কাশ্মীর উপত্যকার কুপওয়ারা জেলার একটি গ্রাম কেরান। বর্তমানে সামগ্রিক গ্রামটির অর্ধেক অংশ ভারতে, অপর অংশ পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের অন্তুর্ভুক্ত। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে কিষানগঙ্গা নদী। পাকিস্তানে এই নদীটি নীলম নদী নামে পরিচিত। জম্মু-কাশ্মীরের গন্ডেরবল জেলার জনপ্রিয় পর্যটন ঠিকানা সোনামার্গের কাছে কৃষনসর লেক এ নদীর উৎস। গুরেজ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কিষেনগঙ্গা পাকিস্তানে প্রবেশ করে নীলম নদী নাম নিয়েছে। ভারতের অন্তুর্গত উত্তর কাশ্মীরের কেরানে এই নদীটিই দুই দেশের মধ্যেকার সীমানা তথা লাইন অফ কন্ট্রোল।
কেরান বেশ পুরনো গ্রাম। নদী-সন্নিহিত উভয় পারেই ভালো চাষ-আবাদ হয়। পাহাড়, নদী, খেত ইত্যাদি সহকারে কেরান একটি সুন্দর গ্রাম। ভারত দ্বিখণ্ডিত হওয়ার আগে পর্যন্ত আঞ্চলিক লোকজন নদীর উভয় পারে যাতায়াত করতেন। আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব স্থাপিত হত। নদীর দুই পারের মধ্যে সেই মানবিক, সামাজিক বন্ধনের স্বাভাবিক সূত্রটা ছিন্ন হল দেশ ভাগের পরে।
সাম্প্রতিক কালে ভারত সরকার সীমান্ত পর্যটনের বিকাশে উদ্যোগী হওয়ায় কেরানে যাওয়া যাচ্ছে। সরকারি ভাবে ২০২১ সালে পর্যটকদের জন্য কেরান যাওয়ার দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালে পর্যটকদের সর্বাধিক পদচিহ্ন পড়েছে কেরানে। জম্মু-কাশ্মীরের অফবিট পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছে কেরান।
কিষানগঙ্গা পাহাড়ি নদী। বিস্তার বেশি নয়। কেরানে কিষানগঙ্গার পার থেকে ওপারের অর্থাৎ পাক অধিকৃত কাশ্মীরের বাড়িঘর, রাস্তা, গাড়ি ও লোকজনের চলাচল দেখা যায়। হাত নাড়ালে ওপার থেকে সাড়া আসে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রন রেখা বরাবর কেরান গ্রাম। মনে রাখতে হবে, ভূ-রাজনীতির দিক থেকে এমন স্পর্শকাতর এলাকায় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রয়েছে। কিন্তু তা উচ্চকিত নয়। উল্টোদিকেও মনে হয় সেরকমটাই। সীমান্তে শান্তি থাকলে যে দু’দেশেরই নানা দিক থেকে মঙ্গল তার একটি নজির কেরান সীমান্ত।
কিষানগঙ্গার তীর ধরে ২ কিলোমিটার হেঁটে এমন একটা জায়গায় পৌঁছানো যায় যেখানে নদী সংকীর্ণ। উভয় পার থেকে জোরে বলা কথা শোনা যায়। জায়গাটার নাম কোবরা পয়েন্ট। এখান থেকে নদীর ওপারে বড় বড় বাড়ি, উর্দু ও ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড লাগানো দাকানপাট দেখা যায় খুব কাছ থেকে। দুই পারেই মানুষ জড়ো হন। উভয় তীরের আঞ্চলিকদের মধ্যে নাড়ির টান থাকাটাই স্বাভাবিক। উদাত্ত কণ্ঠে কুশল-সংবাদের আদানপ্রদান হয়। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় কেরানে বেড়াতে আসা ভ্রমণার্থীদের। ও-পারটা পাক অধিকৃত কাশ্মীরের নীলম ভ্যালি।
কেরানে একটি পোস্ট অফিস রয়েছে। ভারতের প্রথম ডাকঘর এটি। ডাকঘরের অবস্থানটি দুর্দান্ত। পাহাড়, নদী ও ঝেঁপে আসা সবুজ দিয়ে ঘেরা জায়গাটা।
ভারত-পাক সীমান্তের এই জায়গাটি ভালো করে ঘুরেফিরে দেখার জন্য অন্তত একটা রাত কেরানে থাকা গেলে সে হবে স্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা।
কেরানের ‘রাজা টেন্ট ভ্যালি’ ও কোবরা পয়েন্টে টেন্টে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। রাজা টেন্ট ভ্যালির ফোন নম্বরঃ ৬০০৬৪৬৪৬৯৯, ৯১৪৯৫৩৫৮৩৪।
কেরানে যাওয়ার জন্য পারমিটের দরকার হয়। পারমিটের অনলাইন ফর্ম পাবেন এই ওয়েবসাইটে http://epass.kupwara.co.in/ এক্ষেত্রে পূরণ করা ফর্ম অনলাইনেই জমা দিতে হবে। একই ফর্মে একাধিক ভ্রমণার্থির তথ্য দেওয়া যাবে। পারমিট জেনারেট করার পরে সেটির প্রিন্ট আউট নেবেন। বেড়াতে যাওয়ার সময়ে পারমিটের ৮-১০টি কপি সঙ্গে রাখবেন। হাতে হাতে পারমিট নিতে চাইলে কেরান যাওয়ার পথে ক্রালপোরায় যাত্রাবিরতি দিয়ে আঞ্চলিক পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে। এখানকার বিভিন্ন দোকানে, বিশেষ করে জেরক্সের দোকানে আবেদনের ফর্ম পাওয়া যায়। ফর্ম পূরণ করে ক্রালপোরার পুলিশ স্টেশন থেকে সিলমোহর-সহ সই করিয়ে নিতে হবে।
শ্রীনগর থেকে কুপওয়ারা হয়ে কেরান ১২৫ কিলোমিটার। শ্রীনগর থেকে কুপওয়ারা শেয়ার গাড়ি পাওয়া যায়। দূরত্ব প্রায় ৮৫ কিলোমিটার। কুপওয়ারা থেকে কেরান ৭০ কিলোমিটার। কুপওয়ারা থেকে ক্রালপোরা ১৫ কিলোমিটার। কিছুদূর যাওয়ার পরে শুরু হবে ফরকিয়াঁ গলি। এটি একটি মাউন্টেন পাস। উচ্চতা ৯৮০০ ফুট। দৃশ্যপট বদলাবে। এ পথের বিভিন্ন চেকপোস্টে পারমিটের কপি জমা দিতে হয়। ফরকিয়াঁ গলির সর্বোচ্চ পয়েন্ট থেকে কেরান ২৫ কিলোমিটার।
কেরানের সঙ্গে ভ্রমণের সূচিতে কুপওয়ারা জেলারই লোলাব ও বাঙ্গাস উপত্যকাকে যুক্ত করে নেওয়া যেতে পারে।
ফটো সৌজন্য (উপর থেকে যথাক্রমে)
দি ক্রিশ্চিয়ান সাইন্স মনিটর
ভিলেজ স্কোয়ার
কাশ্মীর অবজার্ভার
কাশ্মীর অবজার্ভার
ট্র্যাভেল দি হিমালয়াজ
উইকিপিডিয়া
ভার্গিস খান