Follow us
Search
Close this search box.

বাঙালির পুরী – শেষ পর্ব

বাঙালির পুরী – শেষ পর্ব

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সমুদ্রে সূর্যোদয় দেখলাম। খানিক আগেও জোয়ারে ভরপুর সমূদ্রে এখন ভাটার টান শুরু হয়েছে। এক অপূর্ব সন্ধিক্ষণ। তাই ঢেউয়ের একটু অনিয়মিত ছন্দ। পরপর কতগুলো ছোট বা মাঝারি ঢেউয়ের মাঝে আচমকা এক একটা বড় ঢেউ যেন শত ফণা তুলে এগিয়ে আসছে। দিউ, মুম্বাই, গোয়া, কোভালাম, কন্যাকুমারী, পন্ডিচেরি, ভাইজ্যাগ, দিঘা, মন্দারমণি, সময় পেলেই নানা সমুদ্র সৈকতে  ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার কাছে সবার সেরা এই পুরীর সমুদ্র। হতে পারে নানা স্মৃতির অনুষঙ্গ কাজ করে।

যাইহোক, ভেবেছিলাম এবারের পুরী ভ্রমণ নিরবচ্ছিন্ন অবসর যাপনের হবে। তবে হাওয়া বদলের মত একেবারে ঘরে বসে থাকা চলছে না, বলা যায়, সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আজ  চৈতন্য মহাপ্রভুর স্মৃতিবিজড়িত স্থান, জগন্নাথ মন্দির ও জগন্নাথদেব সম্পর্কিত জায়গাগুলো দেখব বলে বেরিয়ে পড়া গেল।

ভেবেছিলাম রিকশা করে ঘুরব, কিন্তু হোটেলের সামনের রাস্তায় টোটো আর অটোর ভিড়। শেষপর্যন্ত আমাদের সারথি হল ভীমা। সঙ্গে তার টোটো। পুরীর স্থায়ী বাসিন্দা, লোকনাথ শিব মন্দিরের দিকে বাড়ি। হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ওকে মোবাইলে আমাদের দু’জনের ছবি তুলতে বললাম। ঠিকঠাক, বেশ তুলেছে, প্রাথমিক ভাবে পাশ। রফা হল ৭০০ টাকায়, ভালো লাগলে আরো পঞ্চাশ দিতে হবে। বললাম ঠিক আছে, বেরিয়ে পড়া যাক তো।

লোকনাথ মহাদেব মন্দির

হোটেলের সামনে ওই প্রথম ছবিটি তুলে যাত্রা শুরু। প্রথম গন্তব্য বহু বছরের প্রাচীন লোকনাথ মহাদেবের মন্দির। কথিত আছে ইনি শ্রী জগন্নাথ দেবের ভান্ডারের রক্ষক। মন্দিরের পুরোহিতরা জানালেন, এই মন্দির পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরের থেকেও পুরনো। জগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে এই মন্দিরটির অবস্থান। প্রধান ফটকের বাঁদিকে এক বড় পুষ্করিণী। পার্বতী সাগর নামে খ্যাত। সকলে পুকুরের জলে হাত ধুয়ে, মাথায় জল দিয়ে প্রবেশ করছেন মন্দির প্রাঙ্গনে। গর্ভ-মন্দিরে ঢোকবার পথ সংকীর্ণ, নীচের দিকে নেমে গেছে। খুব ভক্তি সহকারে পূজো নিবেদন করছেন ভক্তরা। শিবরাত্রির দিন এই মন্দিরে হরিহর ভেট উৎসব আয়োজিত হয়। মন্দিরের মধ্যে মোবাইল ফোন,ক্যামেরা নিষেধ। এক এক করে মন্দির, লোকনাথ শিবলিঙ্গ দর্শন হল।

শ্রী তোটা গোপীনাথ মন্দির

একই দিকে পরের গন্তব্য শ্রী তোটা গোপীনাথ মন্দির। উৎকল ভাষায় তোটা বা টোটা শব্দের অর্থ উদ্যান। শ্রী জগন্নাথ দেবের দ্বারপাল যে পঞ্চশিব তার অন্যতম শ্রী যমেশ্বর মন্দির-সংলগ্ন একটি উদ্যান ছিল। গদাধরের সঙ্গে দেখা করতে প্রতিদিন চৈতন্য মহাপ্রভু এই যমেশ্বর তোটায় আসতেন। কথিত আছে যে, একদিন মহাপ্রভু ভাবাবেশে হাত দিয়ে বালি সরাতে গিয়ে গোপীনাথের বিগ্রহ পান, এবং ভক্তদের সমুদ্রের উপকূলকে যমুনা নদীর তীর মনে করে সেই বিগ্রহের নিত্যসেবা করতে বলেন। মন্দিরে শ্রী গোপীনাথ পদ্মাসনে উপবিষ্ট। আমরা পৌঁছেছি বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ, মন্দির বন্ধ। সেবাইত জানালেন, ৪ টায় শয়ন শেষে দর্শন মিলবে।

তোটা গোপীনাথ

মন্দিরের নাটমন্দিরে তখন কেবল আমরা দুজন, শ্রী গোপীনাথ দর্শনের অপেক্ষায়। মন্দিরের গায়ে, ছাদে চৈতন্য মহাপ্রভুর নানা লীলা, শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা, রাসলীলার অপূর্ব সুন্দর চিত্রায়ণ। এই সব দেখছি, একদিকে  ভীমার সময় পেরিয়ে যায় কিনা সে চিন্তা, আবার অন্যদিকে দর্শনের ইচ্ছা। অবশেষে এক মুখ হাসি নিয়ে ভীমা বলল, এখনই দরজা খুলবে। এরমধ্যে একদল অবাঙালি ভক্ত এলেন, আলাপ করে জানলাম সুদূর গুজরাট থেকে এসেছেন। শ্রী তোটা গোপীনাথ দর্শনের অপেক্ষায় ওঁরা পুরুষ ও নারী পৃথক লাইন করে হাত জোড় করে বসে পড়লেন, প্রত্যেকের হাতে প্রণামী। ঘড়ির কাঁটা ৪টেয় পৌঁছাল, তবু মন্দিরের দরজা খোলে না। অবশেষে একটি শ্যামবর্ণ কিশোর এল, পাশের দরজা দিয়ে গর্ভ-মন্দিরে প্রবেশ করলো। ৪টে বেজে গেল, দরজা খুললো না। গুজরাটের দলটির সকলে প্রণামী জমা করে দন্ডবৎ প্রণাম সেরে চলে গেলেন। আবার মন্দির চত্বর ফাঁকা। হঠাৎ দরজা খুলে গেল। সুন্দর দর্শন হল। ফিরে যাওয়া দলটির জন্য খারাপ লাগলো। পরে আর ওই শ্যামবর্ণ কিশোরকে দেখতে পেলাম না।

ভাসুর-ভাদ্র বৌ পাতকুয়া

এবার চললাম  শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের উত্তর পূর্ব দিকে, ওদিকে প্রথমেই পড়ল ভাসুর-ভাদ্র বৌ পাতকুয়া। একই সঙ্গে উপর থেকে একজন এবং সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে নেমে আরেকজন জল তুললে কেউ কাউকে দেখতে পাবে না। খুব সংকীর্ণ অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখা যায়, নামতে চাইলে আলো জ্বেলে দেন সেবাইত। তবে উঠে আসার পরে প্রণামী না দিলে অসন্তোষ প্রকাশ করে থাকেন।

ভীমাকে আগেই বলে রেখেছিলাম আসল কাকাতুয়া থেকে আসল খাজা কিনব।  পুরীতে নরসিংহ, গাঙ্গুরামের মতো নামী অনেক দোকান আছে। কোনওটা আদি তো কোনওটি আসল। শেষ ভরসা অটোওয়ালারা। গবেষণা করে ওরা যেটাকে আসল ও আদি বলল সেটাকেই আসল ধরে নিয়ে খাজা কিনে মনের শান্তি। তবে কোন খাজাই জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদের খাজার মতো হয় না।

সিদ্ধ বকুল মঠ

আর একটু এগিয়ে সিদ্ধ বকুল মঠ, ভক্ত হরিদাস ও চৈতন্য মহাপ্রভুর স্মৃতিবিজড়িত বৈষ্ণব ভক্তদের অন্যতম মহাতীর্থ। চৈতন্যদেব পুরী ধামে এসে কাশী মিশ্রের বাড়িতে উঠতেন। একদিন চৈতন্য মহাপ্রভু ও তাঁর অন্যান্য পার্ষদেরা এসে উপস্থিত হয়েছেন সেখানে। সকলেই আছেন, কেবল হরিদাস ঠাকুরকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। চৈতন্য মহাপ্রভু নিজহাতে প্রসাদ বিতরণের সময় হরিদাসের বিষয়ে জানতে চাইলেন। পরে বাড়ির বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যবন হরিদাস বললেন,’আমি নীচ ও ভিন্ন জাতি, আমার শ্রী জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি নেই, বরং কোনও তোটা তথা জঙ্গলে একটু থাকবার ব্যবস্থা হলেই আমি কৃতার্থ হব প্রভু’। সে কথা শুনে ও মহাপ্রভুর নির্দেশে মহান ভক্ত কাশী মিশ্র পাশের বাগানে তাঁর থাকবার ব্যবস্থা করে দিলেন। যেখানে বসে শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের চূড়া দেখা যায়। অবশ্য চারিদিকে বাড়িঘর ও ঘন লোকবসতি হওয়ায় আজকাল তা আর সম্ভব হয় না। যবন হরিদাস এইখানে বসে ঈশ্বর সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেন এবং ঠাকুর হরিদাস প্রভু হয়ে ওঠেন।

সিদ্ধ বকুল

শ্রী রামকৃষ্ণ  পরমহংসদেব বলেতেন “মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ।” হরিদাস  ঠাকুর শুধু ঈশ্বর লাভ করেননি, ঈশ্বরীয় বহুগুণে গুণান্বিত হয়ে আজও বৈষ্ণব ভক্তদের অতি প্রিয় চৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ হিসাবে সর্বত্র পূজিত হন। এই সিদ্ধ বকুল মঠে একটি বকুল গাছ আছে, যে গাছের তলায় বসে হরিদাস ঠাকুর সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। এই গাছ নিয়ে কিংবদন্তি, প্রতিদিন সকালে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার জন্য স্নানের আগে দাঁত মাজার জন্য ‘কুম্ভাটুয়া’ গাছের ডাল আগের দিনই সংগ্রহ করে রাখা হয়, কোনও একদিন সকালে যথা সময়ে দেখা গেল একটি দাঁতন কাঠি নেই, তাৎক্ষণিক ভাবে বকুল গাছের ডাল নিবেদন করা হয়। প্রতিদিন কোনো না কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ঐ দাঁতন প্রসাদ হিসাবে দেওয়া হত। সেই দিন ওই বকুল গাছের প্রসাদি দাঁতন চৈতন্য মহাপ্রভুকে প্রদান করা হয়। চৈতন্যদেব প্রসাদ পেয়ে এক ঈশ্বরীয় আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে হরিদাস ঠাকুরের অঙ্গনে যান, এবং সেখানে ডালটি মাটিতে পুঁতে দেন।  সেই বকুল গাছের ডালের ছাল থেকে প্রস্ফূটিত হল বৃক্ষ-চারা।

আজও বিরাজমান সেই বকুল বৃক্ষ । তাই চৈতন্য মহাপ্রভুর লীলা ও হরিদাস ঠাকুরের সিদ্ধি লাভ সব মিলিয়ে এক মহাতীর্থ হয়ে উঠেছে এই সিদ্ধ বকুল মঠ। গাছের অনেক ডাল একেবারে শুকনো, কোথাও কোথাও হরিনাম লেখা। অনেকগুলো ডাল মৃতপ্রায়, কিন্তু বেঁচে থাকা অংশ খুবই প্রাণবন্ত। অনুভব করা যায় সেই ডালের অস্তিত্ব। মন্দিরের ভিতরে  একদিকে দেওয়ালের গা ঘেঁষে এক ভক্ত বসে আপনার মনে মৃদু খোলবাদ্য  সহযোগে হরিনাম সংকীর্তন করে চলেছেন, পিছনে হরিদাস ঠাকুরের মূর্তি, যেন নিবিষ্ট মনে শুনছেন, হয়তো শুনছেনই।

গম্ভীরা

সিদ্ধ বকুল মঠের অদূরে গম্ভীরা, তবে রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় অটো যায় না, হয় রিক্সা নচেৎ পায়ে হেঁটে।  চৈতন্য মহাপ্রভুর অনুগত ও নিবেদিত প্রাণ মানুষ ছিলেন কাশী মিশ্র। প্রকৃতপক্ষে তাঁরই বড় বাড়ির একেবারে অন্দরমহলের ছোট একটি ঘর এই গম্ভীরা। এখানে চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচলে থাকাকালীন সাধন-ভজন করতেন। একটি ছোট তুলসী মঞ্চ, সব দিক প্রায় বন্ধ ও অন্ধকার এক কুঠুরি-সদৃশ ঘর, তার ভিতরে পাঁচশ বছরের বেশি পুরনো এক প্রদীপ তেল কালিতে একেবারে একসা। সেই প্রদীপের অনির্বাণ শিখা, কথিত আছে সেই চৈতন্য মহাপ্রভুর সময়ে জ্বালানো প্রদীপ কখনো নেভানো হয় নি, দিন রাত পাহারা দিয়ে আগলে রেখেছেন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব ভক্তরা। একইরকম ভাবে পাঁচশ বছরেরও বেশি সময় ধরে অবিরাম হরিনাম সংকীর্তন হয়ে চলেছে, কখনো এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়নি। এক ছোট্ট কুঠুরি ঘর বেঁধে রেখেছে সময়কে ভক্তদের রশি দিয়ে। খুব বেশি ভিড় হয় না, একটু অন্ধকার, একটু সাবধানে জায়গাটা দেখতে হবে।

গম্ভীরা মন্দির

১৯৮০ সালে যখন এখানে এসেছিলাম তখনও কোনও ভক্ত এমন খোল-করতাল বাজিয়ে হরিনাম সংকীর্তন করছিল, শুনেছিলাম থেমে নেই কীর্তন, মধ্যে এসেও তাই দেখেছি, এবারও তাই দেখলাম। গম্ভীরা তার গাম্ভীর্য নিয়ে আজও অমলিন। গম্ভীরার  আলাদা আবহ কেমন যেন অন্তর্মুখী করে তোলে। খানিকক্ষণ সেই মৌতাত চলতে থাকে।

নরেন্দ্র সরোবর বা চন্দন সরোবর

গম্ভীরা থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চললাম জগন্নাথ মন্দিরের দিকে। মন্দিরের উত্তর-পূর্ব দিকে, জগন্নাথদেবের রথ যাওয়ার রাজপথ ধরে খানিকটা গিয়ে থানা পেরিয়ে একটু বাঁদিকে ভিতরে রাস্তা দিয়ে পৌঁছলাম নরেন্দ্র সরোবর। আমাদের সারথি ভীমার ভাষায় জগন্নাথদেবের পিসির বাড়ি। এখানে দর্শনার্থীর মাঝারি ভিড়। এই সরোবরে বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া অর্থাৎ অক্ষয় তৃতীয়া তিথি থেকে একটানা ২১দিন চন্দন যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। তাই নামান্তরে চন্দন সরোবর। জনশ্রুতি,   নরেন্দ্র মহাপাত্র নামের এক রাজকর্মচারী এই সরোবর খনন করেন।  এই সরোবরের তীরে শ্রী গদাধর গোস্বামী শ্রীমদ্ভাগবৎ পাঠ ও ব্যাখ্যা করতেন এবং চৈতন্য মহাপ্রভু স্বয়ং পার্ষদ সহ ও মহারাজ প্রতাপ রুদ্র প্রমুখ তা শুনতেন। সরোবরের কাছেই গড়ে উঠেছে একটি মঠ, সাধনক্ষেত্র।

নরেন্দ্র সরোবর

গুন্ডিচা মন্দির

আবার রাজপথে উঠে এসে ডাইনে পুরী কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড থেকে খানিকটা দূরে শ্রী গুন্ডিচা মন্দির, নামান্তরে শ্রী জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি। পুরাণ মতে এটি ছিল অশ্বমেধ যজ্ঞের পীঠস্থান। প্রতি বছর রথযাত্রার দিন শ্রী জগন্নাথ, শ্রী বলরাম ও শ্রী সুভদ্রা রথে চড়ে এখানে আসেন এবং ৯ দিন অবস্থান করেন। সেই ক’দিন মন্দিরের নিয়মে এখানে পূজাপাঠ হয়ে থাকে। বাইরে বিজ্ঞপ্তি ‘কাজ চলছে’। তাই এবারে আর ভিতরে প্রবেশ করা হলো না। ১৯৮০ সালে এসে মন্দিরের ভিতরে সব ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম। এখানেও ভোগ রান্নার একইরকম ঘর। দরজার সামনে এক হাতে বাঁশের ঝাঁটা অন্য হাতে দান নেওয়ার হাতা নিয়ে পান্ডা দাঁড়িয়েছিল। মনমতো প্রণামী না পেলেই গালাগালি ‘ লক্ষ্মী ছাড়া হবি’। সে সময় মন্দিরের প্রবেশ পথে দুদিকে ফাইলেরিয়া আক্রান্ত অনেক দুঃস্থ অসহায় মানুষের ভিড় দেখেছিলাম। এবার কেউ নেই দেখে ভালো লাগলো, হয়তো সরকার ওদের দায়িত্ব নিয়েছেন অথবা এখন আক্রান্তের সংখ্যা নগণ্য।

চক্রতীর্থ

ওখান থেকে স্টেশনের গাড়ি পার্কিংয়ের গা ঘেঁষে এগিয়ে চললাম চক্রতীর্থের দিকে। মহারাজা ইন্দ্রদ্যুন্ম এখানেই দারু অবয়ব রূপে জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রাকে পান। এখানে একটি বেষ্টনীর মধ্যে পাথরের সুদর্শন চক্রের পূজা হয়।

বেড়ি হনুমান মন্দির

চক্রতীর্থের সন্নিকটে বেড়ি হনুমান মন্দির। কথিত আছে, সমুদ্রের জল যাতে মন্দিরের দিকে না যেতে পারে সে জন্য শ্রী জগন্নাথদেব এখানে হনুমানকে প্রহরায় বসান। কিন্তু রামনবমী তিথিতে হনুমান অযোধ্যায় চলে যান । একথা জানতে পেরে হনুমান ফিরে এলে তাঁকে শেকলের বেড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। তাই নামকরণ বেড়ি হনুমান মন্দির।

বেড়ি হনুমান মন্দির

সোনার গৌরাঙ্গ মন্দির

এই মন্দিরের এক পাঁচিলে পাশেই সোনার গৌরাঙ্গ মন্দির। মন্দিরের ভেতরে অষ্টধাতু নির্মিত গৌরাঙ্গ মূর্তি রয়েছে। অদূরে সমুদ্রের ধারে শ্রী রামকৃষ্ণ মঠ। সেখাকার মন্দির দর্শন করতে করতে সন্ধ্যা নেমে এল।

সোনার গৌরাঙ্গ মন্দির

হরিদাস ঠাকুর সমাধি মঠ

এসে পড়লাম স্বর্গদ্বারে। তারপরে চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্যতম প্রিয় পার্ষদ ও লীলাসঙ্গী পরম ভক্ত হরিদাস ঠাকুরের সমাধি মঠে। ভারত সেবাশ্রম ছাড়িয়ে স্বর্গদ্বারের মহাশ্মশান পেরিয়ে এই মঠটি।

একদিন চৈতন্য মহাপ্রভু হরিদাস ঠাকুরের সাধনভূমিতে এসে কুশল জিজ্ঞাসা করলে, হরিদাস ঠাকুর খুব বেদনার সঙ্গে বললেন, “আমার দেহ ঠিক আছে কিন্তু মন বুদ্ধি ঠিক নেই, আমি যথাযথ নাম সংকীর্তন করতে পারছি না”। এরপর  তিনি তার প্রভুর আগে দেহত্যাগ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন।

পরদিন জগন্নাথ দর্শন সেরে সকল ভক্তবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে চৈতন্যদেব এলেন এবং সকলে উচ্চস্বরে নাম সংকীর্তন করতে লাগলেন। হরিদাস ঠাকুর দেহত্যাগ করলেন।  সেই অপ্রাকৃত দেহ কোলে নিয়ে মহাপ্রভু কীর্তন করতে লাগলেন। এরপর চৈতন্যদেব নিজহস্তে সেই নশ্বর দেহ  সমাধিস্থ করেন।  সেই সমাধিক্ষেত্রে প্রতিদিন চৈতন্যদেব আসতন,  নাম সংকীর্তন করতেন। সেই কারণে এই হরিদাস ঠাকুরের সমাধি মঠ বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনের ইতিহাসে এক মাইল ফলক ও মহাতীর্থ।

ভীমার ছুটি হল, বকশিশ সহ। একমুখ হাসি নিয়ে ভীমা বলল, “আবার আসবেন”। এক মুহুর্তে ভীমা হয়ে উঠল যেন শ্রী জগন্নাথদেবের প্রতিনিধি। এভাবেই প্রতি পলে মানুষ ঈশ্বর হন আবার ঈশ্বর মানুষ।

উপর থেকে প্রথম দুটো ফটো সৌজন্যঃ উইকিপিডিয়া
অন্য সবক’টি ফটোঃ লেখক

প্রথম পর্বের লেখাটি পড়তে পারেন এই লিঙ্কেঃ https://torsa.in/bengalis-puri-1st-episode/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *