৭০০০ ফুট উচ্চতায় গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় রেড পান্ডা। রাজকীয় চালে পদচারণা করে তুষার চিতা। ব্ল্যাক প্যান্থারের চাহনি চট করে ভোলবার নয়। যে চিতার গায়ের রংটি সুদূরের ডাক দিয়ে যায়, সে ক্লাউডেড লেপার্ড। মেঘলা রং তার, তাই এমন নাম। চিতা প্রজাতির বিড়ালের ডাক শুনতে হলে কান পেতে থাকতে হবে। হিমালয়ের কালিজ ফেজান্ট, গোল্ডেন ফেজান্ট, সিলভার ফেজান্ট, আহা, সে কী রংবাহার। দার্জিলিং বেড়াতে গেলে একদিন যেতেই হবে এই চিড়িয়াখানায়।
দার্জিলিংয়ের বার্চ হিল তথা জওহর পর্বতের ৭০০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের কোলে ৬৭ একর এলাকা জুড়ে এই দার্জিলিং চিড়িয়াখানা দেশজুড়ে মোট ১৫০টি চিড়িয়াখানার মধ্যে নানা মাপকাঠির বিচারে শ্রেষ্ঠ চিড়িয়াখানার শিরোপাটি অধিকার করেছে গত বছর। ২০২২-এর ১০ সেপ্টেম্বর ভুবনেশ্বরে আয়োজিত একটি সম্মেলনে সেন্ট্রাল জু অথরিটির পক্ষ থেকে দেশের চিড়িয়াখানাগুলির মান-ভিত্তিক একটি তালিকা ঘোষণা করা হয়। সেই তালিকার প্রথমেই রয়েছে দার্জিলিং চিড়িয়াখানা তথা পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্কের নাম।
রেড পান্ডা, তুষার চিতা, টিবেটান উলফ, ক্লাউডেড লেপার্ড ছাড়াও ইয়াক, হিমালয়ান থর, হিমালয়ের ভাল্লুক, গোরাল, কাকর হরিণ (বার্কিং ডিয়ার), কস্তুরী হরিণ-সহ আরও নানা পাহাড়ি প্রাণী দার্জিলিং চিড়িয়াখানার বাসিন্দা। জার্মানির বার্লিন চিড়িয়াখানা থেকে এসেছে পাঁচটি মিসমি টাকিন। এক প্রকারের পাহাড়ি ছাগল টাকিন। ভুটানের জাতীয় প্রাণী এই টাকিন। তাদেরই একটি উপগোষ্ঠী মিসমি টাকিন।
সেন্ট্রাল জু অথরিটির ওই তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চেন্নাইয়ের আরিগনার আন্না জুলজিক্যাল পার্ক, তৃতীয় স্থানে কর্নাটকের মহীশূরের চমারাজেন্দ্র জুলজিক্যাল গার্ডেনস। কলকাতা চিড়িয়াখানার স্থান চতুর্থ। ১৯১৪-য় ভারতের প্রথম চিড়িয়াখানা হিসেবে এই দার্জিলিং চিড়িয়াখানা বিশ্বের ৩০০ নামী চিড়িয়াখানার মধ্যে থেকে বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক পুরষ্কার ‘দি আর্থ হিরোজ’ জিতে নিয়েছিল।
হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্কের সরকারি প্রতিষ্ঠা দিবস ১৯৫৮ সালের ১৪ অগস্ট। প্রথম ডিরেক্টর এক বাঙালি। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসের দিলীপ কুমার দে। দার্জিলিং চিড়িয়াখানা গড়ে তোলার ব্যাপারে তাঁর অবদান স্মরণযোগ্য। ১৯৭৫-এ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত রাজ্যপাল পদ্মজা নাইডুর স্মৃতিতে চিড়িয়াখানার নতুন নামকরণ করেন ‘পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক’। লোকমুখে দার্জিলিং চিড়িয়াখানা নামটিই প্রচলিত।
শুধু জীবজন্তুই নয়, চিড়িয়াখানা চত্বরের গাছপালাও বিশিষ্টতার দাবি রাখে। নানা প্রজাতির অর্কিড, বার্চ, অল্ডার, প্রাচীণ সব ওক সহ পূর্ব হিমালয়ের নানা গাছগাছালির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে এখানে।
পায়ে পায়ে বেড়িয়ে আসা
দার্জিলিং মলের পশ্চিম প্রান্তে কবি ভানুভক্তের মূর্তি। মূর্তিটির মুখোমুখি দাঁড়ালে ডানে-বাঁয়ে দুটি রাস্তা দেখা যাবে। মল থেকে যে-কোনও একটি রাস্তা ধরে রাজভবনের পাশ দিয়ে ফের আরেকটি রাস্তা ধরে মল চত্বরে ফিরে আসা যায়। ওটা মল রোড। পথে পড়বে মহাকাল মন্দিরে ওঠার সিঁড়িপথ। কিছু সিঁড়ি বেয়ে মন্দির চত্বরে উঠে আসতে হবে। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে এই পাহাড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার চমৎকার দৃশ্য চোখে পড়বে।
ভানুভক্তের মূর্তির মুখোমুখি দাঁড়ালে মল থেকে আপনার অবস্থান থেকে বাঁ-দিকের রাস্তাটি ধরে সোজা হেঁটে চলুন। জওহর রোডের মসৃণ ওই পথটি ধরে হাঁটতে ভালো লাগবে। মল থেকে ওই পথটি ধরে দার্জিলিং চিড়িয়াখানায় পৌছানো যায় আধ ঘন্টায়।
অন্যথায় চকবাজার থেকে ট্যাক্সিতে লেবং কার্ট রোড ধরে চিড়িয়াখানায় পৌঁছাতে হবে। চকবাজার থেকে মিনিট ১৫ সময় লাগে গাড়িতে। রাস্তার পাশে যেখানে গাড়ি দাঁড়াবে সেখান থেকে কয়েকটি সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে হয় চিড়িয়াখানার প্রবেশদ্বারে।
মল থেকে সোজা চিড়িয়াখানা হেঁটে যাওয়াই শ্রেয়, একান্ত অপারগ না হলে। ওই রাস্তায় মলের দিক থেকে প্রথমে পড়বে দার্জিলিং রাজভবন। ব্রিটিশ আমলে গ্রীষ্মে বাংলার বড়লাটেরা দার্জিলিংয়ের গভর্নর প্যালেসে এসে থাকতেন। বড়লাট লর্ড অ্যাসলের আমলে, ১৮৭৭ সালে কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের কাছ থেকে প্রাসদোপম বাড়িটি কেনে ইংরেজরা। তারপর রূপবদল করা হয় প্রাসাদটির। মহারাজ ও তাঁর পরিবারবর্গ গরমে এখানে এসে থাকতেন। এবং এখনো পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালেরা গ্রীষ্মে কিছুদিন কাটিয়ে আসেন দার্জিলিংয়ের রাজভবনে।
তারপর হলুদ রঙের গথিক স্থাপত্যশৈলীর সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চ। যেন বিদেশী কোনও সিনেমা থেকে উঠে আসা ছবির এক দৃশ্য স্থির হয়ে আছে। প্রতিষ্ঠা ১৮৪৪ সালে। ভয়ঙ্কর ভূকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল চার্চের ইমারতটি। অনেকটাই নতুন করে গড়া হয়। তবে স্থাপত্যে গথিক স্টাইলটা বজায় রাখা হয়েছে।
তারপর শ্রাবারি পার্ক বা নাইটেঙ্গল পার্ক। দিনে পার্ক থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য বড় রোমান্টিক। একসময়ে অনেক বলিউড সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে এখানে। বেড়ানোর মরসুমে সন্ধ্যার দিকটায় পার্ক সাজে রঙিন আলোয়। বসে আঞ্চলিক নাচ-গানের আসর। অতীতে আঞ্চলিক ইংরেজ মহিলারা লতাগুল্মের নানা ফুলে উদ্ভাসিত জায়গাটিতে আসতেন আড্ডা দিতে। সে বিংশ শতকের প্রথম দিকের কথা। মল থেকে চিড়িখানায় যাওয়ার পথের মাঝামাঝি জায়গায় পার্কের অবস্থান। দেখে নিতে পারেন লয়েড বোটানিক্যাল গার্ডেন।
আর চিড়িয়াখানা চত্বরের সঙ্গে লাগোয়া হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট এ পথের শেষে একটি বড় প্রাপ্তি। প্রতিষ্ঠা ১৯৫৪-য়। আগের বছরে, অর্থাৎ ১৯৫৩-য় এভারেস্ট শীর্ষে পৌঁছে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তেনজিং নোরগে ও এডমন্ড হিলারি। ইনস্টিটিউটের প্রথম ফিল্ড ট্রেনিং ডিরেক্টর ছিলেন তেনজিং নোরগে। পর্বতারোহণে আগ্রহীরা তো বটেই, যাঁদের এ ব্যাপারে তেমন আগ্রহ নেই তাঁরাও প্রতিষ্ঠানের সংগ্রহশালাটি ঘুরে দেখলে কৌতূহলী হবেন।
যে জুতো পরে তেনজিং নোরগে ও এডমন্ড হিলারি মাউন্ট এভারেস্টে পৌঁছেছিলেন তা আজকের দিনের পর্বতারোহণে ব্যবহৃত জুতোর সঙ্গে তুলনা করলে আঁতকে উঠতে হবে। বিখ্যাত পর্বতারোহীদের ব্যবহার করা নানা সরঞ্জাম, গুরুত্বপূর্ণ নানা ছবি ও নথি দেখা যায় এখানে।
যাইহোক, ফেরা যাক পথের কথায়। যাঁরা গাড়িতে চিড়িখানা ও হিমালয়ান মান্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট বেড়াতে যাবেন বা বেড়িয়ে ফিরবেন, তাঁরা যাতায়াতের পথে বিখ্যাত হ্যাপি ভ্যালি এস্টেটের চায়ের বাগান ও টিবেটান রিফিউজি সেন্টার বেড়িয়ে আসতে পারেন। চিড়িয়াখানার কাছাকাছিই জায়গা দুটি।
সন্ধ্যার দিকে চিড়িয়াখানার দিক থেকে বা নাইটেঙ্গল পার্কের কোনও অনুষ্ঠান দেখে মলের দিকে ফেরার পথ থেকে দার্জিলিং শহরের আলোকপুঞ্জের নয়নাভিরাম দৃশ্যটি চাক্ষুষ করা যায়।
হেডার ছবিঃ সৌজন্য ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস।