Follow us
Search
Close this search box.

শীতের রোদ্দুর গায়ে মেখে মন্দারমণি

শীতের রোদ্দুর গায়ে মেখে মন্দারমণি

পুরনো দিনের আঞ্চলিক লোকজনের কাছ থেকে জানা যায়, আগে সমুদ্র-তীরবর্তী জায়গাটার নাম ছিল মন্দারবনী। কেন? মন্দার গাছের প্রচুর ঝোপঝাড় ছিল জায়গাটায়। মন্দারবনীর সেই বন্য রূপ এখন অতীত। মন্দারবনী কালক্রমে লোকমুখে হয়েছে মন্দারমণি। তবে, একথাও ঠিক যে, পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে বঙ্গোপসাগর তীরের এই সৈকতটি একটি উজ্জ্বল মণি-সম ভ্রমণ ঠিকানা হয়ে উঠেছে।

মন্দারমণি বেড়ানো যায় বছরভরই। হোটেল, রিসর্টে ঠাণ্ডার মেশিন তো আছেই, তারপর বিকেল-সন্ধ্যায় সমুদ্র থেকে বয়ে আসা শরীর জুড়োনো বাতাস, তারপর সমুদ্রস্নান, ফলে গরমেও মন্দারমণি ভ্রমণে ছেদ পড়ে না। তবে চমৎকার এই সৈকতটিতে বেড়াতে যাওয়ার সেরা সময় যদি বেছে নিতেই হয়, তবে একটা নয়, দুটো মরশুমকে বেছে নিতে হবে। শীত ও বর্ষা।

বৃষ্টিতে সমুদ্র স্নানের মজাই আলাদা। সমুদ্র আর সৈকত জুড়ে বৃষ্টিধারার রত রাগ-রাগিনী, গরম চা-কফি, উষ্ণতায় মাখামাখি মাছভাজা, সে এক রোমান্টিক মন্দারমণি।

দূরে দূরে কুয়াশা। স্বর্ণাভ সৈকতে সোনারবরন রোদ্দুর, নীল আকাশ, নীল সমুদ্র। শীতে মন্দারমণি বড় বর্ণময়। আরামদায়কও বটে। শীতের রোদ্দুর শরীরে জড়িয়ে সৈকত ধরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত হিমের পরশ পাওয়া যায় মন্দারমণির সৈকতে।

১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ মন্দারমণির সৈকত। ভারতের দীর্ঘতম গাড়ি চলাচলের উপযোগী সৈকতের দাবিদার মন্দারমণি। একটু হেঁটে গেলে সমুদ্র-তীর বরাবর ঝাউবন, কেয়াঝাড়, ছাগলখুরি লতা, স্পিনিফেক্স ঘাসের সম্মিলিত সবুজাভ প্রেক্ষাপটে মন্দারমণির শান্তশ্রী মনে গাঁথা হয়ে থাকে। ওই স্পিনিফেক্স ঘাস স্বমুদ্রতীরের বালির ঢিবি ধরে রেখে ভূমিক্ষয় রোধ করে।

সামগ্রিক মন্দারমণির পরিসরটা প্রশস্ত। ভিড়ভাট্টা কম। হৈ চৈ নেই। সকাল-বিকেলে আকাশে, সমুদ্রে, বালুবেলায় রৌদ্রকিরণের নানা রং, জলের প্রান্ত বরাবর সফেন আঁকিবুকি, ঢেউয়ে ভেসে আসা ঝিনুক, স্টার ফিস বা সাগরকুসুম, লাল কাঁকড়ার খেলাধূলা, এই সব দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে দিয়ে সৈকত ভ্রমণ আপনার ছোট্ট ছুটিটাকে সার্থক করবে, এ কথা নিশ্চিত করেই বলা চলে।

বালির ওপর দিয়ে চলার উপযোগী চওড়া টায়ারের গাড়িতে চড়ে সৈকতে বেড়ানো যায়। বাইকে সওয়ারী হয়ে বেড়িয়ে আসা যায় আনেকটা। দীঘার মতো উত্তাল নয় মন্দারমণির সমুদ্র। ভাটায় একটু এগিয়ে গিয়ে সমুদ্রস্নান করা যায় নিরাপদে। জোয়ারে সমুদ্র এগিয়ে আসে তীরের দিকে। ভাটায় ভিজে বালির ওপর দিয়ে পদচারণাও বেশ উপভোগ্য।

হোটেল-রিসর্ট আছে। আগাপাশতলা কংক্রিটের জঙ্গল নেই। এখনো অবধি নয়। নানা বিধি-নিষেধও আছে নির্মাণের ক্ষেত্রে। ওই খোলামেলা পরিবেশটাই মন্দারমণির সৌন্দর্য। কলকাতার ধর্মতলা অঞ্চল থেকে কলকাতা-দীঘা সড়কপথে মন্দারমণি ১৭০ কিলোমিটার মাত্র। গিয়ে পড়া এক উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে। সামনে, ডানে-বাঁয়ে দিগন্তজোড়া সমুদ্র, আর ওই সুবিস্তৃত বালুকাবেলা।

লাইন দিয়ে দোকানপাটের ঝনঝনানি নেই। সৈকত ধরে হাঁটুন, মাঝে মাঝে ছোট ছোট দোকান চোখে পড়বে, হাতে চায়ের কাপ নিয়ে একটু বসুন, একটু বিশ্রাম, একটু গল্পগাছা, ভালোই লাগবে। ভাজা মাছ খেতে চাইলে এইসব দোকানে সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। নিজেরাও মাছ কিনে এনে ভাজিয়ে নিতে পারেন। চোখে পড়বে নদীতীরের গ্রামীণ জীবন, একলা নৌকা, মাছ ধরার জাল। ডাবের জলে তৃষ্ণা মিটবে। সকাল সকাল পেয়ে যেতে পারেন টলটলে খেজুরের রস। সৈকত ধরে দেড়-দু’ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায় জলদা খালের কাছে। গ্রামের মধ্যে দিয়ে খালটি এসে মিশেছে সমুদ্রে। মৎসজীবীরা সমুদ্রে মাছ ধরে ওই খালপথে গ্রামে ফেরেন। গগনচুম্বী সব ঝাউগাছের দেখা মিলবে জলদা খাল-সংলগ্ন এলাকায়। মৎসজীবীদের নৌকায় চেপে চলে যাওয়া যায় খালের অপর পারে। একটু দীর্ঘ হাঁটাহাঁটির ইচ্ছে থাকলে জলদা খাল পেরিয়ে পায়ে পায়ে পৌঁছে যাওয়া যায় শঙ্করপুরের সৈকতে।

সমুদ্রের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে, বাঁ-দিকের একটা খাল পেরলে আরেক সৈকত, তাজপুর। সড়কপথে মন্দারমণি-তাজপুর দূরত্ব ১৯ কিলোমিটার।

মন্দারমণি থেকে বাঁ-দিকে ধরে কমবেশি আড়াই কিলোমিটার হেঁটে বেড়িয়ে আসা যায় দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুর সৈকত থেকে। সত্যি সত্যিই যাকে বলে ভার্জিন বিচ। ধূ ধূ সমুদ্র। ধূ ধূ সৈকত। যেন নামী সৈকতগুলোর পাশে আত্মগোপন করে আছে। সমুদ্র-সৈকত তার নিজের মতোই উদাসীন এখানে। আবিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছি আমরা। তবে কংক্রিটে যেন ছেয়ে না যায় জায়গাটা। কাছেই শ্রীরামকৃষ্ণ সেবা সঙ্ঘের মন্দির।

একদিকে দীঘা, অন্যদিকে মন্দারমণি। এই দুই সীমানার মাঝে দীঘার দিক থেকে এলে প্রথমে শঙ্করপুর, তারপরে তাজপুর সৈকতের অবস্থান। দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ তৈরি করে এই চার সৈকতকে একই সূত্রে বাঁধার পরিকল্পনা রয়েছে প্রশাসনের। দীঘা থেকে মন্দারমণি ৩০ কিলোমিটার।

যাওয়ার পথ

ট্রেনে গেলে নিকটবর্তী স্টেশন কাঁথীতে নামতে হবে। কাঁথী থেকে মন্দারমণি যাওয়ার জন্য প্রাইভেট গাড়ি পাওয়া যাবে। বিভিন্ন হোটেল থেকে পিকআপের ব্যবস্থা করা হয়। দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার। কলকাতা এবং কলকাতা-সংলগ্ন অঞ্চল থেকে মন্দারমণি যেতে চাইলে এসপ্ল্যানেড বা হাওড়া থেকে দীঘাগামী বাসে উঠে পড়াই শ্রেয়। নামতে হবে চাউলখোলা স্টপেজে। চাউলখোলা থেকে টোটো, অটোরিক্সা পাওয়া যাবে মন্দারমণি যাওয়ার জন্য। নিজেদের গাড়িতে এলে কোলাঘাট, মেচেদা, কাঁথী, চাউলখোলা ও কালিন্দী, দাদনপাত্রবার হয়ে মন্দারমণি চলে আসুন।

থাকার ব্যবস্থা

দাদনপাত্রবারের শেষ দিকটায় অর্থাৎ দাদনপাত্রবারের দিক থেকে মন্দারমণির সৈকতের শুরুতেই রয়েছে এক ঝাঁক হোটেল-রিসর্ট রয়েছে। এখান থেকে আরও কয়েক কিলোমিটার এগলে ঢুকে পড়া যাবে আরেক ঝাঁক হোটেল-রিসর্টের চৌহুদ্দিতে।

 

ছবিঃ  মনোজিৎ মুখোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *