সুব্রত ঘোষ
ব্যক্তিগত কাজে গিয়েছিলাম ব্যাঙ্গালোরে। হাতে কয়েক দিন সময় নিয়েই গিয়েছিলাম। কাজ শেষ হবার পরে প্রথমে মহীশূর বেড়ানো হল। ঐতিহাসিক এই শহরটায় বেড়ানোর জায়গার অভাব নেই। ২৬ এপ্রিল (২০২৫) সকালে তাক লাগানো মাইসোর প্যালেস দেখে কর্নাটকের কুর্গ তথা কোড়াগু জেলার প্রধান শহর মাদিকেরির উদ্দেশে রওনা দিলাম। মহীশূর থেকে মাদিকেরি সড়কপথে ১৫০ কিলোমিটার। মাদিকেরি কর্নাটকের চমৎকার একটি হিল স্টেশন।
মাদিকেরি যাওয়ার পথে নমড্রোলিং মনাস্ট্রি দেখা হল। মহীশূর জেলার বাইলাকুপ্পে এলাকায় মনাস্ট্রির অবস্থান। প্রচুর তিব্বতীর বসবাস এখানে। ১৯৬৩ সালে দ্রুবওয়াং পদ্ম নরবু রিনপোচে এই মনাস্ট্রি স্থাপন করেছিলেন। তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের নাইংমা শাখার বৃহত্তম শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে এই মনাস্ট্রিতে। মাদিকেরি পৌঁছে হোটেল অল্টিটিউডে ওঠা গেল।
পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পূর্ব ঢালে কোড়াগু বা কুর্গ জেলার অবস্থান। পার্বত্য জেলা। জেলার মধ্যে দিয়ে বইছে কাবেরী নদী। সবুজ পাহাড়ের ঢেউ, কফির বাগিচা, কুয়াশা, লেক, পার্ক, নদী, ঝরনা ইত্যাদির সমাহারে কুর্গ তার পরিচয় পেশ করে। সেই প্রস্তর যুগ থেকে কুর্গে মানুষের বসবাস। মূলত বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর বসবাস ছিল এখানে। কোড়াভা উপজাতি গোষ্ঠী মাদিকেরি থেকে অনেকদিন কুর্গ অঞ্চলকে শাসন করেছে। তারপর, ১৮৩৪ সালে কুর্গ ব্রিটিশদের দখলে এল। নানা সংস্কৃতির মিলমিশ ঘটেছে কুর্গে।
যাইহোক, পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্টের পরে বেরোলাম একটু এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে দেখতে। হারাঙ্গি ট্রি পার্ক ও এলিফ্যান্ট ক্যাম্প দেখতে গিয়েছিলাম। বেশ জায়গা। সঙ্গে নিয়ে আসা গাড়ি বাইরে রেখে শেয়ার গাড়িতে পার্কে প্রবেশ করতে হল। কয়েকটি হাতি চোখে পড়ল। পর্যটকরা এদের খাওয়াতে পারেন। খাবার ওখানেই কিনতে পাওয়া যায়। নানা জাতের গাছ আছে পার্কে। পাশেই হারাঙ্গি বাঁধ ও জলাধার। এখানকার ব্যাকওয়াটারে বোটিং করা যায়।
এরপর গিয়েছিলাম কাবেরী নিসর্গধামে। কাবেরী নদীর ওপর একটি দ্বীপ এটি। মাদিকেরি থেকে দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার। নিকটবর্তী শহর কুশলনগর। ২০০ মিটার দীর্ঘ একটি সাসপেনশন ব্রিজ পেরিয়ে দ্বীপে যেতে হয়। বাঁশের ঘন বন রয়েছে দ্বীপে। বাতাসের নানা শব্দ সেখানে। চন্দন গাছ দেখা গেল। আদিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনের নানা ভঙ্গিমার মূর্তি রয়েছে এখানে। নানা প্রজাতির পাখি চোখে পড়ছিল। জিপলাইন স্পোর্টের ব্যবস্থা রয়েছে। দ্বীপে ময়ূর, হরিণ, খরগোশের পার্ক রয়েছে। জায়গাটা বেড়িয়ে দেখতে খুব ভালো লেগেছে।
পরের গন্তব্য ছিল কাবেরী নিসর্গধাম থেকে ৩১ কিলোমিটার দূরের অ্যাবে ফলস। মাদিকেরি থেকে অ্যাবে জলপ্রপাতের দূরত্ব কম। ৬ কিলোমিটার। কাবেরী নদী এখানে ৭০ ফুট উচ্চতা থেকে নীচে ঝাঁপ দিয়েছে। খুব আওয়াজ এই জলপ্রপাতের। ৩০০ মিটার মতো নীচে নামলে ভালো করে দেখা যায় জলপ্রপাতটি।
পথে একটি সুন্দর ওয়াক্স মিউজিয়াম দেখে পৌঁছালাম মাউন্টেন ভিউ কফি প্লান্টেশন ভিউ পয়েন্টে। চমৎকার জায়গা। ছোট ছোট পাহাড়ের ঢালে ঢালে কফির বাগান। জৈব পদ্ধতিতে নানা প্রকার মশলার চাষও হয় এখানে। কফির বাগানে গাইডেড টুর আয়োজিত হয়। কফি, মশলা, চকোলেট ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যায়।
২৮ এপ্রিল সকাল সকাল পৌঁছালাম মাদিকেরির ওঙ্কারেশ্বর মন্দির। মাদিকেরি বাস টার্মিনাস থেকে মন্দিরের দূরত্ব ১ কিলোমিটার। শিবের মন্দির। রাজা দ্বিতীয় লিঙ্গরাজেন্দ্র ১৮২০ সালে মন্দিরটি স্থাপন করেন। মন্দিরটির স্থাপত্যশৈলী নজর কাড়ে। গথিক ও ইসলামিক স্থাপত্যরীতির মিশেল ঘটেছে মন্দির তৈরিতে। মন্দিরের সামনে একটি জলাশয়ে মাছ খেলে বেড়াচ্ছে দেখলাম।
মন্দির দর্শন করে রওনা হলাম থালাকাবেরীর উদ্দেশে। মাদিকেরি থেকে তালাকাবেরী ৪৫ কিলোমিটার। এই জায়গাটিকে কাবেরী নদীর উৎসস্থল বলে গণ্য করা হয়। জায়গাটি নিঃসন্দেহে অসাধারণ। পাহাড়ের ঢেউ দেখা যায় এখান থেকে। ১২৭৬ মিটার উচ্চতায় ব্রহ্মগিরি পাহাড়ের উপরে তালাকাবেরী মন্দিরের অবস্থান। কাছেই কেরালার কাসাড়গড় জেলা। হিন্দু ধর্মালম্বীদের কাছে থালাকাবেরী একটি তীর্থস্থান।প্রতিবছর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে (সাধারণত ১৭ অক্টোবর) কাবেরী উৎসব আয়োজিত হয়।
ফেরার পথে একাদশ শতকে চোলাদের রাজত্বকালে গড়ে ওঠা ভগন্দেশ্বর শিবমন্দিরটি দেখলাম। মন্দির চত্বরের অলংকরণে গাছপালা, সব্জি ইত্যাদির রং ব্যবহৃত হয়েছে। মন্দির দেখে চলে এলাম কুর্গের ত্রিবেণী সঙ্গমে। এখানে কাবেরী, কান্নিকে ও সুজ্যোতি নদী মিলিত হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে ধর্মীয় মাহাত্ম্য রয়েছে জায়গাটার। জায়গাটির শান্ত সৌন্দর্য মন কাড়ে।
ঐতিহাসিক মাদিকেরি ফোর্টে গিয়েছিলাম। ফোর্টের মধ্যে রয়েছে পুরনো প্রাসাদ। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তৈরি হয়েছিল এই দুর্গটি। ১৮’শতকে টিপু সুলতান দুর্গেটির সংস্কার করেছিলেন। দুর্গের মিউজিয়ামে অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনকাল পর্যন্ত ব্যবহৃত নানা অস্ত্র দেখা যায়। জেনারেল থিমাইয়া মেমোরিয়াল মিউজিয়ামও। জেনারেল কোডেনডারা সুব্বাইয়া থিমাইয়া ছিলেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একজন বীর সেনানী। এই কুর্গ জেলার মানুষ ছিলেন তিনি।
কোড়াভা রাজাদের সান্ধ্য ভ্রমণ ও বিশ্রামের জায়গা এখন ‘রাজাস সিট’। চমৎকার সূর্যাস্ত দেখা যায় এখান থেকে। ব্যাঙ্গালোর ফেরার পথে কাবেরী নদীর তীরে দুবারে এলিফ্যান্ট ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। নদীতে হাতির স্নান দেখা যায় এখানে। হাতিকে খাওয়ানো যায়। বনবিভাগের আয়োজন। পর্ণমোচী উদ্ভিদের জঙ্গলের মধ্য এই হস্তিশিবিরটির অবস্থান। জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট এই দুবারে এলিফ্যান্ট ক্যাম্প। কর্নাটক সরকার পরিচালিত জঙ্গল লজে থাকারও ব্যবস্থা আছে। অনলাইন বুকিং হয় এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে।
সারাদিন কুর্গের মধ্যে দিয়ে অনেকটা সফর হল। সন্ধ্যার পরে ব্যাঙ্গালোরে ফিরলাম।
হেডার ফটোঃ দুবারে এলিফ্যান্ট ক্যাম্প
(ফটো সৌজন্য দুবারে এলিফ্যান্ট ক্যাম্প)।
অন্য সবক’টি ফটো তুলেছেন লেখক।
ফটোঃ ওপর থেকে যথাক্রমেঃ
দুবারে এলিফ্যান্ট ক্যাম্প।
নমড্রোলিং মনাস্ট্রি।
কাবেরী নিসর্গধাম।
ওয়াক্স মিউজিয়াম।
ওঙ্কারেশ্বর মন্দির।
থালাকাবেরী মন্দির।
ত্রিবেণী সঙ্গমস্থল।
মাদিকেরি ফোর্ট।
রাজাস সিট গার্ডেন।
হেডার ফটো সৌজন্যঃ দুবারে এলিফ্যান্ট ক্যাম্প।
অন্য সবক’টি ফটো তুলেছেন লেখক।