প্রতি বছর এপ্রিল এলেই ভাবতাম যাই। অতঃপর ২০২৩-এর মে মাসে যাওয়া হল। সিকিমের বার্সে বা ভার্সে। এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিম সিকিমের সিঙ্গালিলা রেঞ্জের বার্সে মানে রডোডেনড্রন ফুলের রাজ্যপাট। শুধু ফুলের জন্যই একটা অভয়ারণ্য। বার্সে রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারি। ১০৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সেই অভয়ারণ্যের বিস্তার।
হিলে থেকে সাড়ে ৪ কিলোমিটার ট্রেক করে বার্সে পৌঁছাতে হয়। সেই ট্রেকপথ এবং বার্সে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, পাণ্ডিম, কাব্রু ডোম (উত্তর ও দক্ষিণ), কুম্ভকর্ণ শৃঙ্গের দৃশ্যাবলী প্রাণ মাতিয়ে দেয়। বার্সের অরণ্য রেড পান্ডার বড় প্রিয় আবাস। তবে তাদের দেখা পাওয়া ভার। এ বছরও রডোডেন্ড্রনের মরসুমে (এপ্রিল-মে) অনেকে বার্সে যাবেন পাহাড়ের রং বদলের সাক্ষী থাকতে। এখানে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরলাম।
২০২৩-এর মে মাসের এক সকালে এন জে পি থেকে আমরা কয়েকজন রওনা দিয়েছিলাম বার্সের উদ্দেশে। পথে সারা হয়েছিল ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চ।জোড়থাং হয়ে আমরা যখন ওখরেতে পৌঁছোলাম তখন বেলা গড়িয়ে বিকেল। আজ ওখরেতে রাত্রিবাস। এখান থেকে হিলে এগারো কিলোমিটার। হিলে থেকে বার্সের ট্রেক শুরু হয়। আমরা থাকলাম ওখরেতেই। কারণ, তুলনামূলক ভাবে ওখরে একটু বড় জনপদ। এখানে হোটেল, হোমস্টের সংখ্যাও বেশি। হিলেতে হোমস্টে আছে, তবে সীমিত।
সকালে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম হিলের পথে। ঠিক হল, সবাই ন্যূনতম লাগেজ নিয়ে উপরে উঠবো। বাকি লাগেজ থাকবে ড্রাইভার বাইচুংয়ের বাড়িতে। হিলে পৌঁছে সব সদস্য এবং ক্যমেরার টিকিট কাটা হল। খুশির মেজাজ। তোরণের সামনে দাঁড়িয়ে চলতে থাকল যথেচ্ছ ফটোসেশন।গৌতম,বিমল,কল্যাণ,উজ্বলদের মতো একদল তরুণ তুর্কির সঙ্গে আমরা সিনিয়ররা বেশ মানিয়ে নিয়েছি ।গেটের পাশেই রাখা ছিল গোছা গোছা জংলি বাঁশের লাঠি। গুরাসকুঞ্জে ভালো জায়গা ‘দখলের’ একটা ব্যপার আছে। বিলম্ব চলে না। সবাই একটা করে লাঠি হাতে নিয়ে শুরু হল পাহাড়ি পথে আমাদের চলা।
কিছুক্ষন পর কেউ কেউ এগিয়ে, কেউ বা পিছিয়ে । চারপাশ সবুজে ঢাকা খুবই সংকীর্ণ রাস্তা, পাশাপাশি খুব জোর তিনজনের হাঁটার জায়গা।এক পাশে খাড়াই, অন্য পাশে গভীর খাদ। জঙ্গলের ঘনত্ব, সঙ্গে নিরবতা বাড়তে থাকে। আমাদের মতো অনেকেই যাচ্ছেন। আবার নেমেও আসছেন কেউ কেউ। চলায়, আনুভবে মগ্ন। হঠাৎ সামনে একটা শেড। অনকেই একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন । ট্রেকার্সদের জন্যই ব্যবস্থা। আমরাও বসে পড়লাম।
আবার এগিয়ে চলা।সেঁতসেঁতে রাস্তা। দু’পাশের গাছ থেকে খসে পড়া গুরাস ফুল রাঙিয়ে দিয়েছে রাস্তা কোথাও কোথাও। অচেনা কত গাছ, কত রকমের পাখির ডাক যে শুনছি। অবাক লাগে।
এতক্ষনে তিন তিনটে বিশ্রামের জায়গা আমরা পরিয়ে এসেছি। মানে তিন কিলোমিটারের বেশি হেঁটেছি। বার্সে থেকে নেমে আসতে থাকা এক পরিবারকে জিজ্ঞেস করতে জানালো, সামনেই আমাদের গন্তব্য। দু’পাশে নানা রঙের রডোডেনড্রন। কয়েকদিন আগের বৃষ্টি এবং তুষারপাতের কারণে ফুলের সংখ্যা কম। যা আছে তাই বা কম কী। ক্রমশ উদিত হল আমাদের আবাস, গুরাসকুঞ্জে পৌঁছালাম।
আমাদের সময় লেগেছে আড়াই ঘন্টার মতো, আবহাওয়া ভালো এখন। গুরাসকুঞ্জের কয়েকটা ছবি তুললাম। আমাদের জন্য বরাদ্দ গুরাসকুঞ্জের ডরমেটরি। কেয়ারটেকার আমাদের জায়গা এবং ব্যবস্থাদি দেখিয়ে দিলেন। ব্যাগপত্তর রেখে দুপুরের লাঞ্চ সেরে নেওয়া গেল। তারপর চারপাশটা একটু ঘুরে দেখলাম। ডান দিকের গেট থেকে সামনের রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে পেয়ে গেলাম একটা ভিউ পয়েন্টে। দু’পাশে রডোডেনড্রনের বন। আকাশ মেঘলা থাকায় সে ভাবে কিছু দেখতে না পেলেও একাংশে একদল স্কুল পড়ুয়ার নাচ-গানে উচ্ছ্বসিত পরিবেশটা ভারি সুন্দর লেগেছিল।
সে দিন ছিল গুড ফ্রাইডে। অনেকেই ভিড় জমিয়েছিলেন গুরাসকুঞ্জের আশেপাশের এলাকায়। ট্রেক করে বেড়াতে আসা, আবার ফিরে যাওয়াও। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিরতে শুরু করলেন ওঁরা, আপন গন্তব্যে। ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল। এখানে রাত্রি যাপনের সযোগ খুবই সীমিত। রয়েছে গুরাসকুঞ্জ আর ফরেস্ট গার্ড ব্যারাক। তবে সব দিক থেকে গুরাসকুঞ্জই সেরা। একে আর পাঁচটা পাহাড়ি এলাকার হোটেল বা হোমস্টের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না কিন্তু। জঙ্গলের পরিমণ্ডলে রাত্রিবাসের জন্য আবশ্যিক সুযোগ-সুবিধাগুলো রয়েছে। দশ হাজার ফুট উচ্চতায় , জঙ্গলে ঘেরা বিদ্যুতবিহীন এ রকম এক পান্ডব বর্জিত জায়গায় বেশি আশা করাটাও ঠিক নয়। গুরাসকুঞ্জে ডর্মেটরি ছাড়াও দু শয্যার ঘর রয়েছে। আছে টেন্টের ব্যবস্থাও।
আজ গুরাসকুঞ্জ হাউসফুল। গোটা চারেক টেন্ট পড়েছে সামনের মাঠে। এখানে ইলেক্ট্রিসিটি নেই, মোমবাতি ভরসা। চা আর পপকর্ণ সহযোগে শুরু হল আমাদের সান্ধ্য আড্ডা। চলল ঘন্টা খানেক। রাত আটটাতেই ডিনার। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। মাঝরাতে উঠেছিলাম কল্যাণকে সঙ্গে নিয়ে। গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা গুরাসকুঞ্জ। চারপাশ শুনশান। অন্ধকার ঠেলে টর্চের আলো হাতে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম আমরা। বিছানায় ফিরে যাওয়ার আগে নীচের দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম গুরাসকুঞ্জের বারান্দায়। ঝোড়ো হাওয়া বইছে বাইরে। বেশ ঠান্ডা এই মে মাসে। অকস্মাৎ নীরবতা ভেঙে সামনের গাছে রাতচরা পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দে চমকে উঠেছিলাম। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সামনে তাকিয়ে আমি। বনজোৎস্নায় উদ্ভাসিত চারিদিক। পথশ্রম সার্থক মনে হল। অন্তত একটা রাত গুরাসকুঞ্জে কাটানোম একটা অন্য রকমের অভিজ্ঞতা। পৃথিবীটাকে আরেক রূপে আবিষ্কার করা যায়। বার বার ফিরে আসা যায় এখানে।
যাওয়ার পথঃ এন জে পি থেকে গাড়ি ভাড়া করতে পারেন। শেয়ার গাড়িতে এন জে পি থেকে জোরথাং যাওয়া যেতে পারে। তারপর অন্য গাড়িতে জোরথাং থেকে ওখরে। ওখরে থেকে পরের দিন সকালে হিলে। ওখান থেকে ট্রেক করে বার্স। ওখরে থেকে একই দিনে হিলে চলে এসে রাতটা হিলেতেও থাকা যেতে পারে। এন জে পি/ শিলিগুরি থেকে ওখরে ১২৬ কিলোমিটার। জোরথাং থেকে ওখরে কমবেশি ৪০ কিলোমিটার। এন জে পি থেকে জোরথাং কম`ন ৮৫ কিলোমিটার।
থাকার ব্যবস্থা
ওখরেঃরয়্যাল বার্সে হোমস্টেঃ 89428 31875, ওখরে শলাকা হোমস্টেঃ 81458 84156, বার্সে রিট্রিটঃ 98003 98309, খাম্বা হোমস্টেঃ 95939 71207
হিলেঃ মাশরুম হাট হোমস্টেঃ 70296 96081।
বার্সেঃ গুরাসকুঞ্জঃ 98003 98309, 74785 40541