চেরাপুঞ্জির সকালটা দেখতে পারলে তার থেকে আর ভালো কিছু হয় না। সব মরসুমেই এ কথাটি প্রযোজ্য। বর্ষাতেও। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুম। সকালে উপত্যকাময় মেঘ। মৃদু রোদ্দুর ভেদ করে অকস্মাৎ আলোকময় বৃষ্টি। বেলায় মেঘের পরে মেঘ জমতে থাকা। পাহাড়, জঙ্গল, উপত্যকা জুড়ে প্রবল বৃষ্টি আর ঝর্নার ঝাঁপিয়ে পড়ার আওয়াজ মিলেমিশে শব্দের ছবি আঁকে। বৃষ্টি ভালোবাসেন যাঁরা, একটু আধটু ভিজতে যাঁদের আপত্তি নেই তাঁদের জন্য বর্ষার চেরাপুঞ্জি আদর্শ ভ্রমণ ঠিকানা।
সকালটা দেখতে হলে রাত্তিরটা অবশ্য চেরাপুঞ্জিতেই কাটাতে হয়। অধিকাংশ পর্যটকই শিলং থেকে কন্ডাকটেড টুরে অথবা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে চেরাপুঞ্জি-সহ মাওলিনং, ডাওকি বেড়িয়ে আসেন। মূল ডেরাটি বাঁধা থাকে শিলংয়ে।
চেরাপুঞ্জি খুঁটিয়ে দেখতে হলে ২-৩টে দিন তো লেগেই যায়। অতটা সময় না দেওয়া গেলেও অন্তত একটা দিন শুধু চেরাপুঞ্জির জন্য রাখা গেলে পূর্ব খাসি পার্বত্য অঞ্চলের রূপ রং গন্ধের একটা হদিস পাওয়া যেতে পারে।
আমরা জানি, একটা সময় পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের অঞ্চল ছিল এই চেরাপুঞ্জি। এখন সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় চেরাপুঞ্জির পাশ্ববর্তী অঞ্চল মওসিনরামে। ১৯৭১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত রেকর্ড করা হিসেব অনুসারে চেরাপুঞ্জিতে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১১,৩৬০ মিলিমিটার। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে মওসিনরামে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১১,৮৭২ মিলিমিটার।
বৃষ্টিপাতের নিরিখে মওসিনরাম প্রথম স্থানটি দখল করে নিলেও, চেরাপুঞ্জির নস্টালজিয়া, চেরাপুঞ্জির রোমান্টিকতার তুলনা পাওয়া ভার। বর্ষার চেরাপুঞ্জি তো আরও রহস্যময়। এই রোদ্দুর তো এই বৃষ্টি। উপত্যকায়, পাহাড়ের ঢালে, এমনকী চলার পথেও মেঘের চরে বেড়ানো, সে যেন জাদুকরী দৃশ্যাবলী।
নোহকলিকাই, নোহসংথিয়াং, কিনরেম, দিয়ান্তলেন, ওয়াকাবা, এগুলো সব চেরাপুঞ্জির বিখ্যাত জলপ্রপাত। বর্ষায় ও বর্ষার পরে পরে জলপ্রপাতগুলির উদ্দাম রূপ দেখে বিস্মিত হতে হয়। নোহকলিকাই ভারতের দীর্ঘতম জলপ্রপাত। সবুজ প্রেক্ষাপটে ১,১১৫ ফুট উচ্চতা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই জলধারাটি।
শিলং, চেরাপুঞ্জির পাহাড়গুলো হিমালয়ের মতো আকাশছোঁয়া নয়। ঢেউ খেলানো অনুচ্চ পাহাড় সব। আর বর্ষায় তাদের রং আশ্চর্য রকমের সবুজ। স্কটল্যান্ডে মাইলের পর মাইল জুড়ে এরকম পাহাড় দেখা যায়। সেই কারণে শিলং ও সংলগ্ন অঞ্চলগুলিকে ব্রিটিশরা ‘স্কটল্যান্ড অফ দি ইস্ট’ নামে আখ্যায়িত করেছিল।
চেরাপুঞ্জিতে ঢোকার মুখেই রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম। সঙ্গে স্কুল। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভাবধারা অনুসারী নানা বইপত্র কিনতে পাওয়া যায় এখানে।
তারপর গাড়ি দাঁড়াবে আসাধারণ এক ভিউপয়েন্টে। খুলে যাবে চেরাপুঞ্জির উপত্যকার রূপ। সবুজ পাহাড় থেকে উপত্যকার গভীরে নেমে আসছে রুপোলী সব জলধারা।
এরপর একে একে দেখবেন মাওসমাই কেভ। এটি ভারতের দীর্ঘতম গুহা। তারপর থাংখারং পার্ক। নীরব চারিদিক। ঘন্টিপোকারা ঘন্টা বাজার এখানে। এখান থেকেও প্রত্যক্ষ করবেন চেরাপুঞ্জির উপত্যকার অপূর্ব সৌন্দর্য। এই পার্ক থেকে বাংলাদেশের বিস্তৃত সমতল অংশ দেখা যায়।
দর্শনের তালিকায় থাকবে আরও অনেক কিছু। ব্রিটিশদের তৈরি প্রেসবিটারিয়ান চার্চ, অ্যাংলিকান কবরস্থান, ব্রিটিশদের তৈরি বাড়িঘর। দেখে আসতে পারেন প্রাকৃতিক বিস্ময় লিভিং রুট ব্রিজ। শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি ৫৫ কিলোমিটার।
কয়েকটি হোটেল
চেরাপুঞ্জি হলিডে রিসর্টঃ ৮৭৯৪৮০৩৮৩৩, ৯৬১৫৩৩৮৫০০। কনিফারাস রিসর্টঃ ৭০০৫৮৬৮২৩৪। ফোর সিজন ইকো রিসর্টঃ ৭৬২৮০৭১৭২৫। রয়্যাল ভিউ রিসর্টঃ ৬০০৯৩৭০৭৩০। সুলাওয়াডো রিসর্টঃ ৭৬২৯৮৪৫৪২৩। লা কুপার ইনঃ ৯৬১৫০৯৩৮৯৮। সেভেন সিস্টার্স ফলস ভিউ ইনঃ ৯৮৬২৫৪২৯৪৫।
ফটোঃ তুষার পাত্র।