ভোর হতে না হতেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দু’ কিলোমিটার পথ হেঁটে রাজাভাতখাওয়ার তেইশ মাইল ওয়াচটাওয়ারে যাওয়া প্রায় রোজকার ঘটনা হয়ে উঠেছে। ঘুম না ভাঙা বনবস্তির ঘর-গেরস্থালী পেরিয়ে প্রথম খানিকটা যেতে হবে জঙ্গলের শুঁড়িপথ ধরে। পুটুস ও আরও পাঁচ-সাত রকমের বুনো ঝোপ আর চারপাশের পাঁচ-সাততলা-সমান উচুঁ জারুল, শিশু, পানিসাজ, লালী বৃক্ষের জটলা ভেদ করে তখনো সূর্যের আলো জঙ্গল-অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারেনি।
জঙ্গলের পথ ছেড়ে উঠে আসি পিচরাস্তায়। এখান থেকে জঙ্গলের প্রবেশপথে অবস্থিত চেকপোস্ট নজরে আসে না। রাস্তার দু’ পাশেই এখন ঘন জঙ্গল। গাছের গুড়ি ও কান্ডে শ্যাওলার ছোপ এখন ইষৎ ফিকে। সময়টা মার্চ মাস। একটু বৃষ্টি হলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। না হলে জঙ্গলে আগুন লাগবে। বনবস্তির মানুষও বলে ‘ফরেস্ট ফায়ার’। দাবানল বলতে কাউকে শুনিনি।
বাকি পথটুকু হাঁটতে হয় জোরকদমে। বাঘের ভয় নেই। চিতাবাঘ থাকলেও হামলার ভয় নেই। গাউর বা ভারতীয় বাইসনদের রাস্তা পার হওয়ার চিহ্ন, খুরের দাগ দেখি প্রায়শই। তাদের নিয়েও তেমন চিন্তা নেই। চিন্তা বা আশঙ্কা কেবল মহাকালবাবাকে নিয়ে। তরাই, ডুয়ার্সের চা-বাগান, বনবস্তির মানুষ হাতিকে মহাকালবাবা বলে ডাকে। জঙ্গলের পথে চলতে চলতে ‘জয় বাবা মহাকাল’ ‘জয় বাবা মহাকাল’ জপতে হয়। কাছেপিঠে প্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ ডাক শুনলে বুকের ঢিবঢিবানি এক লাফে কয়েকগুন বেড়ে যায়।
ওয়াচটাওয়ারের কাছে পৌঁছালে খানিকটা নিশ্চিন্ত। মহাকালবাবা তাড়া করলে দৌড়ে উপরে উঠে যেতে পারব। একটু ধৈর্য ধরে আপেক্ষা করতে পারলে এই ওয়াচটাওয়ার চত্বরটি ওয়ািল্ডলাইফ পর্যবেক্ষণের একেবারে হটস্পট। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ভোরের আলো ফুটতে একটু দেরি হয়। ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়ে স্থানীয় কোনও গাইড সঙ্গে নিয়ে ভোর সাড়ে পাঁচটার মধ্যে ওয়াচটাওয়ারে পৌঁছে যান। ঘন্টা দেড়েক সময় কোথা দিয়ে কেটে যাবে খেয়ালই থাকবে না।
ওয়াচটাওয়ারের পাশেই প্রাচীন এক শিবমন্দির। ওই জঙ্গলের মধ্যে এক সাধুবাবা একা থাকেন এই মন্দিরে। জায়গাটা সম্পর্কে যাঁরা জানেন তাঁরা অটো বা প্রাইভেট গাড়িতে বক্সা-জয়ন্তী যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যান এখানে। মন্দির দর্শন আর সাধুবাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ সেরে ফের রওনা দেন। মন্দিরে যা প্রণামী পড়ে তাতেই সাধুবাবার চলে যায় একরকম। মাঝেমধ্যে শহরের বাজারে যেতে হলে বনবস্তির কারুর দু-চাকার গাড়িতে চেপে বসলেই হলো। একই রকমে ফেরা।
সাধুবাবা আমাদের কাছে উপকারী আরেকটি কারণে। ওয়াচটাওয়ারের কাছাকাছি জন্তুজানোয়ার চলাচলের নানা খবরাখবর পাওয়া যায় তার কাছ থেকে। কাছাকাছি হাতি আছে কিনা, গাউরের যে দলটা ভোররাত থেকে পেছনের জঙ্গলটায় রয়েছে তারা দলে ভারী কিনা কিংবা মন্দিরের পাশের নাম না জানা গাছটায় জায়ান্ট স্কুইরেল ঠিক কখন দেখা যেতে পারে, এ সব জানার জন্য সাধুবাবার শরণাপন্ন হতে হয়।
ওয়াচটাওয়ারের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া কাঁচা রাস্তার মুখে ক্যামেরায় চোখ রেখে বসে আছি। বাচ্চা, বুড়ো মিলিয়ে ছ’টা বাইসন রাস্তা পার হচ্ছে। এক মিনিট, এক মিনিট করে সময় পার হচ্ছে। ভিউ ফাইন্ডার থেকে চোখ সরানো যাচ্ছে না। একসময় পরিমল বলে, ‘দাদা ওঠেন, আর নাই’। পরিমল আমার রাজাভাতখাওয়ার সঙ্গী ও গাইড। চেকপোস্টের সামনে ওর চা-জলখাবারের দোকান। একটু তফাতে ওর কাঠের ছিমছাম হোমস্টে। এই দুই নিয়ে সকাল থেকে রাত বেশ আছে পরিমল। জঙ্গল বড় ভালোবাসে ছেলেটা। গ্রেট হর্নবিলের ডাক শুনে তার সন্ধান করতে জোঁকের তোয়াক্কা না ক’রে কাদামাটিতে নেমে যেতে দেখি ওকে।
চেকপোস্টের সামনে গুটিকয়েক দোকান। গরম লুচি-পুরি-তরকারি ও চা-সহযোগে সকালের আহারের ব্যবস্থা আছে। খেতে খেতে দেখতে পাচ্ছি, জয়ন্তী, বক্সা যাওয়ার টুরিস্ট বোঝাই গাড়িগুলো একে একে জড়ো হচ্ছে। মাথাপিছু ৬০ টাকা এন্ট্রি ফি। গাড়ির জন্য আরও ২০০ টাকা। সাড়ে ৭টায় জয়ন্তীর বাস আসবে আলিপুরদুয়ার থেকে। দিনে দুটি ট্রিপ। সকালের বাসে জয়ন্তী গিয়ে আবার বিকেলের বাসে ফিরে আসা যায় রাজাভাতখাওয়ায়।
একটু বেলা বাড়তে চললাম রাজাভাতখাওয়ার নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টারে (এন আই সি )। হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় দেখি, মাটির সঙ্গে মিশে থাকা কোনও জৈব পদার্থকে ঘিরে রংয়ের বাহার বইয়ে দিয়েছে লাল, নীল, সাদা, হলুদ প্রজাপতির ঝাঁক। পরে এরকম দৃশ্য আরও অনেকবার দেখেছি। পূর্ব-ডুয়ার্স প্রজাপতির আপন ভূমি।
এন আই সি কম্পাউন্ডের মধ্যেও হাজারো গাছের মেলা। বক্সার বাঘবন সম্পর্কে খুঁটিনাটি অজস্র তথ্য মিলবে এখানে। সংগ্রহশালায় আঞ্চলিক জীববৈচিত্র সম্পর্কিত প্রচুর ছবি ও সংরক্ষিত নিদর্শন দেখা যাবে। বাঘ, চিতাবাঘ, ক্লাউডেড লেপার্ড, স্নো লেপার্ডের স্টাফ করা অবয়বগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠার অপেক্ষায়। এন আই সি-সংলগ্ন অর্কিড সেন্টারটিও দেখবার মতো। বক্সা অরণ্যে প্রাপ্ত সমস্ত অর্কিডের তালিকা পাওয়া যাবে এখানে। এন আই সি খুঁটিয়ে দেখতে হলে একবেলা সময় লাগবে। উৎসাহী পর্যটকদের বলব, সময়াভাবে অন্তত দু’ ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে এন আই সি যাবেন। রাজাভাতখাওয়ায় রয়েছে দেশের অন্যতম শকুন সংরক্ষণ ও প্রজনন কেন্দ্র। তবে সাধারণত পর্যটকদের এই কেন্দ্রের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি মেলে না।
যাঁরা জঙ্গলে যান, তাঁরা জঙ্গলে সন্ধ্যা নামার আশ্চর্য সন্ধিক্ষণটির কথা অবশ্যই জানবেন। বেলা বয়ে কখন বিকেল হয়েছে। পুবদিক থেকে আসা শনশনে হাওয়া একটা ঠাণ্ডাভাব বয়ে আনছে। উচ্চতায়, বিস্তারে বিরাট এক ময়না গাছের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সে গাছে অজস্র কোটর। সেই কোটরগুলোতে চন্দনাদের (আলেকজান্দ্রিন প্যারাকিট) বসবাস। উড়ে আসছে, বসছে, আবার উড়ে যাচ্ছে। এ হচ্ছে দিন শেষের ব্যস্ততা। কাছাকাছি জায়গাটা সরগরম হয়ে রয়েছে টিয়াদের ডাকাডাকিতে। উত্তরের ঘন জঙ্গল থেকে দু’জোড়া ওরিয়েন্টাল পাইড হর্নবিল উড়ে এসে বসল পাতা খসে যাওয়া এক গাছের ডালে। ময়না গাছের সবক’টি ডাল চুঁইয়ে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল আমার পায়ের কাছের প্রতিটি ঘাসে। আজকের মতো পশ্চিমের শেষ আলোর আভায় দু’জোড়া হর্নবিল তখন এক দুর্দান্ত সিল্যুয়েট হয়ে নেড়া গাছের ডালে বসে।
হাঁটতে হাঁটতে বক্সা চেকপোস্টের সামনে পরিমলের চায়ের দোকানে গিয়ে উঠি। ‘আসেন দাদা, এই চা বসাই”, পরিমলের আন্তরিক আহ্বান। চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে সামান্য হেঁটে চৈতন্য ঝোরার উপরে ব্রিজের রেলিংয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াই।
চাঁদের আলোর মায়াবী রঙের প্রলেপ পড়েছে জঙ্গলের গায়ে। আ-উ-উ, সাময়িক নীরবতা-ভাঙা ডাক দিয়েই সে উড়ে গেল আমার সবচেয়ে কাছের গাছটা থেকে। এশিয়াটিক বারড আউলেট। সফেদ ডানার উড়ান অনুসরণ করে তাকে আবিষ্কার করলাম অদূরে, আরেকটা গাছের ডালে। তার সঙ্গি বা সঙ্গিনীর সঙ্গে হয়তো সাক্ষাতের কথা আছে এই এলাকাতেই। তক্ষ-তক্ষ-তক্ষ, ডাকটা ভেসে আসছিল ঝোরার ওপার থেকে। সাতটাতেই আঁধার ঘন হয়ে উঠেছে।
রাত যতই হোক, প্রতিদিনের সব কাজ সেরে চার ব্যাটারির টর্চ হাতে পরিমল ডাকতে আসে, “চলেন দাদা একটু হেঁটে আসি”। জঙ্গল ঘেঁষা বনবস্তির নানান প্রান্ত ধরে হাঁটি আর জঙ্গলের নানা আওয়াজ শুনি। রাতের জঙ্গলের ভাষা কান পেতে বোঝার চেষ্টা করি। সে ভাষার তান, লয় পথের এক এক বাঁকে এক এক রকম। একাধিক বার গিয়েছি রাজাভাতখাওয়ায়। জায়গাগুলের অনেকটা চিনেও ফেলেছি। শেষ কবে কোন এলাকায় বাইসনের দল দেখা গেছে, হাতি কবে কার ঘর ভেঙেছে, কীভাবে বনকর্মীরা একটি চিতাবাঘের অনাথ বাচ্চাকে উদ্ধার করলেন। নিচু স্বরে পরিমল বলে চলে, আমি শুনি।
উত্তর-পশ্চিমের জঙ্গল থেকে হাতির ডাক শুনেছি আগেও। আজও ঘরে ফেরার আগে মহাকালবাবার ডাক শুনেছি। পরিমল আজ তাড়াতাড়ি ডাকতে এল। দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে বলল, “দাদা চলেন, ডিমা নদীর দিকে হাতি বাইর হইছে”।
হাতে চার ব্যাটারির টর্চ, পায়ে হাওয়াই চটির পরিমল বলে, “রেললাইন ধরে দৌডাইতে হইতে পারে, জুতাজোড়া পায়ে দিয়া আসেন দাদা”।
এক মিনিট পরিমল”, আমি উত্তর করি।
প্রয়োজনীয় তথ্য
রাজাভাতখাওয়া চেকপোস্ট থেকে প্রতিদিন সকাল-বিকেলে রয়েছে বনবিভাগের জিপসি সাফারির ব্যবস্থা। সাফারি হয় ২৩ ও ২৪ মাইলের মধ্যে। চেকপোস্টের বুকিং কাউন্টার থেকে সাফারির বুকিং করতে হবে। রাজাভাতখাওয়া থেকেই বেড়িয়ে নেওয়া যায় বক্সা ফোর্ট ও জয়ন্তীর জঙ্গল।রাজাভাতখাওয়া থেকে দমনপুর হয়ে যেতে পারেন সিকিয়াঝোরা। সিকিয়াঝোরাকে ডুয়ার্সের এক টুকরো সুন্দরবন বলা যেতে পারে। এখানে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনায় বোটে করে সাফারি করা যায়। বোটে চড়ে যেতে যেতে মনে হবে সুন্দরবনের অরণ্যের মধ্যে কোনও খাঁডিতে আছেন।
যাওয়ার পথ
শিয়ালদহ থেকে উত্তরবঙ্গগামী কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে শেষ স্টেশন আলিপুরদুয়ার জংশন নামবেন। শিয়ালদহ বা হাওড়া থেকে গুয়াহাটিগামী ট্রেনে নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনেও নামতে পারেন। আলিপুরদুয়ার থেকে
রাজাভাতখাওয়া ১৭ কিলোমিটার। জংশন স্টেশন থেকে অটোরিক্সা পাওয়া যাবে। রাজাভাতখাওয়ার পথে ৩ কিলোমিটার এগলেই দমনপুর চেকপোস্ট। বক্সা জঙ্গলের শুরু এখান থেকেই।
থাকার ব্যবস্থা
পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের বক্সা জঙ্গল লজ। ডিলাক্স ঘরের ভাড়া ২০০০ টাকা, সুপার ডিলাক্স ঘরের ভাড়া ২৫০০ টাকা। বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগের ঠিকানাঃ কে বি-১৯, সেক্টর-৩ (বেলেঘাটা-বাইপাস কানেক্টরের কাছে), কলকাতা-৭০০১০৬। ফোনঃ ০৩৩-৪০৬৪-৪১২৮, ৭৬০৪০৪৪৪৭৯।
বকিংয়ের সময়ঃ বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টে।
মামন ট্রেকার্স হাট, ফোনঃ ৯৭৩৫০-৬২৩৯৭। গ্রাসিলিপস টুরিস্ট লজ, ৯৪৩৪৬-৩০৯৫৪।
বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের অধীন দুটি বনবাংলো লিও হাউস ও টাইগার লজ-এর মধ্যে কোনওটিতে থাকতে হলে যোগাযোগ করতে হবে এই ঠিকানায়ঃ ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টর, পশ্চিম-পূর্ব, বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প, পোঃ আলিপুরদুয়ার, পিন-৭৩৬১২২। ফোনঃ ০৩৫৬৪ -২৫৫১২৯।