ডি ভি সি-র উচ্চপদের চাকরি থেকে আগাম অবসর নিয়েছেন বেড়ানোর জন্য। সুব্রত ঘোষ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পেশা থেকে এখন ভ্রমণের আঙিনায়।বেড়ান বছরভরই। সস্ত্রীক বেরিয়ে পড়েন দেশের নানা প্রান্তের বিভিন্ন ভ্রমণ ঠিকানার উদ্দেশে। এবার অরুণাচল ভ্রমণের কথা। সঙ্গে অসমের কাজিরাঙ্গায় জঙ্গল সাফারি। জলযানে ব্রহ্মপুত্রে ভেসে পড়া। কামাক্ষার মন্দির দর্শন। প্রথম কিস্তির ভ্রমণ-কথা।
সকাল দশটা চল্লিশের বিমানে কলকাতা থেকে গুয়াহাটির উদ্দেশে রওনা দেওয়া গেল। মূল গন্তব্য অরুণাচল প্রদেশ। সঙ্গে অসমের খানিকটা। দিনটা ২২ এপ্রিল, ২০২৪। ঘন্টাখানেক সময় লাগল গুয়াহাটির বন্দরে পৌঁছাতে। গুয়াহাটির পানবাজারের হোটেলে পৌঁছালাম বেলা ১টা নাগাদ। অগ্রিম বুকিং ছিল।
মধ্যাহ্নভোজন সেরে একটু বিশ্রাম। বেলা সাড়ে ৩টে নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম হোটেল থেকে। ব্রহ্মপুত্র নদী বা নদে ভেসে পড়ার ব্যবস্থা আছে গুয়াহাটিতে। পানবাজার থেকে সেখানে পৌঁছালাম একটা অটোয়। ভাড়া নিয়েছিল ১৫০ টাকা। সূর্যাস্তের সময় জলভ্রমণের স্লট-টি বেশ জনপ্রিয়। ওই স্লটেরই (বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা) আসন বুক করলাম। আপার ডেকের আসন। মাথাপিছু ভাড়া ৭৫০ টাকা।
ঢলে পড়া সূর্যের আলোয় রঙের ছোপ লাগল ব্রহ্মপুত্রে। সেই তিব্বতের (চিন) মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসছে এ নদী। উৎপত্তি হিমালয়ের কৈলাশ পর্বতশ্রেণির অভ্যন্তরে। নদী সীমানা জানে না। ব্রহ্মপুত্র ভারতে প্রবেশ করেছে অরুণাচল প্রদেশের মধ্যে দিয়ে, তারপর অসম ও বাংলাদেশ হয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। জলযান থেকে নদীর ওপারে উমানন্দ মন্দির সুন্দর লাগছিল দেখতে। মৃগানন্দ মন্দিরটিও দেখা গেল ব্রহ্মপুত্র থেকে। সন্ধ্যার নদী, জলে বিভিন্ন জলযানের রঙিন আলোর প্রতিফলন, আর গুয়াহাটি শহরের আলোকমালা বেশ লাগল। অটোয় চড়ে হোটেলে ফিরলাম।
পরের দিন অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল ব্রেকফাস্ট সেরে সড়কপথে ভালুকপঙের উদ্দেশে রওনা দেওয়া গেল। গুয়াহাটি থেকে অরুণাচল প্রদেশের পশ্চিম কামেং জেলার ভালুকপং ২৩৭ কিলোমিটার। অসমের মঙ্গলদই, খারুপেটিয়া, দলগাঁও, রাঙাপাড়া, বালিপাড়া হয়ে গাড়ি চলেছে। এই বালিপাড়া থেকে ভালুকপঙ যাওয়ার পথে পড়ে নামেরি অরণ্য। পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে, অসমের সোনিতপুর জেলায় অবস্থিত নামেরি একটি জাতীয় উদ্যান। বালিপাড়ার পরে রাস্তার দু’পাশের ঘন সবুজ চায়ের বাগিচাগুলি চারপাশের দৃশ্যপট পাল্টে দিল।
বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ ভালুকপঙ পৌঁছালাম। গুয়াহাটি থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল সকাল সাড়ে ৮টায়। অরুণাচল প্রদেশের পশ্চিম কামেং জেলায় ভালুকপঙ একটি ছোট্ট শহর। ভালুকপঙে প্রবেশের আগে চেকপোস্টে পারমিট (ইনারলাইন পারমিট) দেখাতে হয়। অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশের পারমিটের জন্য অনলাইন আবেদন করা যায় এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমেঃ https://arunachalilp.com/index.jsp
ভালুকপঙে মণ্ডল ঘং নামের একটি হোটেলে উঠেছি। জিয়া ভরালি নদীর তীরে চমৎকার অবস্থান হোটেলটির। এই নদীর আরেক নাম কামেং। অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং জেলায় জন্ম এ নদীর। অরুণাচল, আসামের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে নদীটি। আসামের তেজপুর শহরের একটি বৈশিষ্ট এই নদীটি। বিকেলে জিয়া ভরালি তথা কামেংয়ের পার ধরে খানিক বেড়িয়ে এলাম। পূর্ব ভারতের অন্দরে পাহাড়-জঙ্গলের সঙ্গে বুনোট বাঁধা নদীটিকে ওই বিকেলে খুব আপনার বলে মনে হচ্ছিল।
পরের দিন (২৪ এপ্রিল) প্রাতরাশ সেরে ৯টা নাগাদ দিরাংয়ের উদ্দেশে রওনা দিলাম। পথে দেখলাম টিপ্পি অর্কিড গার্ডেন। এটি একটি গবেষণা কেন্দ্রও। পূর্ব ভারতের দুষ্প্রাপ্য সব অর্কিডের দেখা মেলে এখানে।
বমডিলা শহরের কেন্দ্রে বমডিলা মনাস্ট্রি দেখতে গিয়েছিলাম। মহাযানপন্থী বৌদ্ধদের বিহার। দক্ষিণ তিব্বতের সোনা গনসে (Tsona Gontse Monastery) মনাস্ট্রির সঙ্গে খুব নাকি মিল রয়েছে এই বমডিলা মনাস্ট্রির।
বমডিলায় একটি মিলিটারি স্যুভেনির শপ আছে। খানিকটা সময় কাটল সেখানে। তারপর গিয়েছিলাম নাগ মন্দিরে। পশ্চিম কামেং জেলার সিংচুং ব্লকের এই মন্দিরটিকে আঞ্চলিক মানুষজন খুব মেনে চলেন দেখলাম। মন্দিরটির স্থাপনার পিছনে লোকমুখে প্রচলিত একটি গল্প আছে। ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে ভালুকপং-তাওয়াং সড়ক নির্মাণের সময়ে দুটি সাপের আনকাগোনা চলত নির্মাণ এলাকায়। একটি সাপকে মারে এক নির্মাণ কর্মী। হিংস্র হয়ে ওঠে আরেকটি সাপ। নির্মাণের কাজেও নানা বিপত্তি আসতে শুরু করে। মন্দিরটি তৈরি হয় ওই সময়ে।
মধ্যাহ্নভোজন হয়েছিল বমডিলায়। বিকেল ৪টে নাগাদ দিরাং পৌঁছালাম। পূর্বনির্ধারিত ওয়াংডি হোমস্টেতে উঠলাম। হোটেলে মালপত্র রেখে চা পানের পরে হাঁটাপথে ২ কিলোমিটার দূরের উষ্ণ পস্রবণ দেখতে গিয়েছিলাম। পথ গিয়েছে দিরাং নদীর তীর ধরে। ঘন্টাখানেক হট স্প্রিং এলাকায় কাটিয়ে হোমস্টেতে ফিরে এলাম।
এ দিন অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে। আজকের জন্য বিশ্রাম। কাল যাব তাওয়াং। দিরাং থেকে তাওয়াং ১৪১ কিলোমিটার। চলার পথের উচ্চতা বাড়তে থাকবে। তাওয়াংয়ের গড় উচ্চতা ১১,৫০০ ফুট।
তাওয়াং বেড়ানোর কথা পরের কিস্তিতে।
ফটোঃ লেখক