আজ ফুলের উপত্যকার যাব। ‘ফুলোঁ কী ঘাঁটী’ তথা ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স’এর উদ্দেশে যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যাবে আর একটু পরেই। কাল রাত্রিযাপন হয়েছে ঘাঙ্গারিয়ার হোটেলে। এখান থেকে হাঁটাপথে জাতীয় উদ্যান ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স প্রায় ৪ কিলোমিটার।
লেখকের ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-বিষয়ক প্রথম পর্বের ‘ফুলের উপত্যকায়ঃ ঘাঙ্গারিয়ার পথে’ পড়তে পারেন এই লিঙ্কে।
https://torsa.in/haridwar-to-ghangaria/
খুব সকালেই ঘুম ভেঙেছিল। সেপ্টেম্ব মাস (২০২৪)। বৃষ্টির মরসুম। বর্ষাতেই ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার এই জাতীয় উদ্যান। কাল রাত্তির থেকে এখানে আর বৃষ্টি হয়নি। তবে আকাশ মেঘলা। চামোলি জেলার ৮৭ বর্গ কিলোমিটার এলাক জুড়ে জাতীয় উদ্যানের বিস্তার। অবস্থান ১২,০০০ ফুট উচ্চতায়। স্বপ্নের মতো মনে হয়।
আমাদের গ্ৰুপের অনেকেই নিয়মিত ট্রেক করে। তারা যথারীতি বেরোচ্ছে প্রস্তুতি নিয়ে। তবে আমার মত লোকজনও আছে। যারা অল্প স্বল্প ট্রেক করেছি। আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে সান্দাকফু আর হিলে-ভার্সে ট্রেকিং। দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম হোটেল থেকে। সামনের দোকান থেকে নিলাম একটা লাঠি। এটা মাস্ট। ঘাঙ্গারিয়া থেকে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স প্রায় ৪ কিলোমিটার। পৌঁছে গেলাম তার প্রবেশদ্বারে। আমাদের গাইড আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে টিকিট কেটে দাঁড়িয়ে ছিল গেটে। আমরা গেটের সামনে গ্ৰুপ ছবি নিয়ে শুরু করলাম হাঁটা।
চলুন হাঁটতে হাঁটতে বরং একটু ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলিয়ে নিই। ১৮৬২ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কর্নেল এডমন্ট স্মিথ ফুলের উপত্যকা-লাগোয়া পুষ্পবতী নদী উপত্যকায় গিয়েছিলেন। অঞ্চলটি বাইরের বিশ্বের কাছে তখন অজানা। পৃথিবীর কাছে ফুলের উপত্যকার স্বরূপটি উন্মোচিত করলেন ফ্রাঙ্ক এস স্মিথ, বই লিখে। তিন ব্রিটিশ পর্বতারোহী ফ্রাঙ্ক এস স্মিথ, এরিক শিপটন ও আর এল হোল্ডসওয়ার্থ সফল কামেট পর্বত অভিযান সেরে ফেরার পথে পথ হারিয়ে ভ্যুন্দর উপত্যকায় এসে পড়েন। এই ফুলের উপত্যকায় এসে পড়েছিলেন তাঁরা। বিষ্ময়াবিষ্ট অভিযাত্রীরা বললেন- ফুলের উপত্যকা। ফ্রাঙ্ক এস স্মিথ পরে ‘দি ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স’ নামের বিখ্যাত বইটি লিখলেন। ভ্যুন্দর ভ্যালি পরিচিত হল ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স নামে।
কিছু দূর এগনোর পরে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এগতে থাকলাম। আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে। পথ চলতে চলতে হঠাৎই পুষ্পবতী নদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ। দুর্বার গতিতে পাথরের উপর দিয়ে আছড়ে পড়ছে নীচে। পাহাড়ের ভারী স্তব্ধতা ভেঙে গেছে এখানে। নদীর গর্জন, ফেনিল জলরাশি। অন্য চিত্র, ভিন্ন ধ্বনি, কিন্ত কী মানানসই, সুন্দর।
যত এগচ্ছি, বাড়ছে ফুলের সমাবেশ। যদিও ফুলের ঘাঁটি এখনও খানিকটা দূরে। সাবধানে চলতে হচ্ছে, পথ বড় সহজ নয়। নিয়ন্ত্রণ হারালে রক্ষে নেই। ঘাঁটিতে পৌঁছনোর দুটো উপায়। এক পায়ে হেঁটে আর না হয় পিঠে সওয়ার হয়ে। যত সময় যাচ্ছে মনে হচ্ছে আর কত দূর! মাঝে মাঝে পথে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি। তারপর আবার শুরু হচ্ছে হাঁটা। সংকীর্ণ পথের দু’পাশে নানা ধরনের ফুল ফুটে রয়েছে। বেশির ভাগই অচেনা ফুল। ফিরতি পথের এক যাত্রীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আর এক কিলোমিটার পথ । পৌঁছে গেলাম প্রতীক্ষিত ফুলের উপত্যকায়।
এর আগে দেখেছি সিকিমের ইয়ুংথাং উপত্যকা। ওখানে ছিল রডোডেনড্রনের সমাহার। এখানে বিস্তীর্ণ বুগিয়াল জুড়ে রয়েছে নানা জাতের ফুল। বাতাসের ছন্দে তাদের রূপ আরও মোহময়ী। চারপাশে ছোট বড় পাথর। মেঘের ফাঁক দিয়ে রোদ্দুরের ছটা পড়েছে ফুলের উপরে। সামনে বইছে একটা পাহাড়ি ঝর্ণা। অনেকেই দেখলাম পাথরে বসে পড়েছে খাবার নিয়ে।আমরাও একটু হালকা খাবার খেয়ে এগিয়ে চললাম সামনে। যতদূর চোখ যায় শুধু ফুল, হিমালয়ের অভ্যন্তরে নিজের মতো সেই উপত্যকা। সত্যি প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি। পথশ্রম সার্থক। এই উপত্যকার ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইটের তকমা রয়েছে। প্রায় তিনশো প্রজাতির ফুল ফোটে এখানে। তাদের নিরালা অঙ্গনে দাঁডিয়ে আশ্চর্য লাগে।
ব্রিটিশ পরিবেশবিদ মার্গারেট লেগি ১৯৩৯ সালে গবেষণার কাজে এসেছিলেন এই ফুলের উপত্যকায়। একদিন বিপজ্জনক পথে শরিরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পা পিছলে পড়ে যান গভীর খাদে। মৃত্যু হয় তাঁর। পরবর্তী সময়ে বোন তার স্মৃতিতে এখানে তৈরি করেন একটি স্মৃতি সমাধি। ইচ্ছে ছিল সমাধিস্থল অব্দি যাওয়ার। কিন্তু কিছুটা দূরে থামতে হল। প্রকৃতি বিরূপ। আবার এতটা পথ ফিরতে হবে। দূর থেকেই শ্রদ্ধা জানালাম মার্গারেটের উদ্দেশ্যে। মনে মনে তার সমাধিতে রেখে এলাম ভালোবাসার ও শ্রদ্ধার একগুচ্ছ পুষ্পস্তবক। ভালো থেকো মার্গারেট।
ফেরার পথ ধরতে হল একসময় –
কাল যাব হেমকুণ্ড সাহিব। পরের পর্বে সে কথা।
ফটো
হেডারঃ বুগিয়াল ভ্যালি
উপর থেকে দ্বিতীয় ফটোঃ লেখক
বইয়ের প্রচ্ছদের ফটোঃ হিন্দিজ
চতুর্থ ফটোঃ লেখক
সর্বনিম্ন ফটোঃ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটস