Follow us
Search
Close this search box.

কেচকি কোয়েল ও অরণ্যের দিনরাত্রি

কেচকি কোয়েল ও অরণ্যের দিনরাত্রি

হাওড়া থেকে শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেসে রওনা দিয়ে যখন ঝাড়খণ্ডের পালামৌ জেলার ডাল্টনগঞ্জ স্টেশনে নামলাম ঘড়িতে তখন রাত ২টো। শীতের রাত। সুনশান স্টেশন চত্বর। অজানা,অচেনা স্টেশনে আমরা দুটি প্রাণী মাত্র। পৌঁছলাম স্টেশন ম্যানেজারের ঘরে। রিটায়ারিং রুম বুকিংয়ের কাগজপত্র দেখালাম ম্যানেজার সাহেবকে। কাগজ হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন ভদ্রলোক। তারপর ডাকলেন কাউকে। সেই লোকটি আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ঘর দেখিয়ে দিল। ঘর পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম স্টেশন ম্যানেজার কেন আমার মুখপানে তাকিয়ে ছিলেন। খাতায়-কলমে রিটায়ারিং রুমের অস্তিত্ব থাকলেও সচরাচর হয়তো বুকিং হয় না। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব স্পষ্ট।

রাতটা কেটে গেল কোনওরকমে। সকাল হতেই স্টেশনচত্বরের বাইরে বেরিয়ে এসে হালকা টিফিন করে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য বেতলা ন্যাশনাল পার্ক। ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম পালামৌ টাইগার রিজার্ভের রিসর্টে। কেয়ারটেকার আমাদের ঘর দেখিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে দিল। সে-দিনটা বিশ্রামেই কাটলো। সন্ধ্যায় গাড়ির মালিক-কাম-চালক আসলাম ভাই এল। ঠিক হল, পরের দিন ব্রেকফাস্ট করেই আমরা বেরিয়ে পড়ব।

বেতলা ন্যাশনাল পার্ক।

কথামতো সকাল ৮টায় আসলাম ভাই গাড়ি নিয়ে হাজির। সাড়ে ৮টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম আমরা। কেচকি আসব বলে অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করেছি। আজ চলেছি সেই কেচকি। মিশকালো পিচরাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি। দু-পাশে ঘন সবুজ অরণ্য। ডালটনগঞ্জ থেকে আসার পথ ধরেই চলেছি আমরা। কিছুদূর যাওয়ার পর বনবিভাগের পথ-নির্দেশ দেখা দিল। মূল রাস্তা থেকে কেচকি বাঁ-দিকে (পালামৌ টাইগার রিজার্ভের রিসর্ট থেকে আসার পথে) এক কিলোমিটার।

গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। রেললাইন পেরিয়ে গাড়ি এসে থামল একটা গেটের সামনে। গাড়ির হর্ন শুনে কেয়ারটেকার এসে গেট খুলে দিলেন। বেতলা অফিস থেকে আগেই আমাদের যাওয়ার খবর জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বনবাংলোর উঠোনে দাঁড়িয়ে সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। দূরে বয়ে চলেছে কোয়েল নদী।

কেচকি বনবাংলো – ছবিঃ লেখক।

 

কোয়েল নদী।

‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ সিনেমার একটা একটা করে দৃশ্য ভেসে উঠছে মানস-চক্ষুর সামনে। অরণ্যের দিনরাত্রি-র শ্যুটিংয়ের জন্য সত্যজিৎ রায় তাঁর ইউনিটের তাঁবু ফেলেছিলেন এই বনবাংলোয়। চা খেতে খেতে কেয়ারটেকারের মুখে শ্যুটিংয়ের গল্প শুনছিলাম। এই সব গল্প তাঁরও অন্যের কাছ থেকে শোনা। বাংলোর চারপাশটা অনেক বদলে গেছে। সেটা স্বাভাবিকও। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ছবিটি ১৯৭০-এর ১৬ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েছিল। ছবিটি মুক্তির পরে ৫০ বছর কেটে গিয়েছে।

মনে পড়ছে, অসীম, সঞ্জয় আর শেখরের (যথাক্রমে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ও রবি ঘোষ) স্নানের দৃশ্য, রবি ঘোষের কুঁয়ো থেকে জল তোলা, অপর্ণা আর জয়াকে দেখে শুভেন্দুর গামছা পরে কুঁয়োতলায় শুয়ে পড়ার দৃশ্য। সে সবই তো এই বাংলোর মধ্যেকার দৃশ্য। কেয়ারটেকার আমাদের সামনের জঙ্গলটা ঘুরিয়ে দেখালেন। মনে হচ্ছিল এই বুঝি দেখা হয়ে যাবে অরণ্য-কন্যা দুলির (অরণ্যের দিনরাত্রির চরিত্র) সঙ্গে।

ফটো সৌজন্য: টুইটার ও টাইমস অফ ইন্ডিয়া ডট কম,

বনবাংলো থেকে বেরিয়ে গেলাম কেচকি সঙ্গমে। কোয়েল আর ওরগা নদী এখানে মিলেমিশে একাকার। চারপাশটা সবুজ। দূরে নদীর বুক চিরে চলে গেছে রেলব্রিজ। হয়তো এখানেই সত্যজিৎ রায় সাঁওতালি নাচের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন। আমরাও অনেক ছবি তুললাম। এখানেই কোনোও গাছের নীচে অসীম আর অপর্ণার রোমান্স দৃশ্যায়িত হয়েছিল। গত পঞ্চাশ বছরে কোয়েল দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। গড়িয়েছে সময়। আমরা দু’জন কোয়েলের কাছে একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে। কবে তৈরি হবে আরেকটা অরণ্যের দিনরাত্রি?

কীভাবে যাবেন

আগে চলে আসুন ডালটনগঞ্জ। হাওড়া থেকে শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি বেশ সুবিধাজানাক,রোজ চলে। সড়কপথে রাঁচি-ডালটনগঞ্জ দূরত্বত্ব ১৭৫ কিলোমিটার। ডালটনগঞ্জ থেকে বেতলা ২৭ এবং কেচকি ১৮ কিলোমিটার। নেতারহাট থেকে বেতলা ৫৮ কিলোমিটার। বেতলা থেকে ডালটনগঞ্জ ৩৫ কিলোমিটার।

দেখাশোনা

বেতলা ন্যাশনাল পার্ক। যাবেন ত বটেই। শাল, মহুয়া, পলাশের গভীর অরণ্য আপনাকে প্রকৃতি-বৈচিত্রের সন্ধান দেবে। শহুরে মানুষ যে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবেন সে কথা হলপ করে বলতে পারি। ১৯৩২-এ বিশ্বে প্রথম বাঘসুমারি বা বাঘগণনা হয় এই বেতলার অরণ্যেই। বেতলায় বাঘ তো আছেই, আছে নীলগাই, হাতি, বুনো মোষ, চিতাবাঘ, চিতল হরিণ, মাউস ডিয়ার। কত যে পাখি এই বনে। হাতির পিঠে চড়ে বা জিপে করে জঙ্গল সাফারির ব্যবস্থা আছে। একবার ঢুঁ মারতে পারেন বেতলার নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টারেও। বেতলার অরণ্য, সেখানকার আদিবাসী মানুষজনের সংস্কৃতি সম্পর্কে নানা তথ্য পাবেন। বেড়িয়ে আসতে পারেন বেতলা ফোর্ট। বেতলার কাছাকাছিই ঝড়খণ্ডের উচ্চতম লোধ জলপ্রপাতটিও দেখে নেওয়া উচিৎ হবে। আর বেড়িয়ে আসবেন কেচকি।

এই ভ্রমণের জন্য দু’রাত তিন দিনই যথেষ্ট।

থাকার ব্যবস্থা

বেতলা ন্যাশনাল পার্কের সামনেই রয়েছে ঝাড়খণ্ড টুরিজমের হোটেল বনবিহার, ফোনঃ ০৯১০২৪-০৩৮৮২। বেতলার জঙ্গলে ট্রি হাউসে থাকার ব্যবস্থা আছে, ফোনঃ ৯৯৫৫৫-২৭৩৭১। বেতলা ফরেস্ট গেস্টহাউস, ফোনঃ ০৬৫৬৭-২২৬৫০। হোটেল দেবযানী, ফোনঃ ০৮৮৪০৭-৬৫৭৫৬।

ঝাড়খণ্ড টুরিজমের কলকাতা অফিসের ঠিকানাঃ ১২-এ, ক্যামাক স্ট্রিট, ঊষাকিরণ ভবন, নবম তল, ফ্ল্যাট নম্বর-৮বি, কলকাতা-৭০০০১৭। ফোনঃ ০৩৩-২২৮২-০৬০১।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *