Follow us
Search
Close this search box.

বর্ষায় সমুদ্রপারের দরিয়াপুরে

বর্ষায় সমুদ্রপারের দরিয়াপুরে

তোর্সা ডট ইন প্রতিনিধিঃ টাপুর টুপুর বৃষ্টি, রিমঝিম বৃষ্টি, সমুদ্র থেকে ঝেঁপে আসা বৃষ্টি, বর্ষার বারিধারার কত ধ্বনি। কত ছন্দ। মেঘ-রোদ্দুরের কত দৃশ্য। গাছগাছালির সংসারে ভরা বর্ষায় উৎসবের আবহ। সামনের পুকুরে নরম রোদ্দুর গায়ে মেখে অকস্মাৎ লাফিয়ে ওঠে রুপোলি মাছ। মন্দিরে ঘন্টা বাজে। বন্দরে ফেরে মাছে ভরা ট্রলার। ভরা বর্ষায় ঝিকিয়ে ওঠে ইলিশ। কানাইচট্টার নিরালা সৈকতে লাল কাঁকড়াদের সংসারে এখন বর্ষাবরণের ব্যস্ততা। গ্রামের বাড়িটি এমন জায়গায়। কত যে ফলের-ফুলের গাছ। বন কুটির যেন।

‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের নবকুমার গঙ্গাসাগর থেকে ফেরার পথে নৌকার সহযাত্রীদের জন্য রান্নার কাঠ সংগ্রহের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সাগরপারের বালিয়াড়িতে নেমে পড়েছিল। ক্রমশ ঢুকে পড়ে জঙ্গলে। নানা কারণে কাঠ সংগ্রহে বিলম্ব হয়। সহযাত্রীদের ‘ধারণা’ হয় নবকুমারকে বাঘে খেয়েছে। নৌকা চালিত করার জন্য জোয়ারও এসে পড়েছিল যে। সহযাত্রীরা নবকুমারকে সেই জঙ্গলে ফেলে রেখে জোয়ারে নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছিল।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ সালে। সাহিত্য সম্রাটের দ্বিতীয় উপন্যাস এটি। প্রেক্ষাপট সমুদ্রতীরের তৎকালীন মেদিনীপুরের বালিয়াড়ি আর জঙ্গলাকীর্ণ পূর্বাংশ। বঙ্কিমচন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষ্য (‘বঙ্কিম প্রসঙ্গ’) অনুসারে, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রথম কর্মস্থল যশোহর থেকে ১৮৬০-এ বদলি হয়ে এসেছিলেন নেগুঁয়ায়। এই ‘নেগুঁয়া’ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি অঞ্চল। এখানে কয়েক মাস ছিলেন তিনি ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ প্রশাসকের পদাধিকারির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। নেগুঁয়ার কাছে দরিয়াপুর ও চাঁদপুর নামের দুটি গ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন পূর্ণচন্দ্র। সমুদ্র তীরবর্তী তৎকালীন এই অঞ্চলটি ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপটা বলে জানিয়েছেন পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এখানেই কাহিনির বননিবাসিনী কপালকুণ্ডলার সঙ্গে নবকুমারের সাক্ষাৎ ঘটেছিল।

বর্তমানে চাঁদপুর কাঁথি-১ ব্লকের অন্তর্গত একটি গ্রাম। আর কাঁথির দেশপ্রাণ ব্লকের গ্রাম দরিয়াপুর। আমাদের আলোচ্য গ্রামের বাড়িটি এই দরিয়াপুরে। এখানেই রয়েছে কপালকুণ্ডলা কালী মন্দির। পুরনো মন্দিরে বর্তমানে কোনও বিগ্রহ নেই। খোয়া গিয়েছে। পরে নতুন মন্দির তৈরি হয়েছে।

দরিয়াপুরের গ্রামে সুঘন সবুজের মধ্যে ‘মৃন্ময়ী কুটীর’। গ্রামের বাড়ির মতো পুকুর রয়েছে কুটিরের পরিসীমার মধ্যে। ডুব দিয়ে চান করা যায়। ফলের গাছ অনেক। তাই পাখি আসে। খাওয়ার ঘর থেকে ওই পুকুরে বৃষ্টি দেখতে বেশ লাগে। এখানকার সামগ্রিক পরিকাঠামো তৈরিতে বাঁশ, কাঠ, খড় ইত্যাদির মতো আঞ্চলিক উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে চমৎকার ভাবে। অতিথিদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে সুরুচি ও যত্নের সঙ্গে।

গ্রামীণ ঠিকানা। বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাগুলো তো থাকতেই হয়। ফ্রি ওয়াই-ফাই সংযোগ পাওয়া যাবে। এসি/নন এসি, উভয় প্রকার ঘরের ব্যবস্থা আছে। পুরো নাম ‘মৃন্ময়ী কুটীর ভিলেজ রিসর্ট’। কর্তৃপক্ষ যত্ন ও ভাবনার সঙ্গে পরিবেশের সঙ্গে মানানসই আতিথেয়তার পরিকাঠামো গড়েছেন। গ্রামীণ রিসর্ট কেমন হতে পারে তার একটি নমুনা পেশ করেছে মৃন্ময়ী কুটীর। প্রশংসনীয় প্রয়াস।

পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, কালিম্পংয়ের পাহাড়ে প্রচুর হোমস্টে গড়ে উঠেছে। রাজ্যের সমুদ্র তীর বরাবর সেই প্রবণতাটা দেখা যায় না। সুন্দরবনকে বাদ দিয়ে গুটিকয়েক ব্যতিক্রম রয়েছে। সম্ভাবনা কিন্তু বিস্তর। মৃণ্ময়ী কুটীর গোত্রের বিচারে হোমস্টে নয় ঠিকই। তবে সমুদ্র-সংলগ্ন একটি গ্রামে পরিবেশবান্ধব পর্যটক আবাস গড়ার ক্ষেত্রে একটি উদাহরণের মর্যাদা পেতে পারে। ঘরের বাইরেই সমুদ্র নয়। খানিক যেতে হয়। সবুজে ঘেরা মৃন্ময়ী কুটীরের অবস্থানটি গ্রামের মধ্যে। সমুদ্রের তীরে থাকার জন্য প্রচুর হোটেল আছে বাংলার বিভিন্ন সৈকতে। কিন্তু একইসঙ্গে বাংলার এক প্রাচীন গ্রামে থাকার ব্যবস্থা ও সৈকত ভ্রমণ একত্রিত হয়েছে দরিয়াপুরের মৃন্ময়ী কুটীরের ব্যবস্থাপনায়। সাহিত্যের ছোঁয়াটিও রয়েছে সেই আবাসে, মৃন্ময়ী কুটীরের ঘরগুলির নামকরণ করা হয়েছে ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের নবকুমার, কপালকুণ্ডলা প্রভৃতির মতো চরিত্রগুলির নামানুসারে। দরিয়াপুরে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত হয়।

কাছেই বাঁকিপুটের শান্ত সৈকত। মৃন্ময়ী কুটীর থেকে দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার। হাঁটতে অসুবিধা না থাকলে গ্রামের পথ ধরে সমুদ্রের কাছে চলে যান। বাঁকিপুটের কাছেই পর্যটকদের কাছে প্রায় অচেনা কানাইচট্টার সৈকত। লাল কাঁকড়ার আস্তানা এই সৈকতটি। হৈ-হট্টগোলমুক্ত সৈকত শান্তি দেবে। কাছেই মৎসবন্দর পেটুয়াঘাট। ট্রলারের সারি। মাছ ধরতে যাওয়া, মাছ ধরে ফেরা, মাছ সংরক্ষণ, সবমিলিয়ে পেটুয়াঘাট সর্বদাই ব্যস্ত। ৯৮ ফুট উচ্চতার একটি লাইটহাউস আছে দরিয়াপুরে। মৃন্ময়ী কুটীরের কাছেই। ওঠা যায় বিকেলে। লাইটহাউস থেকে চারপাশের অপরূপ দৃশ্য চাক্ষুষ করা যায়। অটোরিক্সায় এই জায়গাগুলো বেড়িয়ে নেওয়া যায়। ভাড়া ২৫০ টাকা।

জুনপুটের নিরালা সৈকতটিও কাছাকাছি। আরেকটু দূরে যেতে চাইলে দিঘা, মন্দারমণি থেকে দিনে দিনে বেড়িয়ে আসা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে বেড়াতে হবে। নিজেদের গাড়ি নিয়ে গেলে তো সুবিধা বটেই। মৃন্ময়ী কুটীরে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। টু-হুইলার সার্ভিসিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে।

কাঁথি থেকে মৃন্ময়ী কুটীরের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। কাঁথি স্টেশন বা বাস টার্মিনাস থেকে অটো পাওয়া যাবে। বলে রাখলে রিসর্ট থেকে অটোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। ভাড়া ৩৫০ টাকা। হাওড়া থেকে কাঁথি কমবেশি ১৪০ কিলোমিটার। হাওড়া থেকে কাঁথি যাওয়ার ট্রেনের অভাব নেই। সড়কপথে ধর্মতলা থেকে কাঁথি প্রায় ১৪৭ কিলোমিটার। ধর্মতলা, হাওড়া থেকে বাস আছে। দিঘাগামী বাস কাঁথি হয়ে যায়।

মৃন্ময়ী কুটীরে দিনপ্রতি থাকা-খাওয়ার খরচ মাথাপিছু ১,৬০০ টাকা (নিরামিশাষীদের ক্ষেত্রে ১,৫০০ টাকা)। দ্বিশয্যা, তিন-শয্যা, চার শয্যার ঘর পাওয়া যাবে। খাবারদাবারে বাঙালিয়ানা প্রাধান্য পায়। পরিশেষে মৃন্ময়ী কুটিরের কর্মীদের সুভদ্র ব্যবহারের কথা উল্লেখ না করলেই নয়।

যোগাযোগঃ মৃন্ময়ী কুটীর ভিলেজ রিসর্ট, দরিয়াপুর, কাঁথি, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ। ফোনঃ ৮৭১০০ ৪৫৬৬২।

ফটো সৌজন্যঃ মৃন্ময়ী কুটীর ভিলেজ রিসর্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *