বাঙালির হুট বলতে পুরী। পুরী বাঙালির নস্টালজিয়া। পুরী স্মৃতি। পুরী বর্তমান। পুরী বাঙ্গালির বড় আপন ভূমি। এ হেন পুরী বেড়াতে যাওয়া আমার কাছে সব সময়েই অন্যরকম এক ভ্রমণ। সমুদ্রে যাওয়া, তীর্থ ভ্রমণ, এসব ছাপিয়ে এক অন্য অনুভূতি। কত জায়গায় বেড়াই, তারপর হঠাৎই এক টান, পুরীর টান। সে টান এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। ফলে আবারও পুরী। অনেকেই ফি বছর পুরী যান। আবার স্থান কৌলিন্যে লে-লাদাক বা কাশ্মীরের ডাললেকের হাউসবোটের মতো তেমন উচ্চস্বরে বলবার মতো নয় বলে অনেকে আবার একটু ঢোক গিলে বলেন, একটু পুজো দেওয়ার আছে, পুরী যাচ্ছি ইত্যাদি। তা হোক, যে কারণেই হোক, তাঁরা যাচ্ছেন তো। সবই থাকবে মিলেমিশে।
আমার জীবনে প্রথম বেড়াতে যাওয়া পুরী, বাবা-মায়ের সঙ্গে । সে ১৯৮০ সালের কথা। স্টেশনে নেমে রিক্সা করে স্বর্গদ্বারে যাওয়ার পথে জীবনে প্রথম শুনেছিলাম সমুদ্রের গর্জন। দেখেছিলাম অসীম আকাশ আর বিপুল জলরাশির মিলমিশ। বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম। বাবার হাত ধরে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম সমুদ্রের বালুতটে, জগন্নাথ মন্দিরের আনাচে কানাচে। এরপর যখনই পুরী যাই, চেনা যায়গায় হেঁটে বেড়াই, মনে পড়ে যায় এখানেই পদচিহ্ন পড়েছিল বাবা-মায়ের। পুরী আমার কাছে এক মহাতীর্থ হয়ে উঠেছে কখন জানতেও পারিনি।
পুরী যাত্রা
আবারও চলেছি। সাম্প্রতিক ভ্রমণ। রাত ১০:৪০-এর পুরী সুপারফাস্টের টিকিট। সময়ের প্রায় এক ঘন্টা আগে পৌঁছে গেছি হাওড়া স্টেশনে। সচারচর নতুন ২৩ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছাড়ে ট্রেনটি। সেখানে থিক থিক করছে সব বয়সের মানুষের জমায়েত। প্রবীণ,নবীন, মহিলা, পুরুষ, সকলেই আছেন সে ভিড়ে। চোখে-মুখে বেড়াতে যাওয়ার খুশির প্রতিফলন।
আমাদের কুপে একটি শিশুও রয়েছে, আবার ফি বছর তীর্থ ভ্রমণে পুরী যান এমন আশি-উর্দ্ধ বৃদ্ধও চলেছেন যুবক নাতির সঙ্গে। ছোট্ট শিশুটি আমার সঙ্গে নাতি সম্পর্ক করে দাদা বলে ডাকতে লাগল। জুতো খুলে উপরের বার্থে উঠে গেছেন অনেকেই। সেই বড় জুতো পায়ে দিয়ে তার কি আনন্দ, বোধহয় বড় হয়ে উঠছি এই আহ্লাদে আটখানা। অন্যের জুতো পরছে বলে তার বাবা নিষেধ করছেন। ওদিকে থেকে তার দিদা বলে উঠছেন, বাবাকে আপ্ করে দাও। এই সব দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকাল হওয়ার খানিক পর শুনলাম কটক এসে পড়েছে। মনে পড়ে গেল, বাবার সঙ্গে যখন এসেছিলাম, সাধারণ স্লিপার শ্রেণীতে পান্ডা উঠে পড়েছিল। আজকাল বাতানুকুল কম্পার্টমেন্টে সে সব অতীত। তখনকার দিনে পান্ডা উঠে পড়লে বোঝা যেত পুরী এসে পড়েছে। এখন রেলযাত্রী অ্যাপ দেখে সব জানা যায়।
যাইহোক, পুরী স্টেশনে ট্রেন ঢুকল। বুকের মধ্যেটা ছলাৎ করে উঠল। যেন প্রথম এলাম পুরী। ট্রেন থেকে নেমে হোটেলের পাঠানো গাড়ি চড়ে পৌঁছে গেলাম আমাদের আস্তানায়। একেবারে সমুদ্রের উপরে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে হোটেলের ঘরখানি ও সংলগ্ন বারান্দা।
মন্দির প্রাঙ্গনে
বিকেলে সদানন্দ পান্ডার তত্ত্বাবধানে জগন্নাথদেব দর্শনে গেলাম। মন্দিরের পশ্চিম দরজা দিয়ে প্রবেশ করে বাঁদিকে কান পাতা হনুমানজিকে প্রণাম করে মন্দির প্রাঙ্গণে ঢুকলে সোজা সামনে নরসিংহ মূর্তি। ডাইনে বিমলাদেবীর মন্দির রেখে একটু এগিয়ে রোহিনী কুণ্ড। পুজোর কুপন কেটে চললাম গর্ভমন্দিরের দিকে। মাঝারি ভিড়। সদানন্দ পান্ডা খুব যত্ন করে হাত ধরে এগিয়ে চলল। চৈতন্য মহাপ্রভু যে স্তম্ভ ধরে দেওয়ালে হাত রেখে জগন্নাথ দর্শন করতেন, সেই স্তম্ভে আনত হলাম । সেই স্পর্শপুতঃ দেওয়াল, তিনটে আঙ্গুলের ছাপ, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর দিব্যভাবে পাথর ক্ষয়ে গেছে এমনই বিশ্বাস ও জনশ্রুতি। স্পর্শ করলাম দেওয়াল। যেন বিদ্যুত খেলে গেল শরীরে। এক অনন্য অনুভূতি। আলতো করে হাত ধরল সদানন্দ পান্ডা। আর আমার অন্য হাত আঁকড়ে ধরে আছেন সহধর্মিনী। গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বারের একেবারে স্তম্ভ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একে একে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা দর্শন হল। এখন আর স্পর্শ-প্রণাম হয় না। বাবার সঙ্গে যখন হাত ধরে গিয়েছিলাম, ওই বেদির কাছে নিয়ে গিয়ে মাথা ঠুকে দিয়েছিল পান্ডা, আর মাথায় পড়ছিল ফাটা বাঁশের লাঠির মৃদু আঘাত। এখন সে-সব অতীত, কেবল সুখস্মৃতি। মন্দির থেকে বেরিয়ে বিশ্বকর্মা থেকে সাবিত্রী একে একে সব দর্শন হল। এরপর পুবের দরজার বাঁদিকে কলেবর সমাধিক্ষেত্রে গেলাম। নব কলেবর প্রাপ্তির পরে জগন্নাথদেবের পুরনো বিগ্রহ এখানে সমাধিস্থ করা হয়। কালের ও প্রকৃতির নিয়মে তা মিশে যায় মাটিতে। নতুন-পুরনোর চক্র। অস্তিত্বটা থেকেই যায়। সদানন্দ পান্ডা হঠাৎ বলে উঠল, ‘বসে থাকলে শিব আর চিরকালের মতো শুয়ে পড়লে শব’। কথাটা বেশ মনে ধরেছে।
সে সময় ভোগ রান্নার ঘর দেখা যেত। ছোট ছোট ঘুলঘুলির মধ্যে দিয়ে দেখতে হত, এখন সে সব-ও অতীত। এখন আনন্দ বাজারে দেবতার মহাপ্রসাদ পাওয়া যায়। বসে খাও, নিয়ে যাও, নানা ব্যবস্থা। মন্দিরের দক্ষিণ দরজা দিয়ে বেরনোর আগে আনন্দ বাজারে সারাদিন প্রসাদ বিতরণ, বসে ভোগ সেবা চলছে।
ধ্বজা পরিবর্তন
মন্দির চত্বর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে পৌনে পাঁচটা। লক্ষ্য করলাম, সকলের চোখ মন্দিরের শীর্ষে পতাকার দিকে। কি ব্যাপার? জানা গেল মন্দির শীর্ষের ধ্বজা পরিবর্তন করা হবে। পান্ডাজি এক রিক্সা ঠিক করে চলে গেল নিজের বাইকে। আমরা দুজন ওই রিক্সায় বসে আশ মিটিয়ে ধ্বজা পরিবর্তনের পর্যায়ক্রম দেখলাম। সারা গায়ে নতুন ধ্বজা বেঁধে নিয়ে অত উঁচুতে কি অনায়াসে একেবারে চূড়ায় উঠে পড়লেন একজন। তারপর পুরনো ধ্বজা নামিয়ে উড়িয়ে দিতে লাগলেন নতুন ধ্বজা। কোথা থেকে বাতাস এল বাঁধভাঙা স্রোতের মতো। পত পত করে উড়তে লাগলো ভক্তের, ভগবানের জয়-পতাকা। ধ্বজা পরিবর্তনের পরে মশালের মত আলো নিয়ে ওই শীর্ষে দাঁড়িয়ে আরতি করলেন মানুষটি। যেন ঘোষিত হল, জয় হোক জীবের, জয় হোক সর্বশক্তিমানের।
মন্দির থেকে ফিরে গোধূলীবেলায় সমুদ্র সৈকতে এলাম। জমজমাট সৈকত। বিক্রি হচ্ছে চা, ছোট আকারের অনবদ্য স্বাদের সিঙ্গাড়া, পুরী সৈকতের সিগনেচার মিষ্টি মদনমোহন। সমুদ্রে আঁধার নামল। চিকচিক করে উঠছে ঢেউয়ের ফেনা। সমুদ্রের গর্জনে যেন নেশা ধরে যায়। কোন সুদূর থেকে বয়ে আসছে উথালপাথাল হাওয়া। সন্ধ্যা কাটিয়ে হোটেলে ফিরলাম।
দ্বিতীয় পর্বেঃ চৈতন্যদেবের স্মৃতিবিজড়িত পুরীধাম
কনডাক্টেড ট্যুরে
ভেবেছিলাম এবার পুরী এসে আর কোথাও এদিক ওদিক বেড়াব না। নির্ভেজাল অবসর কাটাব। তা হবার জো নেই। পুরনো স্মৃতির উস্কানি, সঙ্গে ঐতিহ্যের হাতছানি। ঠিক করলাম, একদিনের সফরে বরং বেড়িয়ে আসা যাক। সে সময় (১৯৮০) সাগরিকা হোটেলের পাশে ছিল মুখার্জি ট্র্যাভেলস, কনডাক্টেড ট্যুর করাতো। ওড়িশা সরকারের পর্যটন বিভাগের একটা অফিস আছে স্বর্গদ্বারে, রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রথমে ওখানে গেলাম। একেবারে পিছন দিকে আসন পাওয়া যাচ্ছে। হবে না। আবার একেবারে দু’জনে একটা গাড়ি নিয়ে বেড়ালে পুরনো স্মৃতি প্রশ্রয় পায় না। সারাদিনের গাইডও পাওয়া যাবে না। এইসব সাত-পাঁচ ভেবে ঠিক করলাম, কনডাক্টেড ট্যুরেই যাব। এখন পুরীতে অনেক ট্র্যাভেল এজেন্সি। ওরই মধ্যে একটাকে আপাত আসল মেনে নিয়ে তাপানুকূল লাক্সারি বাসে দুটো সুবিধাজনক আসন বুক করলাম।
পুরনো দিনে সাগরিকা হোটেলের পাশের গলি থেকে কনডাক্টেড ট্যুরের বাস ছাড়ত।এখন স্বর্গদ্বারে বড় গাড়ির প্রবেশ নিষেধ। পরের দিন সকাল সকাল স্নান সেরে বলে দেওয়া নির্দিষ্ট জায়গায় পোঁছে গেলাম। আমাদের ঠিক সামনের আসনে এক দম্পতি। সঙ্গে বছর তিনেকের একটি, আর একটা একেবারে কোলের শিশু। আলাপ হল। পুরুলিয়ার বড়ন্তিতে থাকে। গিয়েছিল ছত্রিশগড়ে, ছোট বাচ্চাটির হার্টের ছিদ্র অপারেশন করাতে। ফেরার পথে সন্তানের মঙ্গলকামনায় জগন্নাথ দর্শনে পুরী এসেছে। আজ চলেছে বেড়াতে। লিঙ্গরাজ দর্শন বিশেষ লক্ষ্য। মনে হল, এ দেশের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও ভক্তির কাছে ঈশ্বর এভাবেই বোধ হয় যুগ যুগ ধরে বাঁধা পড়ে আছেন।
চন্দ্রভাগার সৈকতে
সকাল ৯টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম পুরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরের চন্দ্রভাগা সমুদ্র সৈকতে। সূর্যের প্রথম কিরণে সমুদ্র, বালুতট আলোকময়। কিংবদন্তী বলে, এক সময় এখানে চন্দ্রভাগা নদী বইত। এখন সে নদী লুপ্ত। খড়গপুর আই আই টি-র গবেষণার ফলাফল বলছে, বিজ্ঞানীরা চন্দ্রাভাগা নদী প্রবাহের প্রমাণ পেয়েছেন। পুরান আনুসারে, কৃষ্ণপুত্র শাম্ব তাঁর রূপের গর্ব প্রকাশ করলে কৃষ্ণের অভিশাপে শাম্ব কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন। দেবর্ষি নারদের পরামর্শ মেনে দ্বারকা থেকে এসে এই সূর্যক্ষেত্রে বারো বছর তপস্যার পর সূর্যদেবের বরে শাম্ব রোগমুক্ত হন। মাঘীপূর্ণিমায় এই চন্দ্রভাগা নদীতে স্নান করে শাম্ব সুস্থ হয়ে ওঠেন।
সেই চন্দ্রভাগা নদী লুপ্ত বা গুপ্ত। তবে এই সমুদ্র সৈকতে সূর্য প্রকট। আলোকোজ্জ্বল চন্দ্রভাগা সমুদ্র সৈকত বেশ ভালো লাগছিল। সূর্যের প্রতিফলিত আলো সমুদ্রের জলের ঢেউয়ের ওপর শতগুনে বিকশিত, তাকানো যায় না । সৈকতে আলাপ হল মেদিনীপুর থেকে আসা এক পরিবারের সঙ্গে। দুই কন্যা-সহ মা-বাবা। এ ভাবেই ব্যাটন স্থানান্তরিত হয় প্রজন্মান্তরে। সমুদ্র সৈকতের আশেপাশে এখনো বিধ্বংসী ঝড়ের চিহ্ন। ভাঙ্গা গাছ, ছড়ানো ছেটানো ডালপালা। যত সুন্দর সৈকত তত ভালো নয় ভ্রমণার্থীদের জন্য ব্যবস্থাপনা।
কোনারকের সূর্যমন্দির
চন্দ্রভাগা সমুদ্র সৈকত থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ মনুমেন্ট কোনারকের সূর্য মন্দির। কৈশরে বাবা-মা’র সঙ্গে যখন এসেছিলাম, নেমে পড়েছিলাম একটা রেস্তোরাঁর সামনে। দুপুরের খাবারের কথা বলে অগ্রিম দিয়ে তবে মন্দির দেখতে যাওয়া হয়েছিল। এখনো সেই নিয়ম। তবে এখন অগুনতি হোটেল, রেস্তোরাঁ। গাইডের পরামর্শ মতো খাবার বলে অগ্রিম টাকা জমা দিয়ে এগিয়ে চললাম সূর্যমন্দিরের দিকে। সে সময় খেয়েছিলাম চিল্কার বাঘা পার্শে। এখন ওসব নেই, অন্ধ্রের রুই কাতলাই ভরসা। প্রায় মিনিট পনের হেঁটে টিকিট ঘর। গাইড অনলাইনে টিকিট কেটে রেখেছিল। তাই তেমন লাইনের ঝামেলায় পড়তে হল না।
সঙ্গে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া অনুমোদিত গাইড এলেন আমাদের ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। যে-কোনও প্রাচীন মনুমেন্ট প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে গাইডের ধারাবিবরণে। মহারাজা নরসিংহদেব ১২০০ শতাব্দীতে ১২০০ কুশল কারিগর দিয়ে, ১২ বছরের সংগৃহীত রাজস্ব খরচ করে এবং ১২ বছর সময় ব্যয় করে ২২৮ ফুট উঁচু এই মন্দির তৈরি করেন। মন্দিরের প্রবেশ পথে, সিংহদুয়ারে বিশালাকৃতির এক সিংহ, তার নীচে মত্ত হাতি, তার শুঁড়ে একটা মানুষ। বলা হয়, এই মূর্তিটি প্রতীকী।মানুষের অহংকার পদদলিত হলে তবেই আসে সিংহের শৌর্য। আজ থেকে ৪২ বছর আগে যে সূর্যমন্দির দেখেছিলাম, তা একইরকম নেই। অনেকাংশে নষ্ট হয়ে গেছে। সময়ের আঘাতে নষ্ট হয়েছে হয়তো। আমরা আরও সচেতন ভাবে রক্ষা করতে পারিনি, তা-ও হতে পারে । নষ্ট হয়ে ভেঙে গেছে কোনারক মন্দিরের অনেক সময়চক্র। চক্রগুলি দিনের চতুঃপ্রহরকে নির্দেশ করে। মানুষ, সমাজ, জীবনের নানা পর্যায় অসাধারণ সব ভাস্কর্যের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এই মন্দিরে। তা আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে গাইডের বর্ণনায়। দিনেরবেলা সময়চক্রের দণ্ডের ছায়া আনুমানিক সময় নির্দেশ করছে আজও। চক্রগুলি আসলে সূর্যঘড়ির কাজ করে।
মন্দিরের নীচে থেকে উপর পর্যন্ত অবাক করা সব ভাস্কর্য। নীচে নানান জীবজন্তু, একেবারে ওপরের দিকে দেব-দেবীর মূর্তি, মাঝের স্তরে মৈথুনরত মানব-মানবী। এ ছাড়াও রয়েছে কিছু অদ্ভুত প্রাণীর ভাস্কর্য। মাছের মত শরীর তো ড্রাগনের মত মুখ। এ থেকেই হাঁসজারু এসেছে কি না বলতে পারি না। এমন ভাস্কর্য দেখেছিলাম হাম্পিতে, মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহোতেও।
বেশ মনে পড়ে, ১৯৮০ সালে একদম উপরে উঠেছিলাম। আর কোনদিন তা সম্ভব হবে না। ভেঙ্গে নষ্ট হয়ে গেছে। গাইডের সাহায্যে ঘন্টা দুই ধরে ঘুরে ঘুরে দেখলাম কোনারকের মন্দির, অনেকদিন পরে। খাজুরাহো মন্দিরে সরকারি গাইড সারাদিন সঙ্গে থাকে, এখানে তা হল না। খাজুরাহোর স্থাপত্য অনেক বেশি সুরক্ষিতও বটে। কোনারকের সূর্যমন্দির প্রাকৃতিক কারণে, ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে সমুদ্রের অদূরে হওয়ায় আরও তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গর্ভমন্দিরের মাথায় রাখা চুম্বকের জাহাজ টেনে আনা, জলদস্যুদের সে চুম্বক খুলে নেওয়ার কারণে মন্দির ভেঙে পড়ার গল্প প্রচলিত রয়েছে। সে-সব কাহিনি কোনারকের সূর্যমন্দির দর্শনকে আরও মোহময় করে তোলে। আমরাই সবার শেষে ফিরলাম। হোটেলের সামনে বাসের গাইড আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। চিল্কার পার্শে মাছের অভাব বোধ করতে করতে খিদে পেটে সব খাবারই খুব ভালো লাগল।
লিঙ্গরাজ মন্দির
পরের গন্তব্য ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির। ৯০০ বছরের প্রাচীন মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী দেখবার মতোই। এই মন্দিরে পূজিত লিঙ্গরাজ দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম। শিব ও বিষ্ণুর যুগল প্রতীক পূজিত হন এখানে। শিবের জন্য বেলপাতা, বিষ্ণুর জন্য তুলসী পাতা ব্যবহৃত হয় পুজোয়।
উদয়গিরির ডাব
লিঙ্গরাজ প্রভু দর্শনের পরে আমাদের বাস চলল উদয়গিরি ও খণ্ডগিরির পথে। জৈন ও হিন্দু মন্দিরগুচ্ছ দেখার এখানে। গুহায় অসমাপ্ত নানা ভাস্কর্য চোখে পড়ে। আগে উপরের দিকে উঠতে খুব অসুবিধা ছিল, এখন সিঁড়ি হয়ে গেছে। হঠাৎ সামনে সেই বিখ্যাত ডাব। দুপুরে ঘুরতে ঘুরতে গরম লেগে গেলে চিরকাল ডাবের জল খেয়ে তৃপ্ত হতে হয় এই উদয়গিরিতে। কেউ কেউ ডাবওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করছেন, কী হে চিনতে পারছ, আগের বার তোমার কাছেই ডাব খেয়েছিলাম। ডাবওয়ালা মুখ তুলে আপন মনে হাসে। আর বিপরীতের মানুষটি আত্মসন্তুষ্টিতে ভরপুর হয়ে ওঠেন, ঠিক চিনতে পেরেছে।
নন্দনকানন
এবার নন্দনকানন। বিকেল চারটে পর্যন্ত টিকিট মেলে। সাড়ে পাঁচটায় বন্ধ হয়। তাই একটু তাড়াতাড়ি করতে হলো। একসময় নন্দনকানন দেশের চিড়িয়াখানারগুলির মধ্যে বিশিষ্ট জায়গা করে নিয়েছিল। সত্যি কথা বলতে কী, এবার নন্দনকানন দেখে মনটা খারাপই হয়ে গেল। পরিবেশে অযত্নের ছাপ চোখে পড়ে। তথৈবচ প্রাণী সংরক্ষণ। বনের জীবজন্তুকে আটকে রেখে এমন অযত্ন করা ও তাদের প্রদর্শন ঠিক কি?
শুভেচ্ছাটাই আসল কথা
এবার ফেরার পালা। প্রায় দু’ঘন্টা টানা বাসযাত্রার পরে এসে পৌঁছলাম পুরী। সহযাত্রীদের বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে জানালাম। সকলের শরীরে ক্লান্তি মুখে হাসি। বড়ন্তির ওঁরা যেন একটু মায়াবী, বলল আবার দেখা হবে। হয়তো হবে, হয়তো হবে না। শুভেচ্ছাটাই তো আসল কথা। ফিরে এলাম হোটেলে। সমুদ্রের চেনা গর্জনে, দূরাগত বাতাসে কী শান্তি।
2 Comments
Good but I want to know the cost of food, hotel & travel, thank you
[…] প্রথম পর্বের লেখাটি পড়তে পারেন এই লিঙ্কেঃ https://torsa.in/bengalis-puri-1st-episode/ […]