প্রথম পর্ব
১৪ অক্টোবর,’২১। নবমীর সকাল। সময়মতোই পৌঁছে গেলাম হাওড়া স্টেশনে। হাওড়া-রাঁচি শতাব্দী এক্সপ্রেস ছাড়ল ঠিক ৬টা ১৫ মিনিটে। এবার বেড়ানোর তালিকায় রয়েছে পাত্রাতু উপত্যকা, নেতারহাট, বেতলা, ম্যাকলাস্কিগঞ্জ এবং রাঁচির আশপাশটা। মাসখানেক আগে পরিকল্পনা ছকে ট্রেনের টিকিট এবং ঝাড়খণ্ড পর্যটনের নানা হোটেলে ঘর বুক করে রেখেছিলাম। হু হু করে পৌঁছে গেলাম রাঁচি, দুপুর ১২-৫০-এ।
পাত্রাতু
প্রথম গন্তব্য পাত্রাতু। যাত্রা শুরু হল। রাঁচি থেকে পাত্রাতু উপত্যকা ৫০ কিলোমিটার। খানিক যাওয়ার পর শুরু হল উপত্যকায় নামার অপূর্ব রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে খানিকটা এগনোর পর হঠাৎ দেখা গেল, এক জায়গায় বেশ কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে। আমরাও নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। জায়গাটা পাত্রাতু ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে সমগ্র পাত্রাতু উপত্যকা এবং তার একের পর এক বাঁক নেওয়া রাস্তার সারিগুলো দেখা যায়। একটা বোর্ডে লেখা ‘আই লাভ পাত্রাতু’। ওটা ফটো পয়েন্ট।
ওখানকার একটা পথ বেয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম ঝাড়খণ্ড টুরিজমের ‘সরোবর বিহার’ হোটেলে। বিশাল এক লেকের ধারে একটি টিলার উপরে সরোবর বিহার। অবকাশ যাপনের অনবদ্য পরিবেশ ও আয়োজন। সরোবর বিহারের চৌহুদ্দির মধ্যে বড় বড় সব গাছ, লেকের ধারে বসার জন্য টাওয়ার। একান্তে বিশ্রাম নেওয়ার বা আড্ডা দেওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ। রাঁচি থেকে অনেক পর্যটক দিনে দিনে পাত্রাতু বেড়িয়ে বিকেলে লেকে নৌকাবিহার করে রাঁচি ফিরে যান। বোটিংয়ের ঘাটে বেশ ভিড় হয় দেখা গেল। টাওয়ারে বসেছিলাম খানিকক্ষণ। রঙের প্রভা ছড়িয়ে সূর্যাস্ত হল। আমিও ঘরমুখো হলাম।
বেশ সকালে উঠে সরোবর বিহারের মধ্যেই পায়চারি করছিলাম। হাঠাৎ মোটর বাইকে করে এক দেহাতী যুবক পাশে এসে দাঁড়িয়ে আলাপ করল। বোটিং করতে চাই কিনা জানতে চাইল ছেলেটি। বললাম, “সে তো দশটার পরে।” যুবক বলল, “এখুনি হবে”। সূর্য ওঠেনি তখনো। রাজি হয়ে গেলাম। সুন্দর একটা শিকারা। ঘন্টাখানেক ঘুরিয়ে দিল। অতবড় জলাশয়ে আমরা তিনজন। কুয়াশা ভেদ করে সূর্য উঠল।
নেতারহাট
বেরিয়ে পড়লাম পরের গন্তব্য ঝাড়খণ্ডের অন্যতম শৈলশহর নেতারহাটের উদ্দেশে। রাঁচি থেকে নেতারহাট সরাসরি ১৬০ কিলোমিটার। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা ৩,৮০০ ফুট। নেতারহাটকে ছোটনাগপুরের রাণী বলা হয়। ব্রিটিশ আমলে জঙ্গল, পাহাড় অতিক্রম করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে সাহেবরা ছুটে যেত জায়গাটায়। ওরা বলত ‘নেচারস হার্ট’। কালক্রমে মুখে মুখে হয়ে গেল নেতারহাট। এটা একটা মত। নেতারহাট নামকরণের পিছনে আরেকটা মতও আছে। স্থানীয়দের মতে অনেক আগে এখানে ‘নেতার’ মানে বাঁশ বিক্রির হাট বসত। তাই জায়গাটার নাম নেতারহাট।
পাত্রাতু থেকে একের পর এক বাঁক ফেরানো রাস্তা ধরে উঠে এলাম জাতীয় সড়কে। অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা রাস্তার দু’পাশে। কোথাও সবুজ ধানখেত, কোথাও পাকা ধানের খেতে সূর্যের তীর্যক আলোয় যেন সোনা গলে পড়ছে। গরু চরাচ্ছে আদিবাসী নারী-পুরুষ। হাতে একটা করে লাঠি। ছোটবেলায় যেমন বইয়ে পড়েছিলাম, ছোটনাগপুর যেন একটা উল্টোনো কড়াইয়ের মতো, তেমনটাই দেখছি। জঙ্গলের পথে বাঁদরের দল চোখে পড়ছে।
সকালে বেরিয়েছি। জলখাবার খেয়ে বেরোইনি, রাস্তায় একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে, এই ভেবে। প্রায় ১০০ কিলোমিটার চলে এলাম। খিদে পেয়েছে, প্রাকৃতিক শোভায় মশগুল হয়ে ছিলাম, খিদেটা যেন চাগাড় দিয়ে উঠল। ছোট্ট একটা দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করানো হল। ডিমটোস্ট আর চা, প্রচণ্ড খিদের মুখে, আহা, সে যেন অমৃত।
খাওয়াদাওয়া সেরে আবার চলেছি। জমির প্রকৃতি, গাছপালার ধরন পাল্টে যাচ্ছে। শুদ্ধ বাতাস। শরীরে ক্লান্তি নেই। হঠাৎ নদীর উপরে একটা পুরনো সেতু। পেরিয়ে ডানদিকে বনপথ। সেই পথে নেমে গেল গাড়ি। নুড়ি পাথর, বড় আকারের পাথর, সে-সবের মধ্যে দিয়ে পথ করে নিয়ে বয়ে চলেছে চঞ্চলা কোয়েল নদী। পালামৌর জঙ্গল থেকে নেমে এসে চলেছে আপন খেয়েলে।
এবার ভালো বর্ষা হয়েছে। নদী ভরভরন্ত। তবে উদ্ভ্রান্ত নয়। জলে পা ডুবিয়ে একটা পাথরের বসে রইলাম খানিকক্ষণ। জলের নীচে হলুদ রঙের বালি। নেমে পড়লাম জলে। আমাকে ছুঁয়ে বয়ে চলেছে নদীর ধারা। এক অদ্ভুদ খুশিতে মনটা ভরে এল।
আবার চলা। উঠব ঝাড়খণ্ড পর্যটনের পর্বত বিহার হোটেলে। নেতারহাট বাসস্ট্যান্ড থেকে ৭০০ মিটার দূরে আদিবাসী গ্রামের মধ্যে হোটেলটির অবস্থান। এক জায়গায় লেখা, ‘সানরাইজ ভিউ পয়েন্ট’। নেতারহাটের সানরাইজ বিখ্যাত, আর এই হোটেলটাই একটা ভিউ পয়েন্ট। সানরাইজ ভিউ রুম বুক করা ছিল আমাদের। ম্যানেজার ভদ্রলোক জানালেন, “আগে ঘর থেকেই সানরাইজ দেখা যেত, এখন ওদিকের পাহাড়ের ঢালে শাল, মহুয়া লম্বা লম্বা হয়ে গেছে। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায়। তবে আপনাদের ঘরের পাশের ছাদ থেকে ভালো দেখা যাবে।”
দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়লাম নেতারহাটের আশপাশটা দেখব বলে। একটু এগতেই পাইনের সারি। চমৎকার রাস্তা পাহাড়ের প্রান্তে কোয়েল ভিউ পয়েন্ট। যে নদীর সঙ্গ করে এলাম তা কেমন পাহাড়, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ করে নিয়ে চলেছে তা খুব ভালো দেখা যায় এখান থেকে। প্রায় পাশেই নেতারহাটের বিখ্যত ন্যাসপাতির বাগান। ছোটনাগপুর মালভূমির সর্বোচ্চ (৩৫১৪ ফুট) জায়গা এই নেতারহাটের বিশাল ন্যাসপাতি বাগিচা জুলাই-অগস্ট মাসে ফলে ফলে ছয়লাপ হয়ে থাকে।
ন্যাসপাতি বাগান খানিকটা এগলেই আপার ঘাঘরা জলপ্রপাত। লোয়ার ঘাঘরা ১০ কিলোমিটার দূরে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ধাপ বেয়ে খানিক নেমে গেলেই আবিরাম জলধারার নেমে আসার দৃশ্য। সেইসঙ্গে জলপতনের শব্দ।
আজ দশোহরা। বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে। গ্রামের মেয়ে-বৌ’রা সেজেগুজে বেরিয়ে পড়েছে। চোখে-মুখে খুশির আভা। কারো কারো কোলে বাচ্চা। নেতারহাটের ম্যাগনোলিয়ে পয়েন্ট থেকে ভালো সূর্যাস্ত দেখা যায়। সূর্য চলে যায় বিন্ধ্য পর্বতের আড়ালে। নেতারহাটের প্রধান বাসস্ট্যান্ড থেকে ম্যাগনোলিয়ে পয়েন্ট ১০ কিলোমিটার।
নেতারহাটের সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে নেতারহাট আবাসিক বিদ্যালয়টি। গুরুকুল পদ্ধতিতে আধুনিক পড়াশোনার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। ১৯৫৭ সাল থেকে দেশকে অনেক মেধাবী ছাত্র উপহার দিয়েছে এই বিদ্যালয়। রাস্তায় দেখা কয়ে৩কতি ছাত্রের সঙ্গে। পরনে ধুতি, পাঞ্জাবীর ওপর কোট। উজ্জ্বল দৃপ্ত চোখ। স্কুলের অদূরে ব্রিটিশ স্থাপত্যের চ্যালেট হাউস। হেরিটেজ বাড়ি এটা। ভিতরে একটা মিউজিয়াম আছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল। ফিরে এলাম পর্বত বিহারে।
সূর্যোদয় দেখব বলে ভোরে উঠে পড়েছি। শৈলশহর। পরনে হালকা শীতের পোশাক। সূর্যোদয়ের সাক্ষী থাকতে ভিউ পয়েন্টে জড়ো হয়েছে অনেকে। চারিদিক কুয়াশায় এঁটে এসেছে। চলে গেলাম ছাদে। দু’-এক ঝলক রোশনাই দেখা গেল।
আজকের পথ আরও লম্বা। পথে কয়েকটা জলপ্রপাত দেখব। যাচ্ছি বেতলার জঙ্গলে।
হোটেল সরোবর বিহার, পাত্রাতু, ফোন ৯৯০৫৯০০১৪৯। হোটেল পর্বত বিহার, নেতারহাট, ফোন ৯১০২৪০৩৮৮৩।
ক্রমশ-