প্রাচীন পাইন, দেওদার, ওকের ঝাড়, গাছের গুড়িতে মসের প্রলেপ, গ্রীষ্মে রডোডেনড্রন ফুলের ঝাড়, ঝরনা, পাহাড়-খাদের রাভি নদী, ছবির মতো চাম্বা উপত্যকা, দূরে ধৌলাধার পর্বতশ্রেণীর তুষারশুভ্র সব শৃঙ্গের দৃশ্যাবলী নিয়ে ডালহৌসি হিমাচল প্রদেশের দেশের আরেকটি হেরিটেজ হিল স্টেশন। আভিজাত্যের একটা গরিমা আছে ডালহৌসির। তা বলে উচ্চকিত নয়। ৬,৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ডালহৌসি শহর একটু যেন নিরালায় থাকতেই পছন্দ করে। সৌন্দর্য আর শান্তির বেশ মিলমিশ এখানে।
হিমাচল প্রদেশের পাঁচটি পাহাড় নিয়ে ডালহৌসিকে একটি হিল স্টেশনের রূপ দিয়েছিল সেই ব্রিটিশরাই। ঊনবিংশ শতকে ভারতের ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির বিশেষ উদ্যোগ ছিল এ ব্যাপারে। শহর পরিকল্পনা, পুরনো সব ভবন, চার্চ ডালহৌসির ঔপনিবেশিক স্মৃতিকে উসকে দেয় ক্ষণে ক্ষণে। কান পাতলে অতীতের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। আর যত্রতত্র অবাক করা সব দৃশ্য বুনে রেখেছে প্রকৃতি। তিব্বতি সংস্কৃতির প্রভাব চোখে পড়বে ডালহৌসিতে।
ডালহৌসির নিকটতম রেল স্টেশন ও বিমানবন্দর পাঠানকোট। দূরত্ব ৯০ কিলোমিটার। হিমাচল সড়ক পরিবহন নিগমের বাস পাওয়া যায় দিল্লি, হরিয়ানা, চণ্ডীগড়, পাঞ্জাব থেকেও।
পাঁচ নদী, পাঁচ সেতু, নদী-প্রপাতের পঞ্চপুলা দেখবেন। দঁইকুণ্ড পাহাড়-শীর্ষ থেকে দেখবেন রূপকথার উপত্যকা। খানিকটা ট্রেক করে পৌঁছাতে হয় এখানে। পর্বতবেষ্টিত রাজা উমেদ সিংয়ের আমলে নির্মিত প্রাসাদ ‘রঙমহল’-এ ইতিহাসের মূল্যবান নানা দলিল রয়েছে। আর ডালহৌসিতে যখন, খাজিয়ার তো একবার যেতেই হয়। সড়কপথে ডালহৌসি থেকে খাজিয়ার ২৪ কিলোমিটার।
পৃথিবী জুড়ে প্রায় ১৬০ ভ্রমণ ঠিকানাকে ‘মিনি সুইজারল্যান্ড’ বলা হয়। সেই তালিকায় রয়েছে পাইন, দেওদারের জঙ্গলে ঘেরা, বিশাল সবুজ প্রান্তর ও লেকের খাজিয়ার। অবস্থান হিমাচল প্রদেশের চাম্বা জেলায়। যে-কোনও জায়গাই তার নিজের মতো। কিন্তু এটাও ঘটনা যে, ১৯৯২-এর ৭ জুলাই সুইস অ্যাম্বাসাডার খাজিয়ারকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করেন। প্রতীকী আলিঙ্গন বলা চলে। সরকারি তথ্য অনুসারে, সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্নের এক প্রস্তর-স্থাপত্যে খাজিয়ারের পাথর ব্যবহৃত হয়েছে।
ধৌলাধার পর্বতশ্রেণির পাদদেশে একটি প্লেট-আকৃতির খাজিয়ার তার দৃশ্যপটে অন্য রকমের মাত্রা যুক্ত করেছে। খাজিয়ারে খানিক বিশ্রাম কার্যত প্রাণের আরাম। এখানকার খাজ্জি নাগ মন্দির কমপ্লেক্স আঞ্চলিক মানুষের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। সর্পদেবতার মন্দির। দশম শতকের এই মন্দিরে কাঠের কারুকাজ হিমাচলের প্রাচীন স্থাপত্য রীতি ও সেই রীতিতে কাঠের ব্যবহারের গুরুত্ব বিবৃত করে।
খাজিয়ার থেকে হিমাচল প্রদেশের কাংড়া উপত্যকার ধরমশালা ১২০ কিলোমিটার। বাস আছে। গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া যায়। ধৌলাধার পর্বতশ্রেণির প্রচ্ছায়ায় শান্ত শহর ধর্মশালা থেকে ধৌলাধারের বরফে ঢাকা শৃঙ্গগুলির অপরূপ দৃশ্যাবলী সহজে ভোলবার নয়।
ধর্মশালা দুটি অংশে বিভক্ত। লোয়ার ধরমশালা ও আপার ধরমশালা। লোয়ার ধরমশালা বাজার অঞ্চল। কোতোয়ালী বাজার বেশ জমজমাট। পাহাড়ের উপরের দিকে পাইন, সিডার, ওকের জঙ্গলে ঘেরা ম্যাকলয়েডগঞ্জ। নির্বাসিত তিব্বত সরকারের সদরদপ্তর। তিব্বতে চিনের আগ্রাসনের জেরে ১৯৫৯ সালে তিব্বতি ধর্মগুরু দলাই লামা ভারতে চলে এসেছিলেন তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে। ম্যাকলয়েডগঞ্জেই বসবাস করেন তিনি। লাসা তিব্বতের রাজধানী। সামগ্রিক ধর্মশালা ‘লিটল লাসা’ নামে পরিচিত হয়েছে। বছরভর দেশি-বিদেশি ভ্রমণার্থীদের আনাগোনা লেগেই থাকে এখানে। পুরো অঞ্চলটিতেই তিব্বতি সংস্কৃতির যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। লোয়ার ধর্মশালা থেকে ম্যাকলয়েডগঞ্জ ৯ কিলোমিটার। ধরমশালা (লোয়ার)-ম্যালয়েডগঞ্জ যাতায়াতের জন্য রোপওয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
ম্যাকলয়েডগঞ্জ থেকে আরও খানিক উপরে ধরমকোট গ্রাম। এখান থেকে চারপাশের নৈসর্গিক শোভা সুন্দর, বিষ্ময়কর। বিদেশী মানুষজনের বসবাস রয়েছে এখানে। পাহাড়ি এই গ্রামে পশ্চিমী ধাঁচের লাইফস্টাইল চখে পড়বে। ধরমকোট থেকে পাহাড়ের উচ্চস্তরে অপূর্ব এক পশুচারণভূমি ত্রিয়ুঁদ ট্রেক করা যায়।
বেড়িয়ে দেখুন ভাগসুনাগ জলপ্রপাত ও মন্দির, অরণ্যের পশ্চাৎপটে ফোরসাইথগঞ্জের ১৮৫২ সালে তৈরি সেন্ট জন চার্চ। কোতোয়ালী বাজার এলাকায় কাংড়া আর্ট মিউজিয়ামে কাংড়া ঘরানা ও তিব্বতি শৈলীর শিল্প সম্ভার দেখা যায়। ধরমশালা থেকে ৭ কিলোমিটার দূরের নরবুলিংকা ইনস্টিটিউটে তিব্বতি হস্তশিল্প, সংস্কৃতি সংরক্ষিত হয়। অপূর্ব সুন্দর পরিবেশে প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দেখতে ভালো লাগবে। ধরমশালা কাছে গায়ুত মনাস্ট্রি বেড়িয়ে আসা যায়। ধর্মশালা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে বনগঙ্গা নদীর তীরে প্রাচীন চামুণ্ডা দেবীর মন্দিরটি দেখে আসা যায়।
ধরমশালা থেকে পাঠানকোট রেল স্টেশন ৯৫ কিলোমিটার। ফেরার ট্রেন ধরা যায়। হাতে খানিক সময় থাকলে হিমাচল প্রদেশের ব্যস্ত শহর, মন্দিরের শহর, ঐতিহ্যের শহর মন্ডি (মান্ডি) বেড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে। ধরমশালা থেকে মন্ডি ১২০ কিলোমিটার।
শহরের মধ্যে দিয়ে বহে চলেছে বিপাশা নদী। জেলার নামও মন্ডি। নদী, পাহাড়, লেক ইত্যাদির মধ্যে মন্ডির নিজস্ব একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে
সুদীর্ঘ সময় ধরে। এখনকার মান্ডি একটি বাণিজ্যিক শহরও বটে। কুলু, মানালি, লাহুল-স্পিতির মতো উপত্যকাগুলির প্রবেশদ্বার এই মন্ডি। এখানকার রাস্তায়, বাজারে মান্ড্যলি ভাষায় কথাবার্তা চলে। মদ্র, ধম, সিদ্দু ইত্যাদির সঙ্গে তিব্বতি থুকপাও মন্ডির আঞ্চলিক খাদ্য। মন্ডির রেওয়ালসর মন্দিরটি হিন্দু, বৌদ্ধ ও শিখ ধর্মালম্বীদের কছে অত্যন্ত পবিত্র দেবস্থান বলে বিবেচিত হয়। অনেক মন্দির আছে মন্ডিতে। শিবরাত্রি পালিত হয় জাঁকজমক সহকারে।
মন্ডিতে নদীতীরের বারোট, প্রায় ৯ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত পরাশর লেক, কামরুনাগ লেক, সুন্দরনগর লেক, ৭,৫০০ ফুট উচ্চতায় জিউনি উপত্যকার দেবীদঢ় গ্রাম বেড়িয়ে নেওয়া যায় মন্ডি থেকে। ঘুরে ঘুরে দেখতে পারেন মন্ডির বাজারগুলো।
মণ্ডির নিকটবর্তী বিমানবন্দর কুলু জেলার ভুন্টারে। মন্ডি থেকে ভুন্টার বিমানবন্দর ৯৪ কিলোমিটার। সড়কপথে মন্ডি থেকে চণ্ডীগড় ২০৫ কিলোমিটার, সড়কপথে মন্ডি থেকে পাঠানকোট ২২৪ কিলোমিটার। থেকে সিমলা, চণ্ডীগড়, পাঠানকোট যাওয়ার নানা মানের সরকারি বাস পাওয়া যায়। ট্রেনে চণ্ডীগড় থেকে সরাসরি হাওড়ায় আসা যায়। দিল্লি হয়েও আসা যেতে পারে।
থাকার ব্যবস্থা তথা হোটেল, রিসর্ট-সংক্রান্ত তথ্যের জন্য দেখতে পারেন হিমাচল প্রদেশ টুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের এই ওয়েবসাইটটিঃ https://hptdc.in/
নিগমের কলকাতা অফিসের ঠিকানাঃ 2H, 2ND FLOOR, ELECTRONIC CENTRE, 1/1 A, BIPLABI ANUKUL CHANDRA ST. KOLKATA-700072. Tel: (033) 22126361, Tel/ Fax: (033) 22127470