Follow us
Search
Close this search box.

প্যাঁচার গ্রাম পুতুলের গ্রাম নতুনগ্রাম

প্যাঁচার গ্রাম পুতুলের গ্রাম নতুনগ্রাম

শঙ্কর ভদ্র

রঙের বৈভবটি চোখ কাড়ার মতোই, সাদা কালো লাল হলুদ সবুজের সে কী উজ্জ্বল সমাহার, ঠোঁটের ওপর ইংরেজি ‘এম’ আকৃতির চিহ্নটি কিংবা মাথা ও ঠোঁটের সংযোগস্থলে টকটকে লাল রঙের টিপখানি, মাথা আর বুকের সংযোগস্থলটিকে নির্দিষ্ট করেছে এক ফালি সবুজের টান, একেবারে শেষে, পায়ের নীচে দু’দিকে প্রলম্বিত একটি বা দুটি করে রেখা গোটা চারকোনা অবয়বটিকে একটি জ্যামিতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে রেখেছে। বৃত্তাকার দুটি চোখের সজাগ দৃষ্টি প্রসারিত সুদূরে। তারপর সীমা ছাড়িয়ে। ভাঙচুর হয়ে যায় চোখে দেখা জ্যামিতিক আকারের। দারুনির্মিত জগন্নাথদেবের চোখ দুটিও তো এমনই গোলাকার।

এখানে প্যাঁচার কথা হচ্ছে। কাঠের প্যাঁচা। একটিই কাঠের খণ্ড থেকে তৈরি ওই রং-ঝলমলে প্যাঁচাটি অনেকের বাড়িতেই শোভা পায়। কোনও হস্তশিল্প মেলা থেকে কিনেছেন হয়তো গৃহসজ্জার উপকরণ হিসেবে। মা লক্ষীর বাহন বলে কথা। অনেকের কাছে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবেও মান্যতা পেয়ে থাকেন সেই প্যাঁচা।

দেড় ইঞ্চি হোক বা দেড় ফুট, নকশায়, রংয়ের বিন্যাসে, গঠনশৈলীতে আপাত সাধারণ হয়েও বাংলার লোকশিল্পে একটি বিশিষ্ট হস্তশিল্প সামগ্রী রঙিন কাঠের প্যাঁচা। সুদীর্ঘ অনুশীলন ছাড়া গড়ে উঠতে পারে দারুশিল্পের এমন একটি ঘরানা? কোথায় তৈরি হয়, কারা তৈরি করেন এই ধারার প্যাঁচা?

পূর্ব বর্ধমানের কালনা মহকুমার নতুনগ্রাম কাঠের পুতুল তৈরির জন্য খ্যাত। প্যাঁচা ছাড়াও তৈরি হয় গৌর-নিতাই, রাজা-রানী, বর-বউ প্রভৃতি। ঘরানা সেই একই। প্রতিটি পুতুল তৈরি হয় ওই একটিই কাঠের খণ্ড থেকে। সঙ্গে যুক্ত হয় রংয়ের বিশিষ্টতা। তবে ওই প্যাঁচাই নতুনগ্রামের হিট আইটেম। হস্তশিল্প মেলা থেকে বিভিন্ন হ্যান্ডিক্রাফটস এম্পোরিয়ামে নতুনগ্রামের প্যাঁচার উপস্থিতি চোখে পড়বেই। বর্তমানে কিছু আসবাবও তৈরি হচ্ছে নতুনগ্রামে। সেগুলিতেও নানাভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ওই প্যাঁচার মোটিফ।

নতুনগ্রামের কাঠপুতুল শিল্পের ইতিহাস জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে বহু বছর আগে। ১৬৮৬-তে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্থপতি জোব চার্নক পা রেখেছেন গঙ্গাতীরের সুতানুটিতে। চন্দনগরে ফরাসীদের আগমন ঘটে গেছে ১৬৭৩ সালে। ১৬৭৪-এ ফরাসীরা বিজাপুরের সুলতানের কাছ থেকে কার্যত হাতিয়ে নিল পণ্ডিচেরী। তারও আগে পর্তুগিজরা গেড়ে বসেছে গোয়ায়। ভারতের আর্থ-সামাজিক চিত্রটি একটু একটু করে বদলাতে শুরু করেছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে নয় নয় করে ২৫০-৩০০ বছর আগে ভারতের উত্তর ও পশ্চিমাংশ থেকে কিছু মানুষ বর্তমান বর্ধমান অঞ্চলে আসেন পাকাপাকি ভাবে। এঁদের ধর্ম, সংস্কৃতি প্রভাবিত করেছিল নতুনগ্রামের বর্তমান পুতুলশিল্পীদের পূর্বপুরুষদের।

গবেষকদের মতে, বর্তমান নতুনগ্রামের কাঠপুতুল-শিল্পীদের অদিবাসী গোষ্ঠীভুক্ত পূর্বপুরুষেরা অনেক অনেক আগে ভাস্কর ছিলেন । তাঁদের কাজ ছিল পাথর নিয়ে। পরে ওই উত্তর ও পশ্চিম ভারত থেকে আগতদের সান্নিধ্যে আসার পরে সেই আদিবাসী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পসৃষ্টিতে হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে (তথ্যসূত্রঃ ‘বেঙ্গলস নতুনগ্রামঃ ক্রাফট ভিলেজ হয়ার উডেন ডলস কাম অ্যালাইভ’, দোলা মিত্র, এডিটর-ইন-চিফ,কুক্কু নিউজ নেটওয়ার্ক)। প্রসঙ্গত, নতুনগ্রামের বেশিরভাগ কাঠপুতুল-শিল্পীর পদবী ভাস্কর ও সূত্রধর (মানে ছুতোর/গল্প বলিয়ে)।

উত্তর ও পশ্চিম ভারত থেকে আসা জনগোষ্ঠীর হাতে ছিল ধনসম্পত্তি। বর্তমান বর্ধমান-সহ এই বঙ্গে তারা জমিদারির পত্তন করতে লাগল। সম্পদের দেবী লক্ষীও তাঁর বাহন প্যাঁচা সহকারে এই নব্য জমিদারদের ঘরে ঠাঁই করে নিতে লাগলেন। কিন্তু একটা প্রশ্ন জাগে। নতুন গ্রামের পুতুলের ঝুড়িতে দেবী লক্ষীর মূর্তির দেখা তো মেলে না তেমন। কিন্তু তাঁর বাহনের সাক্ষাৎ পাওয়া যাচ্ছে আকছার। আদিবাসী সংস্কৃতির প্রভাব?

ওদিকে, ষোড়শ শতকে বাংলা ভেসে গেল চৈতন্যদেবের নেতৃত্বাধীন ভক্তি আন্দোলনের জোয়ারে। সমাজের তথাকথিত নিচু স্তরের মানুষের মাথা উচুঁ করে দাঁড়ানোর সেই আন্দোলনের প্রভাব পড়ল কাঠপুতুল শিল্পেও। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব স্থায়ী জায়গা করে নিলেন নতুনগ্রামের ভাস্কর, সূত্রধরদের কাঠখোদাই শিল্পে। কৃষ্ণ, রাধা-কৃষ্ণের যুগল-মূর্তিও যুক্ত হল পুতুলের তালিকায়। ছোট-বড় রাজা, জমিদাররা পুষ্ট হতে থাকল ইংরেজ শাসনকালে। জমকালো রংবাহার,পাকানো গোঁফ নিয়ে নতুনগ্রামের পুতুল শিল্পেও জাঁকিয়ে বসলেন জমিদার ও জমিদার-গৃহিনী বা রাজা-রানী। বর্ধমানের শক্তিশালী রাজতন্ত্র রক্ষার জন্য তৈরি হয়েছিল সশস্ত্রবাহিনী। এখনো পাওয়া যাবে সেনা-পুতুল। খোঁজ করলে পাবেন গোপীনাথের কাষ্ঠনির্মীত মূর্তি। দেবতা গোপীনাথকে বর্ধমানের অগ্রদ্বীপ শহরের অভিভাবক দেবতা হিসেবে গণ্য করা হয়।

 

নতুনগ্রামের তরুণ শিল্পী গৌরাঙ্গ ভাস্কর জানাচ্ছেন, পুতুল তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয় ছাতিম, শিমূল, আম, আতা, গামার প্রভৃতি গাছের কাঠ। ফ্যাব্রিক ও অয়েল পেইন্ট ব্যবহৃত হয় রঙের বর্ণাঢ্যতা ফুটিয়ে তোলার জন্য।

সাধারণত সূক্ষ্ম হাতে পুতুলে রং-বাহার ফুটিয়ে তোলার কাজটি করে থাকেন মহিলারা। কাঠ খোদাই করে পুতুলের মূল অবয়বটি তৈরি করেন পুরুষেরা। একেবারে শিশু ছাড়া কাজে হাত লাগান পরিবারের প্রায় সকলেই।

নতুনগ্রামের এই ঐতিহ্যবাহী পুতুলশিল্পের অগ্রগামীতার লক্ষ্য নিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অণু,ক্ষুদ্র,মাঝারি শিল্প ও বস্ত্রবয়ন বিভাগ ও ইউনেস্কো যৌথ উদ্যোগে নতুনগ্রামকে রাজ্যের অন্যতম ক্রাফট হাব হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ নতুনগ্রামে ফোক আর্ট সেন্টার তৈরি করেছে। এখানে রয়েছে সংগ্রহশালা এবং নতুনগ্রামে বেড়াতে আসা অতিথিদের জন্য থাকবার ব্যবস্থা। পুতুল বিপণনের জন্য রয়েছে স্বামী জানকীদাস নতুনগ্রাম উড কার্ভিং আর্টিজানস ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি।

এসে শিল্পীদের সঙ্গে আলাপ করা যেতে পারে। কীভাবে কিশোরী মেয়েটি কী আত্মপ্রত্যয়ে হাতে তুলে নেয় রঙের তুলিটি। ঘুরেফিরে দেখা যেতে পারে এ-গ্রাম সে-গ্রাম। কাছেই ছবির মতো সিঙ্গি গ্রামের অনাবিল প্রকৃতি মন ভালো করে দেয়।

সিঙ্গি গ্রাম। ছবি: সম্রাট বন্দ্যোপাধ্যায়।

ছবি: সম্রাট বন্দ্যোপাধ্যায়।

আর মণ্ডা? সে তো আরেক কথা। কাটোয়া, অগ্রদ্বীপ, সিঙ্গী, নতুনগ্রাম মণ্ডাময়। খাটি ছানার তৈরি ডবলডেকার আসলি মণ্ডার প্রচুর সুখ্যাতি। একবার আস্বাদ পেলে যে মণ্ডার তারিফ করতে হবে, এ কথা নিশ্চিত।

যাওয়ার পথ
কাছের রেলস্টেশন অগ্রদ্বীপ। হাওড়া বা শিয়ালদা থেকে কাটোয়া রেলপথের কোনও ট্রেনে উঠে নামতে হবে অগ্রদ্বীপ স্টেশনে, ওখান থেকে সাড়ে ১২ কিলোমিটার নতুনগ্রাম। কাটোয়া থেকেও যাওয়া যাবে, দুরত্ব ১৮ কিলোমিটার। সড়কপথে বর্ধমান বা শান্তিনিকেতন থেকে নতুনগ্রাম দেড় ঘন্টার পথ। কলকাতা থেকে দিল্লি রোড ধরে কাটোয়ার পথে মেমারী, দাঁইহাট হয়ে নতুনগ্রাম পৌঁছাতে ঘন্টা চারেক সময় লাগে। কলকাতা থেকে নতুনগ্রাম ক্মবেশি ১৫০ কিলোমিটার।

থাকার ব্যবস্থা

নতুনগ্রামের ( মিস্ত্রীপাড়া, পোঃ পাটুলি, থানাঃ পূর্বস্থলী, মহকুমাঃ কালনা, জেলাঃ পূর্ব বর্ধমান), ফোক আর্ট সেন্টারে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। দ্বিতল বাড়ির প্রথম ও দ্বিতল মিলিয়ে রয়েছে মোট ৪টি থাকার ঘর। অন্তত ১২ জন তো থাকতেই পারেন। তেঁতুলপাতায় ৯ জনের দর্শনে বিশ্বাসী হলে চার ঘরে ষোল জনের বসবাসের ব্যবস্থাও হতে পারে । বুকিংয়ের জন্য সেন্টারের গৌরাঙ্গ ভাস্করের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন এই নম্বরেঃ ৭৬৭৯০-৯৯২০৫।

সিঙ্গির শান্তিনিকেতন লজ থাকার ভালো ব্যবস্থা। সেক্ষেত্রে সিঙ্গি গ্রামটি বেড়িয়ে দেখা হবে উপরি পাওনা। গাড়ি নিয়ে এলে ড্রাইভারের থাকার জন্য ডর্মিটরির ব্যবস্থা আছে। শান্তিনিকেতন লজের যোগাযোগের নম্বরঃ ৭০৪৪৭-৯১৪৩৬।

থাকার ব্যবস্থা হতে পারে কাটোয়া শহরে। অনেক হোটেল রয়েছে। কাটোয় শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে নতুনগ্রাম ১৭ কিলোমিটার।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *