পথ চলেছে দকসুম পহলগাম সিন্থন টপ আরু ভ্যালি যুসমার্গ বাংগাস ভ্যালি পাকিস্তান সীমান্তের গুরেজ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে
১২ জনের একটা দল। কেউ থাকে দিল্লি, কেউ কলকাতায়, কেউ বা থাকে শিলংয়ে। আমি আর আমার স্ত্রী ব্যাঙ্গালোর থেকে গিয়ে মিলিত হলাম সেই দলের সঙ্গে, পুরনো দিল্লির রেলওয়ে স্টেশনের নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে। দিনটা এ বছরের (২০২৩) ৫ এপ্রিল। জম্মু মেলের ২-এসি কামরায় আমাদের যাত্রা হল শুরু। আপাতত গন্তব্য উধমপুর। পরের দিন অর্থাৎ ৬ এপ্রিল সকাল আটটার মধ্যেই উধমপুর পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমাদের অত্যন্ত স্নেহের ইজাজের টেম্পো ট্র্যাভেলার স্টেশন চত্বরে উপস্থিত ছিল। তাতে উঠে ভেরিনাগের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া গেল। পথে এক ধাবায় আলুর পরোটা, টক দই ও মিস্টি-সহযোগে প্রাতরাশ সেরে এগিয়ে চললাম। পথে দুটো বিশাল টানেল অতিক্রম করতে হয়। উধমপুর থেকে ভেরিনাগের দুরত্ব কমবেশি ১২০ কিলোমিটার। তবে পথে চায়ের বিরতি, ছবি তোলার পর্ব ইত্যাদি সেরে ভেরিনাগ পৌঁছাতে প্রায় চারঘন্টা সময় লেগে গেল।
ভেরিনাগ পৌঁছে দেখা গেল, আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন। প্রচন্ড ঠান্ডা। সমতল থেকে এসে ৬০৭৩ ফুট উচ্চতার ভেরিনাগের ঠান্ডায় আমরা কিঞ্চিত বিভ্রান্ত এবং আংশিক ধরাশায়ী। যাইহোক, ঝিলমের উৎস, মুঘলদের বাগান ইত্যাদি দেখা হল ভালোভাবেই। বিকেলের পর বৃষ্টিস্নাত ভেরিনাগের অপরূপ সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করা গেল। চারিদিকের পাহাড়গুলো তুষারাবৃত। বৃষ্টির আবহে দুপুরে আচার-সহযোগে খিচুড়ি-অমলেট দিয়ে লাঞ্চ সারা হয়েছিল। জোলো ঠান্ডায় বিকেলের পর শুধু চায়ের প্রয়োজন ছাড়া কেউ আর ঘর থেকে বাইরে আসতেই চায়নি।
আজ ৭ এপ্রিল। ব্রেকফাষ্ট সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম হোটেল থেকে। রওনা হলাম পহলগামের উদ্দেশে, যাব সিন্থন টপ হয়ে । পথে দকসুমে এসে বাধাপ্রাপ্ত হলাম। এর আগেও বার দুই এই পথে এসেছি। লোকাল লোকজনের এই আচরণে আমরা যথেষ্ট আহত হলাম। এদের বক্তব্য, আমরা আমাদের গাড়িতে যেতে পারব না। যেতে হলে ওদের গাড়িতে ওদের নির্দিষ্ট ভাড়ায় যেতে হবে। একজন ভ্রমণার্থী কোনও জায়গায় যাওয়ার জন্য মনস্থির করার পর হঠাৎ মাঝ-রাস্তায় অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির শিকার হতে হলে সেটা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পর্যটন বিভাগের ক্ষেত্রে ভালো বিজ্ঞাপন নয়।
অনেককে কম ভাড়ায় গাড়িতে তুলে মাঝ-রাস্তায় বেশি ভাড়া দাবি করা হয়েছিল বলে পরে জানতে পেরেছিলাম। অন্তত একটা ঘোষিত নিয়ম থাকা দরকার তো, তাহলে আগে থেকে অন্তত অবহিত থাকা যায়। যাইহোক, ডিউটিতে থাকা এক দ্বায়িত্বসচেতন পুলিশ বা সেনা অফিসারের সহায়তা পাওয়া গেল এবং একটা সমাধানসূত্রে পৌঁছানো গেল। এই ধরণের ঘটনা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নজরে থাকা দরকার। আমাদের গাড়ি আটকানো হয়েছিল দকসুমে। অনন্তনাগ জেলার এই দকসুম কাশ্মীর উপত্যকার ভ্রমণ মানচিত্রে সাম্প্রতিক কালে যুক্ত হওয়া একটি চমৎকার টুরিস্ট স্পট।
সিন্থন টপের উচ্চতা ১২,৪১২ ফুট। একটি পাসের সর্বোচ্চ পয়েন্ট জায়গাটা। অনন্তনাগ জেলার ব্রেং ভ্যালি ও চেনাব ভ্যালির কিস্তোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়েছে এই পাসটি। একটি দুর্দান্ত ভিউপয়েন্ট সিন্থন টপ। আমরা মাঝ-পথেই বরফের দেখা পেলাম। সিন্থন টপ হয়ে অচ্ছাবলের মুঘল গার্ডেন দেখে আমরা বিকেলের দিকে পহলগামে পৌঁছলাম। পথে মার্তন্ড মন্দির বা সূর্য মন্দির দেখলাম। কাশ্মীরের এই মার্তন্ড মন্দির কোনারকের সূর্য মন্দিরের চাইতে প্রাচীন। তৈরি হয়েছিল অষ্টম শতকে।
এ দিন রাত্রিবাসের ব্যবস্থা ছিল পহলগামে। একটা কথার উল্লেখ আবশ্যক বলে মনে করছি, রমজানের সময় এখন, খাওয়াদাওয়ায় বৈচিত্রের অভাব লক্ষ্য করছি। যাঁরা খাদ্যবিলাসী, তাঁদের রমজানের মাসে কাশ্মীর ভ্রমণের সময় খাবারদাবারের ব্যাপারে খানিক আশাহত হতে হবে।
৮ তারিখ সকালে ব্রেকফাষ্টের পর আমরা রওনা হলাম আরু ভ্যালির উদ্দেশে। পথটি যেন চিরনতুন। ওক, পাইন, দেবদারুর মাঝে মাঝে এক একটা বিশাল ধসপ্রবণ বরফের ঢাল। লিডারের স্বচ্ছ জল দ্বিধাবিভক্ত। দু’পাশে বরফের চাদর। মাঝখান দিয়ে জল বইতে দেখা যাচ্ছে। সবুজের সমারোহের মাঝে মাঝে শুভ্র বরফের তুলির টান, প্রতিটি বাঁকেই আমরা মন্ত্রমুগ্ধ।
আরুর সৌন্দর্যে যদি কিছু ব্যাঘাত ঘটে থাকে তাহলে তার প্রধান কারণ ‘আমরা’, অর্থাৎ ট্যুরিস্টের ভিড়। আরু থেকে চন্দনওয়ারির দিকে রওনা হলাম। অতিরিক্ত বরফের কারণে চন্দনওয়ারি এবারও যথেষ্ট আকর্ষনীয়। এখান থেকেই অমরনাথ যাত্রার সূচনা ঘটে। আমাদের আজকের শেষ গন্তব্য বেতাব ভ্যালি। সত্যি সত্যিই যেন জায়গাটা পহলগামের বেতাজ বাদশা। বেতাব ভ্যালিতে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে পথে লাঞ্চ সেরে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম।
পরের দিন অর্থাৎ ৯ এপ্রিল সকালে আমরা যুসমার্গের উদ্দেশে রওনা হলাম। যাওয়ার পথে বিখ্যাত টিউলিপ গার্ডেন দেখে নেব। গত বছর (২০২২) অতিরিক্ত গরমের কারণে ১৮ এপ্রিল কর্তৃপক্ষ টিউলিপ গার্ডেন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল। তাই এবার টিউলিপের বর্ণময় উদ্যানটি আগেভাগে দেখে নিতে চাইছি। বিদেশের টিউলিপ গার্ডেন বা কাশ্মীরের এই টিউলিপ গার্ডেন ইউ টিউবে অনেকবার দেখেছি। কিন্তু নিজের চোখে যখন সেই অনবদ্য দৃশ্য দেখলাম তখন চোখে, মনে যেন একটা ঘোর লেগে গেল। জবরওয়ান পর্বতের পাদদেশে বিস্তৃত উদ্যান, তার বর্ণময়তা এই এপ্রিল মাসে একটা স্বপ্নের বীজ বপন করে দিয়ে যায় ভূস্বর্গে।
টিউলিপের বাগান দেখে এবং লাঞ্চ সেরে আমরা যুসমার্গের পথে যাত্রা করলাম। পুরাতন ও বিখ্যাত চরারে-ই-শরিফ মসজিদকে পাশ কাটিয়ে আমরা যুসমার্গের হোটেলে পৌঁছলাম। যুসমার্গে যেন সবুজ ঘাসের সুবিস্তৃত গালিচা পাতা রয়েছে। কতকটা গলফ কোর্সের মতো, আর তার দূর সীমানায় পাইনের বন, সবুজের মধ্যে মধ্যে শ্বেত বরফের চাদর পাতা রয়েছে যেন। কোলাহলমুক্ত স্বর্গীয় পরিবেশ। রাত্রিবাস হল যুসমার্গে।
পরের দিন ব্রেকফাষ্টের পর রেসওয়ারির উদ্দেশে রওনা হওয়া গেল। মূল গন্তব্য বাংগাস ভ্যালি। গত বছর খারাপ রাস্তার কারণে যেতে পারিনি। অবশেষে দুপুর দুটো নাগাদ আমরা রেসওয়ারিতে পৌঁছালাম। দারুন সুন্দর জায়গা। থাকার ব্যবস্থা রেস্টহাউসে। ছ’টা ঘর আছে রেস্টহাউসে। সবকটাই আমরা বুক করে নিয়েছিলাম। পাশ দিয়ে পাহাড়ি খরস্রোতা নদী বয়ে চলায় পরিবেশটা বেশ মোহময় লাগছিল। লাঞ্চ সারার পরে আর সময় নষ্ট না করেই বাংগাস রওনা হলাম। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উল্লেখ দরকার। দুই বছর আগেও তিন কিলোমিটার ট্রেক করে যেতে হত বাংগাসে। এখন পুরোটাই গাড়িতে যাওয়া যায়। তবে সেটা আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রাখতে হবে, আমরা করে রেখেছিলাম। আর একটা কথা, যেহেতু এটা বর্ডারের খুব কাছে হান্দওয়ারা ও কুপওয়ারা ডিস্ট্রিক্টের অন্তর্ভুক্ত তাই প্রয়োজনীয় তথ্যাদি-সম্বলিত নথি সঙ্গে থাকা আবশ্যক।
আমরা বাংগাস যাওয়ার পথ দেখেই অভিভূত। ঘন শাল, পাইনের জঙ্গলটা যেন দুধের ফেনা ঢালা বরফের চাদরে আবৃত। ৪০-৫০ মিনিট পর যখন বাংগাস পৌঁছলাম তখন তুষারপাত চলছে। আমরা ১২ জন প্রাণী আর দুই ড্রাইভার চলেছি। যতদুর চোখ যায় চেয়ে চেয়ে দেখি। এ যেন সবুজ গালিচায় কোন গোয়ালা না বুঝে দুধের ড্রামগুলো থেকে দুধ ফেলে প্রকৃতিকে শুভ্র বসনে সাজিয়ে তুলেছে। কথা বলতে ইচ্ছে হয় না, বরং প্রকৃতি কী বলতে চায় নীরব শ্রোতা ও দর্শক হয়ে শুনতে, দেখতে হয়। বাংগাস বেড়িয়ে আমরা রেসওয়ারির গেস্টহাউসে ফিরে এলাম। আগামীকাল আমাদের লোলাবের চণ্ডীগ্রামে থাকার কথা থাকলেও অনিবার্য কারণে আমাদের গুরেজ চলে যেতে হচ্ছে। আসলে অতিরিক্ত বরফ জমার কারণে গুরেজ ভ্যালি যাওয়ার পথ ওয়ান-ওয়ে করে দেওয়া হয়েছে। গাড়ি একদিন শুধু যাবে, পরের দিন শুধু ফিরবে।
ফটোঃ লেখক
পরের পর্বে গুরেজ উপত্যকায় বেড়ানোর কথা
লেখকের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরঃ 9433456266, 9007966182