
আদি নাম মন্দারবনী। সমুদ্রের তীর ধরে মন্দার গাছের জঙ্গল ছিল জায়গাটায়। মন্দারবনীর সেই বন্য রূপ এখন অতীত। মন্দারবনী কালক্রমে হয়েছে মন্দারমণি। একথাও ঠিক যে, পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে বঙ্গোপসাগর তীরের এই সৈকতটি একটি উজ্জ্বল মণি-সম ভ্রমণ ঠিকানা হয়ে উঠেছে। চমৎকার এই সৈকতে বেড়াতে যাওয়ার সেরা সময় যদি বেছে নিতেই হয়, তবে একটা নয়, দুটো মরশুমকে বেছে নিতে হবে। শীত ও বর্ষা।

দূরে দূরে কুয়াশা। স্বর্ণাভ সৈকতে সোনারবরন রোদ্দুর, খোলা আকাশ। রঙিন ছাতা। আর সমুদ্র। শীতে মন্দারমণি বেশ বর্ণময়। আরামদায়কও বটে। শীতের রোদ্দুর শরীরে জড়িয়ে সৈকত ধরে বেড়ানোর মজাটা পাওয়া যায় এই শীতের সময়টায়। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত হিমের পরশ পাওয়া যায় মন্দারমণির সৈকতে।

মোট প্রায় ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ মন্দারমণির সৈকত। ভারতের দীর্ঘতম গাড়ি চলাচলের উপযোগী সৈকতের দাবিদার মন্দারমণি। একটু হেঁটে গেলে সমুদ্রতীর বরাবর ঝাউবন, কেয়াঝাড়, ছাগলখুরি লতা, স্পিনিফেক্স ঘাস চোখে পড়ে। স্পিনিফেক্স ঘাস স্বমুদ্রতীরের বালির ঢিবি ধরে রেখে ভূমিক্ষয় রোধ করে।
সামগ্রিক মন্দারমণির পরিসরটা প্রশস্ত। দিঘার ভিড়টা এখানে নেই। সকাল-বিকেলে আকাশে, সমুদ্রে, বালুবেলায় রৌদ্রকিরণের নানা রং, জলের প্রান্ত বরাবর সফেন আঁকিবুকি, ঢেউয়ে ভেসে আসা ঝিনুক, স্টার ফিস বা সাগরকুসুম, লাল কাঁকড়ার খেলাধূলা দেখা যায় ছোট্ট ছুটিতে। সঙ্গে বিশ্রাম। খাওয়াদাওয়া।
বালির ওপর দিয়ে চলার উপযোগী চওড়া টায়ারের গাড়িতে চড়ে সৈকতে বেড়ানো যায়। বাইকে করে সৈকত ধরে বেড়িয়ে আসা যায় খানিকটা। দিঘার মতো উত্তাল নয় মন্দারমণির সমুদ্র। ভাটায় একটু এগিয়ে গিয়ে সমুদ্রস্নান করা যায় নিরাপদে। জোয়ারে সমুদ্র এগিয়ে আসে তীরের দিকে। ভাটায় ভিজে বালির ওপর দিয়ে পদচারণাও বেশ উপভোগ্য।
হোটেল-রিসর্ট আছে। তবে এখনো আগাপাশতলা কংক্রিটে মুড়ে যায়নি মন্দারমণি। নানা বিধি-নিষেধও আছে নির্মাণের ক্ষেত্রে। ওই খোলামেলা পরিবেশটাই মন্দারমণির সৌন্দর্য। কলকাতার ধর্মতলা অঞ্চল থেকে কলকাতা-দীঘা সড়কপথে মন্দারমণি ১৭০ কিলোমিটার।

নদীতীরের গ্রামীণ জীবন, একলা নৌকা, মাছ ধরার জাল, ভিজে সৈকতে আঁকিবুকি। দিনমানে ডাবের জলে তৃষ্ণা মিটবে। সকাল সকাল পেয়ে যেতে পারেন টলটলে খেজুরের রস। সৈকত ধরে দেড়-দু’ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায় জলদা খালের কাছে। গ্রামের মধ্যে দিয়ে খালটি এসে মিশেছে সমুদ্রে। মৎসজীবীরা সমুদ্রে মাছ ধরে ওই খালপথে গ্রামে ফেরেন। গগনচুম্বী সব ঝাউগাছের দেখা মিলবে জলদা খাল-সংলগ্ন এলাকায়। মৎসজীবীদের নৌকায় চেপে চলে যাওয়া যায় খালের অপর পারে। একটু দীর্ঘ হাঁটাহাঁটির ইচ্ছে থাকলে জলদা খাল পেরিয়ে পায়ে পায়ে পৌঁছে যাওয়া যায় শঙ্করপুরের সৈকতে।

সমুদ্রের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে, বাঁ-দিকের একটা খাল পেরলে আরেক নিরালা সৈকত তাজপুর। সড়কপথে মন্দারমণি-তাজপুর দূরত্ব ১৯ কিলোমিটার।
মন্দারমণি থেকে বাঁ-দিকে ধরে কমবেশি আড়াই কিলোমিটার হেঁটে বেড়িয়ে আসা যায় দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুর সৈকত থেকে। সত্যি সত্যিই যাকে বলে ভার্জিন বিচ। ধূ ধূ সৈকত। সৈকতটি তার নিজের মতো করে উদাসীন এখানে।
ট্রেনে গেলে নিকটবর্তী স্টেশন কাঁথীতে নামতে হবে। কাঁথী থেকে মন্দারমণি যাওয়ার জন্য প্রাইভেট গাড়ি পাওয়া যাবে। বিভিন্ন হোটেল থেকে পিকআপের ব্যবস্থা করা হয়। দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার। কলকাতা এবং কলকাতা-সংলগ্ন অঞ্চল থেকে মন্দারমণি যেতে চাইলে এসপ্ল্যানেড বা হাওড়া থেকে দীঘাগামী বাসে উঠে পড়াই শ্রেয়। নামতে হবে চাউলখোলা স্টপেজে। চাউলখোলা থেকে টোটো, অটোরিক্সা পাওয়া যাবে মন্দারমণি যাওয়ার জন্য। নিজেদের গাড়িতে এলে কোলাঘাট, মেচেদা, কাঁথী, চাউলখোলা ও কালিন্দী, দাদনপাত্রবার হয়ে মন্দারমণি চলে আসুন।
দাদনপাত্রবারের শেষ দিকটায় অর্থাৎ দাদনপাত্রবারের দিক থেকে মন্দারমণির সৈকতের শুরুতেই রয়েছে এক ঝাঁক হোটেল-রিসর্ট রয়েছে। এখান থেকে আরও কয়েক কিলোমিটার এগোলেলে ঢুকে পড়া যাবে আরেক ঝাঁক হোটেল-রিসর্টের চৌহুদ্দিতে।

ছবিঃ মনোজিৎ মুখোপাধ্যায়।





