বাতাসে ছাতিমের আঘ্রাণ
সামনেই পুজো। সেবার বেড়াতে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। উৎসবের ক’টা দিন কাটিয়ে দেওয়া যাবে কলকাতাতেই। টাকাও বাঁচবে খানিকটা, সে কথা ভেবে পুলকও জাগে একটু। রাস্তায়, দোকানপসারে উপচে পড়ছে ভিড়। কলকাতার রাস্তায় চলতে ফিরতে ইতিউতি ছাতিমের আঘ্রাণ পাওয়া যেতে লাগলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে নীল আকাশে উড়ন্ত সাদা মেঘের স্তূপ দেখে বুকের মধ্যেটা হু হু করে। স্কুল পড়ুয়া কন্যা ধাঁই করে বিছানায় শুয়ে পড়ে বলে, ধূর, ভালো লাগছে না। কন্যার মা বলেন, প্রতি বছর বেড়াতে যাওয়ার জন্য এই সময় কী তাড়া থাকে, এবার কেমন সব খালি খালি লাগছে।
ধ্যাত্তেরি, বলে উঠে বসি একদিন। এ সময় দূরে কোথাও যাওয়ার টিকিট পাওয়া যায়? ঝাঁঝিয়ে উঠে বলি আমি। কিন্তু ইসারাই যে কাফি হ্যায়। কন্যা ঝটিতি বলে, তার পাহাড়ে যাওয়ার একজোড়া জুতো চাই; তার মা বললেন, একটা ট্রলি ব্যাগের চাকা খুলে গেছে, নতুন একটা কিনে নেওয়াই ভালো। চকিতে তুমুল ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল। আমি শিহরিত হতে থাকলাম।
একটি ছোট্ট ভ্রমণ পরিকল্পনা
ট্রেনে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা। এমনকী উত্তরবঙ্গের ট্রেনগুলোতেও অপেক্ষমান যাত্রীদের সুদীর্ঘ সব তালিকা দেখে শিউরে উঠতে হয়। অগত্যা শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য বাসের কথা ভাবতে হয়। পরের ভাবনা, যাব কোথায়? পাহাড় তো অবশ্যই, কিন্তু দার্জিলিং, কালিম্পং নাকি সিকিম? অতঃপর ঠিক হল, শিলিগুড়ি পৌঁছে আমরা চলে যাব গ্যাংটক। রাত্তিরটা গ্যাংটকে কাটিয়ে পরের দিন জোরথাং হয়ে যাব পশ্চিম সিকিমের রিনচেনপং। সেখানে থাকা দু’ রাত তিন দিন। পাশেই কালুক। পশ্চিম সিকিমের আরেকটি সুন্দর জায়গা। তারপর অপূর্ব ডেন্টাম ভ্যালি হয়ে আমরা চলে আসব পেলিং। দু’ রাত থাকব পেলিংয়ে। পেলিং থেকে ফেরা।
আগেও দু’বার আসা হয়েছে পেলিংয়ে। যদিও পেলিং অনেক পাল্টে গেছে, হোটেলের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, আর ঘিঞ্জি হয়েছে জায়গাটা, তবুও, পরিষ্কার সকালে পেলিং থেকে সিদুঁররঙা কাঞ্চনজঙ্ঘা আর পাণ্ডিম দেখে বিষ্ময়ের ঘোর লাগে।
খেচিপেরি লেকের পথে যেতে রিম্বি প্রপাতের জলকণা গায়ে মেখে পেয়ারা বা ভুট্টাপোড়া খাওয়ার মজা ভোলার নয়। সিংসোর ব্রিজের ওপর থেকে গভীর খাদের মধ্যে একটা নুড়িপাথর ফেলে দেখতে হয় কতক্ষণে সেটা অদৃশ্য হয়। এতই গভীর গর্জ। আর মনাস্ট্রিতে যাঁদের বিশেষ আকর্ষণ, তাঁদের জন্য পেলিংয়ে আছে তাসিডিং, পেমায়াংশে, সাঙ্গাচোলিংয়ের মতো সব অবশ্যদ্রষ্টব্য মনাস্ট্রি।
স্মরণীয় যাত্রা
একটা লাক্সারি বাসের টিকিট কাটা হয়েছিল। পঞ্চমীর সন্ধ্যায় লটবহর নিয়ে বাড়ি থেকে বেরনো গেল। রাত ৮টায় ধর্মতলা থেকে বাস ছাড়ার কথা। শারোদৎসবের পরিমণ্ডল। ঝলমলে কলকাতায় মানুষের ঢল। সময়মতোই পৌঁছানো গেল যথাস্থানে। বাসের আরো যাত্রী জড়ো হয়েছেন। সকলের মুখেচোখে খুশির ঝলক। টুকটাক পরিচয়ের পর্ব চলতে থাকল। ইতিমধ্যে বাস এল সাফসুতরো হয়ে। পেল্লায় বাস। এসি চালিয়ে দেওয়া হল। টিভি চলছে। আরামদায়ক চেয়ার। বেশ বেশ। সব ঠিক আছে তবে। বাস ছাড়ল সাড়ে ৮টা নাগাদ।
বারাসাত পর্যন্ত ভিড়াক্কার রাস্তায় বাস চলল ঢিমে গতিতে। তারপর গতি বাড়ল খানিকটা। কিন্তু মাঝে মাঝেই বাস গাড্ডায় পড়তে থাকল, লাফিয়ে উঠতে লাগল। অস্বস্তি হছে। কৃষ্ণনগর পোঁছানো গেল। খাওয়াদাওয়া সারা হলে বাস ছাড়ল ফের। একটু এগনোর পরে বাসের গতি কমল। অতো বড় বাসটা ডানে-বাঁয়ে দুলতে লাগলো। সেই শুরু। বাসের শম্বুক গতি। ক্ষণে ক্ষণে বাসের চাকা পড়ছে বড় বড় গাড্ডায়। যাত্রীদের ঘুম, তন্দ্রা উবে গেছে কখন। বসে থাকতেও অসুবিধা হচ্ছে। রাত দেড়টা নাগাদ বাস গেল খারাপ হয়ে। সোনায় সোহাগা। লাইটপোস্টে রক্তহীন টিমটিমে আলো। শুনশান পরিবেশ। ঝিমঝিমে রাত। আতঙ্কগ্রস্ত কিছু লোক, থুড়ি ভ্রমণার্থী। এরই মধ্যে শোনানো হল অমৃতকথা, এ বাস আর চলবে না। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে অন্য একটা বাসে আমাদের ঠেলেঠুলে তুলে দেওয়া হল। আশ্চর্যজনকভাবে এঁটে গেল সকলে। শুরু হল ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক, বাসওয়ালা, সরকার ইত্যাদির ষষ্ঠীপুজো। তাতে গায়ের ঝাল খানিক মিটল হয়তো, গায়ের ব্যথা কিন্তু বাড়তেই থাকল। রাস্তার দশা একইরকম। কালরাত্তির কেটে ভোর হল। বেলা বাড়তে থাকল। আমরা চলতে থাকলাম হেলেদুলে। প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে হেসে উঠছি। বাস হেলে পড়লে গেল গেল রব উঠছে। পরক্ষণেই বেঁচে যাওয়ার আনন্দে তৃপ্তির হাসির উদ্গীরণ ঘটছে। কিছু বাঙালি পুজোর ভ্রমণে চলেছে। গুটিকয় যুবা মাঝে গান ধরেছিল, চল রে চল সবে ভারত সন্তান—
মালদা পেরনো গেল দুপুরে। রায়গঞ্জে প্রায় বিকেল। কিষাণগঞ্জে পৌছে আমরা খানিকটা হাঁপ ছাড়ি। চলে এলাম প্রায়। এবার শুরু হল জ্যাম। দুর্বিষহ জ্যাম। এতক্ষণে পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেছে জানি। আমাদের ধৈর্য্যের দৌড়টা জানিয়ে রাখি। আগের দিন রাত সাড়ে ৮টায় বাসে উঠেছিলাম। শিলিগুড়িতে নামলাম পরের রাতে, ৯টা নাগাদ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। বহুবার বাসে শিলিগুড়ি গিয়েছি। স্বাভাবিকভাবে সময় লাগে ১২ ঘন্টা। এবারের অভিযানের তুলনা হয় না। একটা জাতীয় সড়কের এমন অবমাননাও তুলনারহিত। বাস থেকে নেমে ড্রাইভারের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিতে সে ক্লান্ত হেসেছিল।
প্রসঙ্গত, কয়েক বছর আগেকার কথা বলছি। শুনেছি, এখন ৩৪ নং জাতীয় সড়কের অবস্থা একটু ভাল। তবে পুরোটা নয়। দুটো সরকারের আকচাাকচিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার উন্নতি বছরের পর বছর আটকে থাকে। মানুষ ক্লান্ত হাসে।
ভোর হল নিমেষে
এ দিন আমাদের রাতে থাকার কথা ছিল গ্যাংটকের হোটেলে। সেটা আর সম্ভব নয়। অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়েছে, গচ্চা গেল সেটা। খোঁজখবর করে শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাসের কাছে একটা হোটেলে উঠলাম রাত্রিবাসের জন্য। রাতের খাওয়াদাওয়া সারা গেল পাড়ার মধ্যেকার একটা ছিমছাম রেস্তোরাঁয়। সুস্বাদু ডাল, আলুভাজা, মিক্সড ভেজিটেবল, রুই মাছের ঝোল আর সালাড সহযোগে ক্ষুধার্থ শরীরে সে-রাতের আহার সত্যিই খুব তৃপ্তি দিয়েছিল। শিলিগুড়িতে থাকলে এখনো অন্তত একবেলা এই রেস্তোরাঁয় খাই। ষষ্ঠীর রাত। শিলিগুড়ি জমজমাট। রাতে অল্প ঠাণ্ডার আমেজ। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই ঘুম। ক্লান্ত শরীরে সেই প্রশান্তির নিদ্রা মনে আছে এখনো। নিমেষে ভোর হল যেন।
পাহাড়ের পথে
সকালে বাইরে বেরনোর অভ্যাস। অন্যেরা নিদ্রামগ্ন। বেরিয়ে এলাম হোটেল থেকে। বাস টার্মিনাসের উল্টোদিকে এক চায়ের দোকানে বসলাম। বাতাসে অল্প ঠাণ্ডার শিরশিরানি। চা খাচ্ছি। একটি নেপালী ছেলে চা নিয়ে পাশে বসল। প্রকাশ পেল, গাড়ি চালানোই ছেলেটির পেশা। জোরথাং যাওয়ার গাড়ির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই তার ঝটিতি জবাব, ম্যায় তো যা রহা হ্যায় জোরথাং। মাহিন্দ্রা গাড়ি। আ যাইয়ে আপলোগ। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। ভাড়ার কিছু টাকা আগ্রিম দিয়ে হাতচিঠা আর ছেলেটির ফোন নম্বর নিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। বলে দিয়েছে, গাড়ি ছাড়বে ৮টায়।
সকালের জলযোগ সেরে চলে এলাম গাড়ির কাছে। এটা শেয়ার গাড়ি। নিয়মিত শিলিগুড়ি-জোরথাং যাতায়াত করে। শিলিগুড়িতে শের ই পাঞ্জাব ধাবার কাছ থেকে পাওয়া যায়। আরও কয়েকজন যাত্রী জড়ো হয়েছে। আমরা প্রথম তিন যাত্রী। বসার ব্যবস্থা ভালোই হল। যথাসময়ে ছাড়ল গাড়ি। শিলিগুড়ি থেকে জোরথাং ৮৩ কিলোমিটার। এখান থেকে গাড়ি বদল করে আমরা যাব পশ্চিম সিকিমের কালুক। সেখান থেকে রিনচেনপং। কালুক থেকে রিনচেনপং মাত্রই ৩ কিলোমিটার। জোরথাং থেকে রিনচেনপং ৩৭ কিলোমিটার। সপ্তমীর সকাল। ফাঁকা রাস্তা। সেবক পেরতেই সেই চেনা দৃশ্য। পাহাড়ের পাকদণ্ডী পথ। প্রবহমান তিস্তা। ধূপি বন। হিমেল বাতাস।
ঘন্টা তিনেক পরে পৌঁছানো গেল জোরথাং। রঙ্গীত নদীর তীর বরাবর দক্ষিণ সিকিমের এই জোরথাং এক বর্ধিষ্ণু শহর।
মকর সংক্রান্তির সময় এখানে বড় উৎসব হয়। মেলা বসে। প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। যাইহোক, জোরথাংয়ে গিয়ে পড়লাম আরেক আতান্তরে। আঞ্চলিক মানুষজন ভাইটিকা উৎসব উপলক্ষে বাড়ি ফিরছে। গাড়ির আকাল। তিনতলা বাসস্ট্যান্ড। যাত্রীপূর্ণ একেকটা গাড়ি হুস হুস করে নেমে আসছে। জানা গেল, প্রাইভেট গাড়ি পাওয়া যাবে না। আর সাধারণ গাড়িতে আমাদের ঠাঁই হবে না, ঠাঁই হবে না মানে ভিড়ে ঠাসাঠাসি সে-গাড়িতে আমরা যেতে পারব না। ট্রাইপড, বড় বড় ক্যামেরা হাতে দুই যুবক গাড়ির জন্য আমাদের মতোই হন্যে হয়ে ঘুরছিলেন। আলাপ হল। জানা গেল, আপাতত ওঁরা কালুকেই যাবেন। শেষপর্যন্ত দুই দল মিলে অনেক বেশি টাকা দিয়ে একটা মারুতি ওমনি ভাড়া করা গেল। বেশি খরচ? গায়ে মাখলে চলবে কেন। পুজোর বেড়ানো বলে কথা যে।
ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা
গাড়ি চলছে। কোনও কোনও বাঁক থেকে দেখা মিলছে তার। রুপোর মতো জ্বলছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। বাঙালি একত্রে বেড়াতে বেরলে যারপরনাই আত্মীয়। দুই যুবকের সঙ্গে ঠিকানা, ফোন নম্বর ইত্যাদি চালাচালি সারা হল। আবার দেখা হবে জানিয়ে কালুকে নেমে দুই যুবা ভিন্ন পথ ধরলেন। আমাদের সামনে এক তরুণ এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করায় সম্মতি জানালাম। গাড়ি রিনচেনপংয়ের পথ ধরল। একটু এগতেই বিকেলের কাঞ্চনজঙ্ঘা ও তার পারিষদবর্গের সুদীর্ঘ রেঞ্জ বিস্ময়াবিষ্ট করে দিল। হোটেলের সামনে গাড়ি দাঁড়াল। পরের দিন একটু এদিক ওদিক বেড়ানোর কথাও হয়ে গেল ছেলেটির সঙ্গে। নাম জিজ্ঞেস করতেই এতক্ষণের হাসিখুশি ছেলেটির মুখটা কেমন কঠিন হয়ে উঠল। বিমল গুরুং, সংক্ষিপ্ত উত্তর। আমাদের বহুশ্রুত বিমল গুরুং তখন দার্জিলিংয়ের দোর্দন্ডপ্রতাপ নেতা। পরে শুনেছিলাম, নেতা বিমল গুরুংয়ের নামের সঙ্গে তুলনা করে কালুকের এই তরুণটিকে ক্ষেপানো হয়। তাই নাম বলাতে তার অস্বস্তির শেষ নেই।
ঘন্টিপোকা কালোমাণিক রিনচেনপং
সারাদিন পরে গরম জলে ভালো স্নান হল। চা-টা খেয়ে চারিদিকটায় নজর দেওয়ার আবকাশ পাওয়া গেল। লাভ হল না বিশেষ। এমনিতেই পাহাড়ি অঞ্চলে আঁধার নামে তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যা হয়েছে। আকাশে একফালি চাঁদ। চারপাশটায় প্রচুর গাছগাছালি, বোঝা যাচ্ছে। দূরের পুঞ্জাকৃতির আলোক বিন্দুগুলো পেলিং পাহাড়ের আলো বলে জানা গেল। উল্টোদিকে আরেকটা হোটেলে অতিথিরা এসে পৌঁছলেন। রাস্তায় নেমে এলাম। ঝিঁঝিঁর কলতান এখানে সেখানে। আর দূরে আধো জোছনায় জলছবির মতো হিমালয়। বেশ ঠাণ্ডা। পরিবেশের গুণে ক্লান্তি উধাও।
হোটেলের রেস্তোরাঁয় নৈশাহার সেরে একটু আগেভাগেই শয্যা নেওয়া গেল। ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে, মোরগের ডাকে। পরে দেখেছি, রিনচেনপংয়ের প্রায় প্রতি বাড়িতেই মুরগি পালন করা হয় ছোট আকারে। খেত বলে তো কিছু নেই এরকম পার্বত্য এলাকায়। পাহাড়ের ধাপে চাষবাস। বাড়িতে মুরগিপালন অর্থনৈতিক কারণেই। অতিথিদের ফরমায়েস অনুসারে হোটেল থেকে মোরগ কেনা হয়। ডিম বাড়ির সদস্যদের প্রাণীজ প্রোটিনের যোগান দেয়। অন্ধকার কাটেনি তখনো। একটা সমবেত প্রার্থনার সুর কানে এল। জালনায় এসে দাঁড়ালাম। একদল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী শ্রুতিমধুর প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে চলেছেন। রাতশেষে রিনচেনপংয়ের প্রথম দৃশ্য। অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। আলো ফুটছে। কাঞ্চনজঙ্ঘায় রঙের ছোপ লাগলো। একটা শান্ত, সুন্দর সকাল। এই শান্ত পরিবেশটাই রিনচেনপংয়ের বৈশিষ্ট্য। স্পষ্ট শোনা যায় পাখির ডাক। বিভিন্ন পাখির দেখা মিলবে এখানে। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা জাগরুক হয়ে থাকে সারাদিন। কাঞ্চনজঙ্ঘার সুদীর্ঘ রেঞ্জ দেখা যায় এখান থেকে। কাঞ্চনজঙ্ঘা, পাণ্ডিম, সিম্ভো, জাপুনো, কাব্রু, রাটোং, জানো পর্বতের শৃঙ্গগুলির সমাহারে শায়িত বুদ্ধের দারুন অবয়ব দেখা যায় রিনচেনপং থেকে। সান্দাকফু থেকে শায়িত বুদ্ধ দেখেছি, খুব সুন্দর। রিনচেনপং থেকে দেখা দৃশ্যও কম যায় না। রিনচেনপং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও মাউন্ট কাব্রু, মাউন্ট পাণ্ডিম ও মাউন্ট কুম্ভকুর্ণও খুব ভালো দেখা যায়
বেলা দশটা নাগাদ বিমল গুরুং চলে এল তার বাহন নিয়ে। সাইট সিয়িং ঠিক বলব না। একটু ঘুরেফিরে দেখা আর কী জায়গাটা। এখানে একটা কথা বলে রাখি, রিনচেনপংয়ে শপিং ইত্যাদির কোনও সুযোগ নেই। হৈচৈ যাঁদের পছন্দ রিনচেনপং তাঁদের জন্য নয়। কাছাকাছি আধা শহর কালুক। এখানে কিছু দোকানপাট, রেস্তোরাঁ রয়েছে। হোটেল রয়েছে কয়েকটি। বিমল প্রথমে আমাদের নিয়ে গেল জঙ্গলে ঘেরা একটি জলাশয়ের কাছে। জলাশয়টি পয়জন পোখরি নামে পরিচিত। গ্রীষ্মে, শীতে পোখরীতে জল থাকে না। দৃশ্যত জায়গাটা যে খুব আকর্ষণীয় এমন নয়। তবে ঐতিহাসিক দিক থেকে পয়জন পোখরির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। সিকিমের চোগিয়াল রাজার সঙ্গে ব্রিটিশ বাহিনীর যুদ্ধ হয়েছিল এই অঞ্চলে। চোগিয়াল বাহিনীকে সমর্থন করে উপজাতীয় লেপচারা অঞ্চলে পানীয় জলের একমাত্র উৎস এই পোখরিতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। বিষাক্ত জল পান করে ব্রিটিশ বাহিনীর বেশিরভাগ সেনার মৃত্যু হয়। ব্রিটিশ বাহিনী পিছু হটে। আঞ্চলিক গাছগাছড়া থেকে বিষ তৈরি করা হয়েছিল। আঞ্চলিক মানুষজনের মতে জায়গাটি ভুতুড়ে। রাতবিরেতে এখানে কেউ আসে না।
রিনচেনপং বেড়াতে গেলে রিনচেনপং মনাস্ট্রির আঙিনায় গিয়ে দাঁড়াতেই হবে। ৫৫০০ ফুট উচ্চতায় রিনচেনপং মনাস্ট্রি চত্বর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য এককথায় অসাধারণ। এটি সিকিমের তৃতীয় প্রাচীনতম মনাস্ট্রি। গুম্পার মধ্যে রয়েছে অতি বুদ্ধর বা আদি বুদ্ধের বিরল মূর্তি। মূর্তির গাত্রবর্ণ নীল। ধ্যানে উপবিষ্ট বুদ্ধকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে রয়েছে এক নারী। রিনচেনপং এলাকার মধ্যে রয়েছে আরেকটি মনাস্ট্রি। এটি গুরুং মনাস্ট্রি বা রিশুম মনাস্ট্রি নামে পরিচিত।
রিনচেনপংয়ে থেকেই বেড়িয়ে আসা যায় ছায়াতাল (১৮ কিলোমিটার), হি ওয়াটার গার্ডেন (১৩ কিলোমিটার)। বার্সে রডডেনড্রন স্যাংচুয়ারি (৩০ কিলোমিটার)। মার্চ-এপ্রিল মাসে রডডেনড্রন ফুলে ছেয়ে যায় গোটা বার্সে অঞ্চলটি। সিংসোর ব্রিজ রিনচেনপং থেকে ২৭ কিলোমিটার। সিংসোর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে উত্তরে গ্রাম। উত্তরে এখন সিকিমের জনপ্রিয় পর্যটন ঠিকানা। চাইলে ভ্রমণসূচিতে রিনচেনপংয়ের সঙ্গে উত্তরেকে যুক্ত করে নেওয়া যায়। অর্থাৎ উত্তরেতেও থাকার ব্যবস্থা করা যায়। উত্তরে, রিনচেনপং-কালুক, ছায়াতাল ও পেলিংকে অন্তভুর্ক্ত করে সপ্তাহখানেক সময় নিয়ে পশ্চিম সিকিম ভ্রমণের একটা সুন্দর পরিকল্পনা করা যায়।
বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম কালুকে। এই কালুক থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ পূর্ব হিমালয়ের দীর্ঘ রেঞ্জ দেখা যায়। তখন সন্ধ্যা। আগেই বলেছি, কিছু দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ আছে কালুকে। মূল চত্বরটা আলোকিত হয়ে আছে। একটা দশাসই চেহারার কালো পাহাড়ি কুকুর পিছু নিল। একটা বিস্কুটের প্যাকেট কিনে খেতে দিলাম ওকে। আঞ্চলিক এক মহিলা দাঁড়িয়েছিলেন সামনে। বললেন, দোস্তি হো গিয়া, সারে কালুক, রিনচেনপং ঘুমা দেগা আপকো। কথাটা অমূলক নয়। রিনচেনপং ছাড়া পর্যন্ত কুকুরটি আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ছিল, যতক্ষণ আমরা পায়ে হেঁটেছি। দুর্দান্ত মোমো আর চা খেয়ে, কিছুটা সময় কালুকে কাটিয়ে আমরা রিনচেনপংয়ের পথ ধরলাম।
রাস্তায় টিমটিমে আলো। ডাইনে গাছপালার ঘন জটলা। সেখানে চাপ চাপ অন্ধকার। আকাশে আধেক চাঁদ। দূরে সেই জলছবির মতো কাঞ্চনজঙ্ঘা। শব্দ বলতে শুধু ঝিঁঝিঁর কলতান আর ঘন্টিপোকার ঘন্টাধ্বনি। ঠিক যেন ঘন্টা বাজছে, এমনই আওয়াজ করে বড়সড় দেখতে পোকাগুলো। শহরের ঘূর্ণাবর্ত থেকে কতদূর এ সব জায়গা। আলোর ঝলকানি, কানফাটানো শব্দের ঢক্কানিনাদ, অশান্তির পরিবেশ থেকে সরে এসে দুটো দিন এমন কোনও জায়গায় কাটিয়ে যেতে পারলে শরীর-মন পরিশুদ্ধ হয়। সঙ্গে চলেছে সারমেয়টি। এমন নির্জন পথে তাতে ভরসাই পাওয়া যাচ্ছিল। ভাবনাও একটা হচ্ছে। ও তো আসছে কালুক থেকে। তিন কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আবার কালুকে ফিরবে? পরে জানলাম,না, ও আমাদের হোটেল চত্বরেই থাকবে। আমরা রাতে ওর খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। অন্যথায় হোটেল থেকেই ওর কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। এটাই রীতি। পাহাড়ের কঠিন জীবন। একের অন্যকে সাহায্য করাই রীতি।
রিনচেনপঙের পাট গোটানোর সময় হল। সকালে ঝকঝক করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। পাখি উড়ছে। গাছে গাছে ফুল। গাড়ি চলে এসেছে। কালোমানিক এসে দাঁড়িয়েছে। এই নাম দিয়েছি ওর। বুঝেছে আমরা চলে যাচ্ছি। গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। হোটেলের এক কর্মী জানালো, আপনারা চলে গেলেই ও কালুক ফিরে যাবে। হাঁকডাক নেই।
কালোমানিক শান্ত। গাড়ির দিকে তাকিয়ে বসে রইল। এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ি।
আমরা পেলিংয়ের পথ ধরলাম। ডেন্টাম রোড ধরে গাড়ি চলেছে। অপূর্ব ডেন্টাম ভ্যালির উপর দিয়ে রাস্তা। পথের ধার থেকে বাচ্চারা হাত নাড়ছে। মুখে অমলিন হাসি। পথের বাঁকে বাঁকে ঝিলিক দিয়ে উঠতে থাকল কাঞ্চনজঙ্ঘা।
ডেন্টাম ভ্যালি
রিনচেনপঙের কয়েকটি হোটেল
হোটেল ল্যান্ডস্কেপঃ ফোন- ৭৫৯৫৯-৭৯৫৪৭। হোটেল রিনচেনপং নেস্টঃ ফোন-৭৪৩২০-২১৫০৯। হোটেল রিনচেনঃ ফোন-৭৪৩২০-২১৫০৯। ডেনজং রেসিডেন্সিঃ ফোন- ৯০৫১৫-৪৩৬৫২। ইয়াং-সে রিট্রিটঃ ফোন-৯০০৭৬-০৬৬৩৫। ম্যান্ডারিন ভিলেজ রিসর্ট(কালুক), ফোন-৯৭৩৩০-৯২২৩০, ৮৬৭০৩-৭১৮২৬। গ্রিন হিল রিসর্ট (কালুক), ফোন-৭০৪৪৬৬২৭৭৭।