পৌত্র জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ ঠাকুর।
সঠিক হিসেবে এই ২০২৩ সালে বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের দুর্গোৎসব ১০২৭ তম বছরে পদার্পণ করল। কত মোড় ঘোরানো ঘটানা ঘটে গিয়েছে এই পৃথিবীতে গত হাজার বছরে। বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের দুর্গোৎসব অব্যাহত থেকেছে। দেবী দুর্গাই দেবী মৃন্ময়ী নামে পূজিত হন এখানে।
মৃন্ময়ী মন্দিরের শারদোৎসব উপলক্ষে জাগ্রত হয় মল্লভূমের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও গরিমা। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন পুজো দেখতে। আসেন বিদেশীরাও। নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সহস্রাধিক বছর ধরে লালিত ধর্মীয়-সংস্কৃতির সাক্ষী থাকতে আসেন। জাঁকজমকের চেয়ে এ পুজোয় বেশি প্রাধান্য পায় ঐতিহ্যমণ্ডিত আচার-অনুষ্ঠান, যার পরতে পরতে যুক্ত হয়ে থাকে প্রাচীন বাংলার লোক-সংস্কৃতি। যেমন, মহামারীমুক্ত জীবনের জন্য থাকে পুজো। সামগ্রিক পূজা-প্রক্রিয়ার অন্তুর্গত এই পূজাটি। এক সময় মহামারীর আকারে নানা রোগে উজাড় হয়ে যেত গ্রামের পর গ্রাম। মহামারী এখনও হয়। কোভিড আক্রমণে ত্রস্ত পৃথিবী সবে হাঁপ ছেড়েছে। মহামারীনাশক পূজাকে একটি সমবেত প্রার্থনা বলা চলে। মানুষ সতর্ক ও সাবধানীও হতো পুজোপার্বণের মধ্যে দিয়ে।
রাজা জগৎ মল্ল মৃন্ময়ী মন্দির স্থাপন করেন ৯৯৭ সালে। এটিই বিষ্ণুপুরের সবচেয়ে পুরনো মন্দির। মা মৃন্ময়ী রূপে শরতে দেবী দুর্গার পূজা শুরু হয় মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। সেই ধারা চলছে। প্রসঙ্গত, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও মা সারদা মৃন্ময়ী মন্দিরে এসেছিলেন।
প্রসঙ্গত, মল্ল বংশের মূল খুঁজতে হলে রাজস্থানের প্রসঙ্গ আসবেই। মহারানা প্রতাপ ও মল্ল বংশের গোত্র এক। প্রথম মল্লরা বাংলায় এসেছিলেন রাজস্থান থেকে। মল্ল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আদি মল্ল। সে ৬৯৪ সালের কথা। প্রথম রাজধানী বাঁকুড়ার লাউগ্রাম। আদি মল্লের পুত্র জয় মল্ল রাজধানী স্থানান্তরিত করেন বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে। বাড়তে থাকে মল্লরাজাদের শাসনাধীন এলাকা। ক্রমশ মল্লভূম প্রসারিত হয় সমগ্র বাঁকুড়া, বীরভূম মেদিনীপুর পুরুলিয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ-সহ গোটা রাঢ়বঙ্গে। পশ্চিমে ছুঁয়ে ফেলেছিল ছোটনাগপুর মালভূমিকে। মধ্যযুগে মল্লভূম হয়ে উঠেছিল বাংলার এক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। মল্ল রাজবংশের ৪৯ তম রাজা বীর হাম্বিরের সময়ে মল্লভূমি এবং বিষ্ণুপুর উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিল।
১৬২২ থেকে ১৭৫৮ সালের মধ্যে বিষ্ণুপুরে টেরাকোটা শৈলীতে তৈরি মন্দিরগুলির খ্যাতি বিশ্বজোড়া। বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব রয়েছে মন্দিরগুলির গড়ে ওঠার পিছনে। বিষ্ণুপুরের জোরবাংলা মন্দির, শ্যামরাই মন্দির, রাসমঞ্চের মতো স্থাপত্য এখনো মানুষকে বিস্মিত করে চলেছে। বিষ্ণুপুরে টেরাকোটা শৈলীতে তৈরি আরও অনেক মন্দির রয়েছে ।
বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির হস্তশিল্প সামগ্রী, বালুচরী শাড়ির কদর দেশে-বিদেশে। বাংলার ধ্রুপদ সংস্কৃতির বিকাশে বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীতের ভূমিকাও কম কিছু নয়। এই ঘরানারও উদ্ভব মল্ল রাজাদের আমলে। বিষ্ণুপুর বাংলার একটি বিশিষ্ট পর্যটন কেন্দ্রও বটে।
যাইহোক, মৃন্ময়ী মন্দিরের পুজোর কথায় ফেরা যাক। পুজোর আয়োজন করে থাকেন একদা মল্ল রাজপরিবারের বর্তমান সদস্যরা। আপাত দেখনদারির কোনও প্রচেষ্টা থাকে না এ পুজোয়। ফল্গুর মতো বইতে থাকে বহু মানুষের শুভ কামনা। বংশ পরম্পরায় নানা সম্প্রদায়ের মানুষ পুজোর নানা আচরণের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।
এখানকার পুজো-অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায় সপ্তমীর ১৪ দন আগে থেকে। আরব্রা নক্ষত্রযুক্ত কৃষ্ণনবমীর দিন পুজোর সূচনা ঘটে। সুদীর্ঘ পুজো-ঐতিহ্য, প্রচলিত নানা আচার মেনে দশমী পর্যন্ত চলতে থাকে পুজোর পর্ব। সেই আদি মন্দির আর নেই। নতুন করে মন্দির তৈরি হয়েছে। যতদূর জানা যায়, এই ১০২৭ বছরে মৃন্ময়ী মন্দিরের বাৎসরিক দুর্গোৎসবে ছেদ পড়েনি। পুজোর আচারের মধ্যে ইতিহাসের অনেক উপাদানও খুঁজে পাওয়া যাবে।
পুজো হয় মা মৃন্ময়ী, বড় ঠাকুরানী তথা মহাকালী, মেজ ঠাকুরানী বা মহাসরস্বতী, ছোট ঠাকুরানী তথা মহালক্ষী এবং অষ্টধাতুর বিশালাক্ষী দেবীর। দেবী বিশালাক্ষী অষ্টাদশভূজা। বড় ঠাকুরানী, মেজ ঠাকুরানী এবং ছোট ঠাকুরানীর পটচিত্র পূজিত হয়। পটচিত্রের বিসর্জন হয়। দেবী মৃন্ময়ী মূর্তির বিসর্জন হয় না।
ওই যে আচারের কথা বলেছি, তার নানা রকমফের। একটা উদাহরণ দিই, পুজোর বিশেষ বিশেষ ক্ষণে কামান দাগা হয়। এ প্রথার কারণের একটি দিক হল শব্দ-ব্রক্ষ্মকে স্মরণ করা। আরেকটি দিক, অতীতে পুজোর পর্ব সম্পর্কে দূরবর্তী মানুষকে অবহিত করা হত কামান দেগে। প্রথাটি চলছে। কামান দাগার কাজটি করে বিষ্ণুপুরের বাঁকা গ্রামের মহাদণ্ড পরিবারের সদস্যরা।
নানা কথা, নানা কাহিনি, নানা আচার, নানা প্রথা আর অসংখ্য মানষের শুভেচ্ছা আবর্তিত হয়ে চলেছে এ পুজোকে কেন্দ্র করে। বিসর্জনে উড়িয়ে দেওয়া হয় নীলকণ্ঠ পাখি।
ছবিঃ লেখক।
বিষ্ণুপুর ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্যের জন্য পড়তে পারেন ‘মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর’ লেখাটি, নীচের লিঙ্কে