বর্ষায় গহন মেঘের ছায়া ঘনায় বিস্তৃত জলে। বৃষ্টির কত ছন্দ, কত তাল, জল, জঙ্গল, পাহাড় জুড়ে। বাতাস বইলে পায়ের কাছে ছল ছল জল। ইতিউতি শালুক ফুল। জল-ফড়িংয়ের ওড়াউড়ি জল-পারের এখানে সেখানে। নৌকা বেয়ে যায় মাঝি। দিগন্তব্যাপী জলরাশির অন্য পারে সবুজ পাহাড়। সূর্যোদয়-সূর্যাস্তে জলের রং বদলায়। পূর্ণিমায় চাঁদ নেমে আসে জলে। গেরুয়া মাটিতে সবুজের আলপনা। ইতিউতি পাখি ডাকে দিনভর। শরতে কাশের ঝালর দোলে। কত যে বুনো ফুল। শীতে জলাশয়ে ভেসে বেড়ায় পরিযায়ী পাখির ঝাঁক। বসন্তে ফোটে পলাশ। মরসুমে মরসুমে বদলে যায় ফুটিয়ারির ছবি।
পুরুলিয়ার পর্যটন মানচিত্রে স্বল্প পরিচিত কিন্তু আশ্চর্য করা সৌন্দর্যের এক ঠিকানা ফুটিয়ারি। সেচ বাঁধের নাম অনুসারে জায়গার নাম। বাঁধ, দিগন্তবিস্তৃত জল, তালগাছের সারি, পলাশের বন, পাখি, গেরুয়া-রঙা সব পথ। অদূরে তিলাবনী, সিন্দুরপুর আর পাঁজোনিয়া পাহাড়। ফুটিয়ারির প্রকৃতি আপন হাতে শান্ত-সৌন্দর্যের ছবি আঁকে। সময় থেকে সম্যে সে ছবি পাল্টে পাল্টে যায়।
পুরুলিয়া জংশন ও আদ্রা স্টেশন থেকে ফুটিয়ারির দূরত্ব যথাক্রমে ২৩ ও ২৫ কিলোমিটার।
লেকের ধারে বসে জলধ্বনি, পাখির কূজন শুনতে শুনতে, দিনের নানা সময়ে জলের রং পরিবর্তন দেখতে দেখতে কেটে যাবে অনেকটা সময়। সকালে-বিকেলে বাঁধের পথ ধরে হাঁটুন। একদিকে জল আর জল, অন্যদিকে ঊষর প্রান্তর জুড়ে সবুজের বিস্তার দেখতে দেখতে সেই পথচলা চোখের আরাম, প্রাণের শান্তি। আর জলভ্রমণের ইচ্ছা থাকলে নৌকায় চড়ে ভেসে পড়তে পারেন লেকের জলে।
চাইলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারেন গ্রামের পথে। রাঙাডি, বেতাবাহাল, বাগদিশার মতো গ্রামগুলিতে দেখবেন আদিবাসী জীবনের নানা ছবি। বাতাসে মহুলের আঘ্রাণ। সে অবশ্য মার্চ-এপ্রিল মাসে। রোমাঞ্চে টান থাকলে টিলাবনী পাহাড়ে ট্রেক করতে পারেন। ফুটিয়ারি থেকে টিলাবনী পাহাড় ৪ কিলোমিটার, সিন্দুরপুর পাহাড় ৬ কিলোমিটার।
মাছ ধরায় আগ্রহ থাকলে ছিপ হাতে বসে পড়তে পারেন জলাশয়ের ধারে।
বার্ড ওয়াচিংয়ে বিশেষ আগ্রহ? তাহলে ফুটিয়ারির জল-জঙ্গলময় পরিবেশ আপনাকে খালি হাতে ফেরাবে না।
ফুটিয়ারি থেকে কাছাকাছি কিছু জায়গা বেড়িয়ে আসা যায়। জয়চণ্ডী পাহাড় ফুটিয়ারি থেকে ২৫ কিলোমিটার। ৫২০টি সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের শীর্ষে উঠতে হয়। চণ্ডী মাতার মন্দির রয়েছে পর্বতশীর্ষে। সেখান থেকে চারপাশের দৃশ্যাবলী আপনাকে মুগধ করবে। সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিটির অনেকাংশের শ্যুটিং হয়েছিল এই জয়চণ্ডী পাহাড় এলাকায়।
ফুটিয়ারি থেকে কাশীপুর রাজবাড়ি ১৮ কিলোমিটার। ঐতিহ্যমণ্ডিত এই রাজবাড়ি থেকে একসময় পঞ্চকোটের সিংদেও রাজপরিবারের শাসনকার্য পরিচালিত হয়েছে। অন্তত ৮০০ বছরের সিংদেও পরিবারের শাসনকালের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ভগ্নপ্রায় কাশীপুর রাজবাড়ি। বেড়িয়ে আসতে পারেন কেশরগড় জঙ্গল, সুরুলিয়া ডিয়ার পার্ক থেকে। কেশরগড়ে দেখা হবে কংসাবতী নদীর সঙ্গে।
আর ছোট্ট ছুটিতে শুধুই বিশ্রাম চাইলে ফুটিয়ারির শান্ত ও দূষণবিহীন প্রাকৃতিক পরিবেশ আপনাকে শান্তি দেবে। বিশুদ্ধ বাতাসে পাবেন প্রাণদায়ী অক্সিজেন। একা লেকের পারে বসে অথবা সদলে আড্ডা দিয়ে, বাঁধ ও গ্রামের পথে হাঁটাহাঁটি করে, নৌকায় চড়ে লেকে বেড়িয়ে কোথা দিয়ে কেটে যাবে দুটো দিন।
থাকার ব্যবস্থা
ফুটিয়ারি রিট্রিট। লেকের পারেই রিট্রিটের অবস্থান। এখানে থাকার জন্য রয়েছে ৫টি এসি ডিলাক্স কটেজ ও ১টি সুপার ডিলাক্স রুম। প্রাতরাশ-সহ প্রতিটি কটেজ ও সুপার ডিলাক্স রুমের ভাড়া ৩,৫০০ টাকা। প্রাতরাশ ছাড়া অন্যন্য খাওয়াদাওয়ার খরচ আলাদা। যোগাযোগের নম্বরঃ ৯০৫১১-৬৬৫৬৩, ৯৮৩০২-৫৩৫৮৪।
যাওয়ার পথ
হাওড়া থেকে পুরুলিয়া এক্সপ্রেস বা আদ্রা চক্রধরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার অথবা সাঁত্রাগাছি থেকে রুপসী বাংলা এক্সপ্রেস ধরে পুরুলিয়া বা শালিমার স্টেশন থেকে আরণ্যক এক্সপ্রেস ধরে আদ্রা চলে আসুন। পুরুলিয়া বা আদ্রা স্টেশন চত্বর থেকে অটো ও গাড়ি রিজার্ভ করে ফুটিয়ারি রিট্রিট চলে আসা যায়। আগে থেকে বলা থাকলে রিট্রিট থেকেও গাড়ি পাঠিয়ে স্টেশন থেকে নিয়ে আসা এবং ফেরার পথে স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার (ভাড়ার বিনিময়ে) ব্যবস্থা করা হয় (স্বল্প ভাড়ার বিনিময়ে)।
সড়কপথে কলকাতা থেকে ফুটিয়ারির দূরত্ব ২৮৪ কিলোমিটার। আসতে হবে বর্ধমান, দুর্গাপুর(মুচিপাড়া), বাঁকুড়া বাইপাস, ঢোলডাঙ্গা, পুয়াবাগান, বিশপরিয়া, হুড়া,লাঢুকরা হয়ে। লাঢুকরা থেকে ফুটিয়ারি রিট্রিট ২ কিলোমিটার।