Follow us
Search
Close this search box.

কাঠপুতুলের নতুনগ্রাম

কাঠপুতুলের নতুনগ্রাম

ভালো করে দেখুন, রঙের সে কী বৈভব, সাদা কালো লাল হলুদ সবুজের সে কী উজ্জ্বল সমাহার, ঠোঁটের ওপর ইংরেজি ‘এম’ আকৃতির চিহ্নটি কিংবা মাথা ও ঠোঁটের সংযোগ যেখানটিতে, সেখানে টকটকে লাল রঙের টিপটি, মাথা আর বুকের সংযোগস্থলটিকে নির্দিষ্ট করেছে এক ফালি সবুজের টান, একেবারে শেষে, পায়ের নীচে দু’দিকে প্রলম্বিত একটি বা দুটি করে রেখা গোটা চারকোনা অবয়বটিকে একটি জ্যামিতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে রেখেছে। বৃত্তাকার দুটি চোখের সজাগ দৃষ্টি প্রসারিত সুদূরে। সীমার মাঝে অসীম। ভাঙচুর হয়ে যায় চোখে দেখা জ্যামিতিক আকারের। মূর্ত হয়ে ওঠে বিমূর্ত। দারুনির্মিত জগন্নাথদেবের চোখ দুটিও তো এমনই গোলাকার।

প্যাঁচার কথা হচ্ছে। কাঠের প্যাঁচা। একটিই কাঠের খণ্ড থেকে তৈরি ওই রং-ঝলমলে প্যাঁচাটি আপনাদের অনেকের বাড়িতেই আছে। কোনও হস্তশিল্প মেলা থেকে কিনেছেন হয়তো গৃহসজ্জার উপকরণ হিসেবে। মা লক্ষীর বাহন বলে কথা। অনেকের কাছে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবেও মান্যতা পেয়ে থাকেন।

দেড় ইঞ্চি হোক বা দেড় ফুট, নকশায়, রংয়ের বিন্যাসে, গঠনশৈলীতে ব্যাত্যয় নেই। সুদীর্ঘ অনুশীলন ছাড়া গড়ে উঠতে পারে দারুশিল্পের এমন একটি ঘরানা? কোথায় তৈরি হয়, কারা তৈরি করেন এই বিশিষ্ট ঘরানার প্যাঁচা?

পূর্ব বর্ধমানের কালনা মহকুমার নতুনগ্রাম কাঠের পুতুল তৈরির জন্য খ্যাত। প্যাঁচা ছাড়াও তৈরি হয় গৌর-নিতাই, রাজা-রাণী, বর-বউ প্রভৃতি। ঘরানা সেই একই। প্রতিটি পুতুল তৈরি হয় ওই একই শৈলীতে, একটিই কাঠের খণ্ড থেকে। সঙ্গে থাকে রংয়ের বিশিষ্টতা। তবে ওই প্যাঁচাই নতুনগ্রামের হিট আইটেম। হস্তশিল্প মেলা থেকে বিভিন্ন হ্যান্ডিক্রাফটস এম্পোরিয়ামে নতুনগ্রামের প্যাঁচার উপস্থিতি চোখে পড়বেই। বর্তমানে কিছু আসবাবও তৈরি হচ্ছে নতুনগ্রামে। সেগুলিতেও নানাভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ওই প্যাঁচার মোটিফ।

নতুনগ্রামের কাঠপুতুল শিল্পের ইতিহাস জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে বহু বছর আগে। ১৬৮৬-তে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্থপতি জোব চার্নক পা রেখেছেন গঙ্গাতীরের সুতানুটিতে। চন্দনগরে ফরাসীদের আগমন ঘটে গেছে ১৬৭৩ সালে। ১৬৭৪-এ ফরাসীরা বিজাপুরের সুলতানের কাছ থেকে কার্যত হাতিয়ে নিল পণ্ডিচেরী। তারও আগে পর্তুগিজরা গেড়ে বসেছে গোয়ায়। ভারতের আর্থ-সামাজিক চিত্রটি একটু একটু করে বদলাতে শুরু করেছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে নয় নয় করে ২৫০-৩০০ বছর আগে ভারতের উত্তর ও পশ্চিমাংশ থেকে কিছু মানুষ বর্তমান বর্ধমান অঞ্চলে আসেন পাকাপাকি ভাবে। এঁদের ধর্ম, সংস্কৃতি প্রভাবিত করেছিল নতুনগ্রামের বর্তমান পুতুলশিল্পীদের পূর্বপুরুষদের শিল্প-সংস্কৃতিকে।

গবেষকদের মতে, বর্তমান নতুনগ্রামের কাঠপুতুল-শিল্পীদের অদিবাসী গোষ্ঠীভুক্ত পূর্বপুরুষেরা অনেক অনেক আগে ছিলেন ভাস্কর। তাঁদের কাজ ছিল পাথর নিয়ে। পরে ওই উত্তর ও পশ্চিম ভারত থেকে আগতদের সান্নিধ্যে আসার পরে সেই আদিবাসী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পসৃষ্টিতে হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে (তথ্যসূত্রঃ ‘বেঙ্গলস নতুনগ্রামঃ ক্রাফট ভিলেজ হয়ার উডেন ডলস কাম অ্যালাইভ’, দোলা মিত্র, এডিটর-ইন-চিফ,কুক্কু নিউজ নেটওয়ার্ক)। প্রসঙ্গত, নতুনগ্রামের বেশিরভাগ কাঠপুতুল-শিল্পীর পদবী ভাস্কর ও সূত্রধর (ছুতোর/গল্প বলিয়ে)।

উত্তর ও পশ্চিম ভারত থেকে আসা জনগোষ্ঠীর হাতে ছিল ধনসম্পত্তি। বর্তমান বর্ধমান-সহ এই বঙ্গে তারা জমিদারির পত্তন করতে লাগল। সম্পদের দেবী লক্ষীও তাঁর বাহন প্যাঁচা সহকারে এই নব্য জমিদারদের ঘরে ঠাঁই করে নিতে লাগলেন। কিন্তু একটা প্রশ্ন জাগে। নতুন গ্রামের পুতুলের ঝুড়িতে দেবী লক্ষীর মূর্তির দেখা তো মেলে না তেমন। কিন্তু তাঁর বাহনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় আকছার। কেন? এই প্যাঁচা কি ভাস্কর, সূত্রধরদের সেই প্রাচীণ আদিবাসী সংস্কৃতির উড্ডীয়মান ধারা?

ওদিকে, ষোড়শ শতকে বাংলা ভেসে গেল চৈতন্যদেবের নেতৃত্বাধীন ভক্তি আন্দোলনের জোয়ারে। সমাজের তথাকথিত নিচু স্তরের মানুষের মাথা উচুঁ করে দাঁড়ানোর সেই আন্দোলনের প্রভাব পড়ল কাঠপুতুল শিল্পেও। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব স্থায়ী জায়গা করে নিল ভাস্কর, সূত্রধরদের কাঠখোদাই শিল্পে। কৃষ্ণ, রাধা-কৃষ্ণের যুগল-মূর্তিও যুক্ত হল পুতুলের তালিকায়। ছোট-বড় রাজা, জমিদাররা পুষ্ট হতে থাকল ইংরেজ শাসনকালে। জমকালো রংবাহার,পাকানো গোঁফ নিয়ে নতুনগ্রামের পুতুল শিল্পেও জাঁকিয়ে বসলেন জমিদার ও জমিদার-গৃহিনী বা রাজা-রাণী। বর্ধমানের শক্তিশালী রাজতন্ত্র রক্ষার জন্য তৈরি হয়েছিল সশস্ত্রবাহিনী। এখনো পাওয়া যাবে সেনা-পুতুল। খোঁজ করলে পাবেন গোপীনাথের কাষ্ঠনির্মিত মূর্তি। দেবতা গোপীনাথকে বর্ধমানের অগ্রদ্বীপ শহরের অভিভাবক দেবতা বলে গণ্য করা হয়।

 

নতুনগ্রামের তরুণ শিল্পী গৌরাঙ্গ ভাস্কর জানালেন, পুতুল তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয় ছাতিম, শিমূল, আম, আতা, গামার প্রভৃতি গাছের কাঠ। ফ্যাব্রিক ও অয়েল পেইন্ট ব্যবহৃত হয় রঙের বর্ণাঢ্যতা ফুটিয়ে তোলার জন্য।

সাধারণত সূক্ষ্ম হাতে পুতুলে রং-বাহার ফুটিয়ে তোলার কাজটি করে থাকেন মহিলারা। কাঠ খোদাই করে পুতুলের মূল অবয়বটি তৈরি করেন পুরুষেরা। একেবারে শিশু ছাড়া কাজে হাত লাগান পরিবারের প্রায় সকলেই।

নতুনগ্রামের এই ঐতিহ্যবাহী পুতুলশিল্পের অগ্রগামীতার লক্ষ্য নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অণু,ক্ষুদ্র,মাঝারি শিল্প ও বস্ত্রবয়ন বিভাগ ও ইউনেস্কো যৌথ উদ্যোগে নতুনগ্রামকে রাজ্যের অন্যতম ক্রাফট হাব হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ নতুনগ্রামে ফোক আর্ট সেন্টার তৈরি করেছে। এখানে রয়েছে সংগ্রহশালা এবং নতুনগ্রামে বেড়াতে আসা অতিথিদের জন্য থাকবার ব্যবস্থা। পুতুল বিপণনের জন্য রয়েছে স্বামী জানকীদাস নতুনগ্রাম উড কার্ভিং আর্টিজানস ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি।

বেড়ানোর কথা

পুতুল চাইগো? যদি চাই তো চলুন নতুনগ্রামে। পছন্দের পুতুলটি হাতে তুলে নিন। শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলুন। দেখুন, কীভাবে কিশোরী মেয়েটি কী আত্মপ্রত্যয়ে হাতে তুলে নেয় রঙের তুলিটি। ঘুরেফিরে দেখুন এ-গ্রাম সে-গ্রাম, শীতের শর্ষেখেত, বর্ষার আদিগন্ত ধানখেত। কাছেই সিঙ্গি গ্রামের অনাবিল প্রকৃতি আপনার মন ভালো করে দেবে।

সিঙ্গি গ্রাম। ছবি: সম্রাট বন্দ্যোপাধ্যায়।

ছবি: সম্রাট বন্দ্যোপাধ্যায়।

আর মণ্ডা? সে তো আরেক কথা। কাটোয়া, অগ্রদ্বীপ, সিঙ্গী, নতুনগ্রাম মণ্ডাময়। খাটি ছানার তৈরি ডবলডেকার আসলি মণ্ডা, ওঃ, সে কী কথা বলার কথা না কী; সে চেখে দেখার ব্যাপার, অভিভূত হওয়ার কথা। একবার আস্বাদ পেলে মণ্ডার তারিফ গাইবেন, এ কথা নিশ্চিত।

শীতের মরশুমে নতুনগ্রামে বর্ণময় একটি মেলা আয়োজিত হয়। এবারের মেলার দিনক্ষণ এখনো স্থির হয়নি।

মণ্ডা, বর্ধমানের আরেক খাদ্য ঐতিহ্য।

যাওয়ার পথ

কাছের রেলস্টেশন অগ্রদ্বীপ। হাওড়া বা শিয়ালদা থেকে কাটোয়া রেলপথের কোনও ট্রেনে উঠে পড়ুন । নামবেন অগ্রদ্বীপ স্টেশনে, ওখান থেকে সাড়ে ১২ কিলোমিটার নতুনগ্রাম। কাটোয়া থেকেও যাওয়া যাবে, দুরত্ব ১৮ কিলোমিটার। সড়কপথে বর্ধমান বা শান্তিনিকেতন থেকে নতুনগ্রাম দেড় ঘন্টার পথ। কলকাতা থেকে দিল্লি রোড ধরে কাটোয়ার পথে মেমারী, দাঁইহাট হয়ে নতুনগ্রাম পৌঁছাতে ঘন্টা চারেক সময় লাগে ।

থাকার ব্যবস্থা

নতুনগ্রামের ( মিস্ত্রীপাড়া, পোঃ পাটুলি, থানাঃ পূর্বস্থলী, মহকুমাঃ কালনা, জেলাঃ পূর্ব বর্ধমান), ফোক আর্ট সেন্টার-এ থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। দ্বিতল বাড়ির প্রথম ও দ্বিতল মিলিয়ে রয়েছে মোট ৪টি থাকার ঘর। অন্তত ১২ জন তো থাকতেই পারেন। তেঁতুলপাতায় ৯ জনের দর্শনে বিশ্বাসী হলে চার ঘরে ষোল জনের বসবাসের ব্যবস্থাও হতে পারে বলে জানাচ্ছেন গৌরাঙ্গবাবু। দিনপ্রতি মাথাপিছু থাকা-খাওয়ার খরচ ১২০০ টাকা। বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগের নম্বরঃ ৭৬৭৯০-৯৯২০৫।

শান্তিনিকেতন লজ (সিঙ্গি)ঃ এই লজের তিনতলার বড় আকারের দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া দিনপ্রতি ২১০০ টাকা। তিনতলার অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া দিনপ্রতি ১৮০০ টাকা। দোতলার বড় দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ১৫০০ টাকা ও দোতলার ছোট আকারের দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ১৩০০ টাকা। একতলার বাগান-সংলগ্ন ঘরটি চার শয্যার। ভাড়া দিনপ্রতি ১৬০০ টাকা। কোনও ঘরে অতিরিক্ত একজন অতিথির থাকার ব্যবস্থার জন্য ৩০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। গাড়ি নিয়ে এলে ড্রাইভারের থাকার জন্য ডর্মিটরির ব্যবস্থা আছে। থাকা এবং সারাদিনের খাওয়াদাওয়া বাবদ দিনপ্রতি খরচ পড়বে নিরামিষ খাবারের ক্ষেত্রে ৫৯৯ টাকা এবং আমিষ খাবারের ক্ষেত্রে ৭৯৯ টাকা। যোগাযোগের নম্বরঃ ৭০৪৪৭-৯১৪৩৬।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *