তোর্সা ডট ইন প্রতিবেদনঃ নদিয়া জেলা আর পূর্ব বর্ধমানের সীমান্ত অঞ্চল। এখানে ভাগীরথী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে অজয় নদ। সেই সঙ্গমস্থলের কাছে বেশ কিছু বছর ধরে গড়ে উঠেছে বিশাল এক চর। তা এখন পরিচিত নয়াচর নামে। চরের উর্বর মাটিতে জেগেছে সবুজের রাজ্যপাট। কালে কালে জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে নতুন চর। বেড়াতে যাওয়া যায়। থাকা যায় নদীচরে প্রকৃতির সঙ্গে মানানসই শান্ত, সুন্দর এক হোমস্টেতে। নৌকায় চড়ে ভাগীরথী-অজয় সঙ্গমে গাঙ্গেয় ডলফিন দেখতে যাওয়া যায়। সে এক অন্যরকমের ভ্রমণ। হাওড়া-কাটোয়া রেলপথে দাঁইহাট স্টেশন থেকে এই নয়াচর ৫ কিলোমিটার। কাটোয়া স্টেশন থেকেও নয়াচর যাওয়ার টোটো পাওয়া যায়। মিনিট ২০ সময় লাগে।

নয়াচরের কথা বলতে গেলে স্থানীয় এক যুবকের কথা উঠবেই। নাম গণেশ চৌধুরী। বর্ধমানের সীমানা ঘেঁষা নদিয়ার বাসিন্দা। বন্যপ্রাণ, গাছপালার প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল শৈশব থেকেই। সঙ্গে ছিল প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণ পর্যবেক্ষণে প্রবল আগ্রহ। সেটা চর্চায় পরিণত হয় শৈশবেই। বড় হয়ে ফটোগ্রাফির পাঠ নিয়েছেন। গণেশবাবু জানাচ্ছেন, “২০ বছর ধরে কাজ করে চলেছি এই নয়াচরে। ভাগীরথীর বুকে জেগে ওঠা চরায় প্রাকৃতিক ভাবে জন্ম নেওয়া নানা উদ্ভিদ, পাখি, কীট-পতঙ্গ, ভোঁদড়, এদের দেখতে দেখতে আমার শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণ ঘটেছে। সেইসব পশুপাখি কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়, কীভাবে তাদের সংখ্যা বাড়ানো যায় তা নিয়ে ভাবতাম অনেক আগে থেকেই। এখন সেটা একটা লড়াই হয়ে উঠেছে। লড়াইটা চলছে।”
ভাগীরথী-অজয়ের ওই সঙ্গমের কোথায়, কখন গাঙ্গেয় ডলফিনের ডিগবাজি দেখা যেতে পারে তা গণেশবাবু দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় খুব ভালো জানেন। গণেশ চৌধুরীর তোলা ‘দি লাস্ট স্ট্যান্ড’ নামের জল থেকে একটি ডলফিনের আকাশমুখী উড়ানের একটি ফটো ২০২০ সালে ‘আ্যানিম্যাল পোট্রেটস ক্যাটেগরি’-তে ‘নেচার ইনফোকাস ফটোগ্রাফি’ পুরষ্কার জিতে নিয়েছিল। কাঁধ সমান জলে দাঁড়িয়ে ভারী ক্যামেরা হাতে চার ঘন্টা অপেক্ষার পরে ছবিটি তুলতে পারা গিয়েছিল বলে গণেশবাবু জানালেন। বিপন্ন গাঙ্গেয় ডলফিন বাঁচানোর জন্য গণেশবাবুর তাগিদটাও অমনই ধৈর্যশীল।

গঙ্গা আর অজয় নদের সঙ্গমে গণেশ চৌধুরীর তোলা সেই পুরষ্কৃত ছবিটি।
কাজের পরিসর বেড়েছে। কাজ বেড়েছে। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়েছেন গণেশবাবুরা। নাম’ওয়াইল্ড রিঅ্যাকশন’। সঙ্গে রয়েছেন আরেক প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ অর্চন মিত্র ও গণশবাবুর ভাই রাজেন্দ্র চৌধুরী। সংগঠনের মূল লক্ষ্য বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ ও বন্যপ্রাণ নিয়ে গবেষণা। নয়াচরে ওয়াইল্ড রিঅ্যাকশন-এর নেচার ইকো ভিলেজে থাকার চমৎকার ব্যবস্থা। আনাবিল প্রকৃতির মধ্যে হোমস্টেটি। নদী, নদীচর, পাখি, নদীতে নৌকা বেয়ে ডলফিন দেখতে যাওয়ার অভিযান, খাওয়ার পাতে হোমস্টের বাগানে ফলানো নানা সবজি ও নদীর তাজা মাছের নানা পদের উপস্থিতি, আহা, সবমিলিয়ে সে বাস্তবিকই এক অন্যরকমের অভিজ্ঞতা।
রাতের নদীচর, কীট-পতঙ্গ সৃষ্ট চেনা-অচেনা শব্দাবলী এক অন্য রকমের আবহ তৈরি করে। চাঁদনি রাতে নদীর বুকে ভেসে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সত্যিই মনে রাখার মতো।
অর্চন মিত্র জানাচ্ছেন, “প্রকৃতির সান্নিধ্য যাঁরা ভালোবাসেন, সেই সান্নিধ্যের আনন্দ যাঁরা উপলব্ধি করেন, তাঁরা নয়াচরে এসে আনন্দ পাবেন, শান্তিও পাবেন।”

পিকনিক সম্পর্কে আমাদের যে সাধারণ ধারণা, যেমন, উচ্চস্বরে বক্স বাজানো, প্রবল হৈ চৈ, সে-সব এখানে বড় বেমানান। বরং নয়াচরের প্রকৃতি, নৌকাভ্রমণ উপভোগ করুন, নিজের হাতে বাগান থেকে সবজি তুলুন। বাচ্চারা পাখি, প্রজাপতি চিনবে, পাখির বাসা তৈরি করা শিখবে, ডলফিন দেখে উল্লসিত হবে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা দলবেঁধে নয়াচরে শিক্ষামূলক ভ্রমণে এলে তাদের জন্য থাকা-খাওয়ার খরচে কিছুটা ছাড়ের ব্যবস্থা রয়েছে বলে গণেশবাবু জানালেন।

প্রকৃতির মধ্যে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন।
যাওয়ার পথ
ট্রেনে এলে হাওড়া থেকে কাটোয়ার পথে দাঁইহাটা স্টেশনে নামবেন। ওখান থেকে টোটো পাবেন নয়াচরে পৌঁছানোর জন্য। দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। কাটোয়া স্টেশনে নেমেও টোটোতে নয়াচরে আসা যেতে পারে। সড়কপথে কলকাতা থেকে নয়াচর ১৫৪ কিলোমিটার। বর্ধমান থেকে কাটোয়া এসে পানুঘাটের রাস্তা ধরতে হবে। পানুঘাট, চরপাতাইয়া হাট হয়ে নয়াচরে আসবেন। চরপাতাইয়াহাট থেকে নয়াচরের হোমস্টে ৫ কিলোমিটার।
হোমস্টের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরঃ ৯৭৩৪৮-৪৫৪৭৭।
ফটো সৌজন্যঃ গণেশ চৌধুরী ও ওয়াইল্ড রিঅ্যাকশন।






