পথের বাঁকে বাঁকে বিস্ময়। নদী, তৃণভূমি, আপেল বাগিচা, পাইনের অরণ্য, রং-বেরংয়ের রডোডেনড্রন ফুল, অসংখ্য ঝরনা, বরফের প্রান্তর, বরফের সেতু, বরফ জমা উপত্যকা। রুপিন পাস ট্রেক মানে পথের বাঁকে বাঁকে আবিষ্কার।
উত্তরাখণ্ডের ধৌলা থেকে ট্রেক শুরুর প্রচলিত পথ। ধৌলা থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়া হিমাচল প্রদেশে। ধৌলা, পিসা, সেওয়া, সেওয়া ডোগরি, গোরছাঙ্গো জিসকুন, জখা, ধন্দেরস হয়ে রুপিন ঘাটি। তারপর সাংলায় নেমে আসা। ৫-৬ দিনে এ পথে ট্রেক সম্পূর্ণ হতে পারে। সাংলা থেকে সিমলা চলে আসার বাস পাওয়া যাবে।
নৈটোয়ার থেকে মালবাহক ও প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করা যাবে। নৈটোয়ার থেকে ধৌলা ১১ কিলোমিটার। দেরাদুন থেকে বাসে, শেয়ার গাড়িতে নৈটোয়ার হয়ে ধৌলা পৌঁছানো যায়।
অন্য পথের কথা
এবার অন্য পথের কথা। এ পথে রুপিন পাস ট্রেক শুরু হবে সরাসরি জিসকুন (৭৬৩০ ফুট) থেকে। শিমলা থেকে রহড়ু হয়ে জিসকুন পৌঁছানো যায়। ট্রেক শুরুর আগেই রহড়ু-জিসকুন পথের দৃশ্যাবলী আপনাকে এক অন্য জগতে পৌছে দেবে, এ কথা হলপ করেই বলা চলে। পথে অতিক্রম করতে হয় চাইঁশীল পাস। গাড়ি চলাচলের উপযোগী হাই অল্টিটিউড পাস এটি। পথের দু’পাশে সবুজ তৃণভূমির বিস্তার তাক লাগিয়ে দেয়।
ট্রেক শুরুর অন্তত এক দিন আগে শিমলা পৌঁছে যাওয়াই ভালো। ওল্ড শিমলা বাসস্ট্যান্ড থেকে রহড়ু যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ৩টে পর্যন্ত প্রতি এক ঘন্টা অন্তর হিমাচল সড়ক পরিবহণ নিগমের (এইচ আর টি সি) বাস ছাড়ে রহড়ুর উদ্দেশে। রহড়ু পৌঁছাতে ঘন্টা চারেক সময় লাগবে। শিমলা থেকে রহড়ু যাওয়ার ট্যাক্সিও পাওয়া যাবে। দিল্লি থেকে সরাসরি রহড়ু যাওয়ার এইচ আর টি সি-র একটিই বাস আছে। ভলভো বাসটি ছাড়ে রাত সাড়ে ৯টায়, রহড়ু পৌঁছায় পরের দিন সকাল ১০টায়। দিল্লির কাশ্মীরী গেট থেকে ওল্ড শিমলা বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে।
রহড়ু থেকে জিসকুন ৮৫ কিলোমিটার। রহড়ুতে গাড়ির ব্যবস্থা করে নিতে হবে। কোনও এজেন্সির মাধ্যমে এ পথে ট্রেক করার ব্যবস্থা হলে সেই সংস্থাই রহড়ু-জিসকুন গাড়ির ব্যবস্থা করবে। তবে গাড়ির ভাড়া ট্রেকিংয়ের জন্য ধার্য খরচের অন্তর্ভুক্ত থাকে না। নির্দিষ্ট দিন নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেকাররা উপস্থিত থাকবেন রহড়ু বাসস্ট্যান্ডে। গাড়ির ব্যবস্থা করা থাকবে। ভাড়া ট্রেকারপিছু বিভক্ত হবে এবং সরাসরি গাড়ির চালককেই ভাড়া মিটিয়ে দিতে হবে। জিসকুন থেকে প্রয়োজনীয় নানা রসদ সংগ্রহ করা যাবে।
ট্রেকিংয়ের দিনগুলি
জিসকুনে পৌঁছানোর দিনটিকে ট্রেকিংয়ের প্রথম দিন হিসেবে ধরতে হবে। নরগনী আর জিসকুন নদীর সঙ্গমের উপরের দিকে জিসকুন বেশ বড়সড় গ্রাম। এ দিন রাত্রিবাস জিসকুনেই। থাকার জন্য লজ আছে। বাকি দিনগুলিতে থাকার ব্যবস্থা ক্যাম্পে।
দ্বিতীয় দিন ট্রেকপথে পা রাখা। এ দিন জিসকুন থেকে ঝকা ট্রেক। দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। ৭৬৩০ ফুট উচ্চতার জিসকুন থেকে উৎরাই ও চড়াই পথে উঠে আসতে হবে ৮৭৫৫ ফুট উচ্চতার ঝকায়। সময় লাগবে কমবেশি ৬ ঘন্টা। পথে হিমাচলের গ্রাম, হিমাচলী স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত স্লেট পাথরের ছাদ, কাঠের দেওয়ালের বাড়িঘর দেখা হবে।
তৃতীয় দিন পথচলা শুরু হবে ফারের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। প্রথমে চড়াই পথ। তারপর পথ নেমে আসতে থাকবে উপত্যকায়, রুপিন নদীর তীরে। পথে পড়বে প্রচুর রডোডেনড্রনের ঝাড়। বড় গাছপালা কমতে থাকবে। তৃণভূমি মধ্য দিয়ে, কোথাও বা পাহাড়ের ঢাল বরাবর পথ। উঠে আসবেন ১০৭৭০ ফুট উচ্চতার সরুয়াস তৃণভূমিতে। এদিনের ট্রেকপথের দৈর্ঘ্য ৭ কিলোমিটারের সামান্য বেশি। সময় লাগবে ৫-৬ ঘন্টা।
চতুর্থ দিন তিন কিলোমিটার পথ ট্রেক করে উঠে আসতে হবে ধন্দেরস বুগিয়ালে। গ্রীষ্ম ও শরতে বড় রঙিন এই বুগিয়াল। ভরে থাকে বুনো ফুলে। আরও কিছুটা চলার পরে পৌঁছাবেন সেই জায়গাটিতে, যেখানে ১৫০০ ফুট উচ্চতা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে রুপিন জলপ্রপাত (লোয়ার ফল)। ধৌলাধার পর্বত থেকে নেমে এসেছে এই জলপ্রপাতটি। ঘন্টা দুয়েক ট্রেক করে উঠে আসবেন ১১৭৭০ ফুট উচ্চতায়। জলপ্রপাতের আশেপাশে গড়া ক্যাম্প এ দিনের আশ্রয়।
পঞ্চম দিনে ১১৭৭০ ফুট উচ্চতা থেকে উঠে আসতে হবে ১৩২৭৫ ফুট উচ্চতায়, জলপ্রপাতের শীর্ষে। চড়াই পথে ক্রমাগত উঠে চলার একটা ধকল থাকবে। শরতে পিচ্ছিল পাথুরে পথে প্রপাতের জায়গাটি আতিক্রম করতে হবে। গ্রীষ্মে বরফের সেতুর উপর দিয়ে পেরতে হয় জায়গাটি। আশেপাশেই পড়বে সেদিনের ক্যাম্প।
ষষ্ঠ দিনে ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে খুব ভোরে। পাথর আর বরফে মাখামাখি গলির মতো পথ ধরে উঠে আসবেন গিরিবর্ত্মের উপরে। কষ্টকর চড়াই পথ। উঠে আসবেন ১৫২৮০ ফুট উচ্চতায়। পৌঁছেছেন রুপিন ঘাটিতে। উত্তরে দেখা দেবে কিন্নর কৈলাসের পর্বতচূড়াগুলি। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য। তারপর পাহাড়ের ঢাল ধরে খানিকটা নামতে থাকা। এ দিনের ট্রেকপথের দৈর্ঘ্য সাড়ে ৭ কিলোমিটার। পথ কঠিন। সময় লেগে যাবে ৮-৯ ঘন্টা।
সপ্তম দিন। এদিন প্রথমে পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে নামতে থাকা। এক সময় শুরু হবে বুগিয়াল অঞ্চল। পথে পড়বে সাংলা ডোগরি গ্রাম। নীচে দেখা দেবে বসপা নদী। পাইন বনের মধ্যে দিয়ে চলে আসবেন বসপার তীরে, সাংলায়। প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এ দিন ফের প্রবেশ করবেন জনপদে।
সাংলা থেকে সিমলা যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। দলের সদস্যরা মিলে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে নেওয়া যেতে পারে। সদস্যপিছু মোট ভাড়া বিভক্ত হবে।
রুপিন পাস ট্রেক-পথের কোনও কোনও অংশ বেশ কষ্টসাধ্য খাড়াই পথ। দৈহিক ভাবে সক্ষম হতে হবে। আগে থেকেই দীর্ঘ পথ হাঁটা, দৌড়ের অভ্যাস থাকলে ট্রেকিংয়ে সুবিধা হবে।
ট্রেকিং আয়োজনকারী সংস্থা ইন্ডিয়াহাইকস হিমাচল প্রদেশের রহড়ু রুটে এই ট্রেকটি পরিচালনা করে থাকে। জিসকুন থেকে সাংলা পর্যন্ত ট্রেকিংয়ের সমস্ত দায়দায়িত্ব সংস্থার। মাথাপিছু খরচ ১৪,৯৫০ টাকা। সঙ্গে যুক্ত হবে ৫% হারে জি এস টি এবং ট্রেক ইনশিওরেন্স বাবদ ২১০ টাকা। যোগাযোগের নম্বরঃ ০৮০-৪৬৮-০১২৬৯। ই-মেলঃ info@indiahikes.com
রুপিন জলপ্রপাত ফটোঃ সৌজন্য ধওয়ানি জনি ভালিয়া।
অন্য সবক’টি ফটোঃ সৌজন্য জ্যোতিরঞ্জন।
ফটো সংগ্রহঃ ইন্ডিয়াহাইকস।