Follow us
Search
Close this search box.

শীতের রোদ্দুরে মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর, মেলা ২৩-২৭ ডিসেম্বর

শীতের রোদ্দুরে মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর, মেলা ২৩-২৭ ডিসেম্বর

বিষ্ণুপুর মেলা ২৩-২৭ ডিসেম্বর

শীতে বাঁকুড়ার মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর বেড়ানোর মজাই আলাদা। এ সময় আবহাওয়া অনুকূল। উৎসবের মরসুমও। সেই বেড়ানোর সঙ্গে বাৎসরিক বিষ্ণুপুর মেলা যুক্ত হলে সে হয় আরেক পাওনা। এবারের, ২০২৪ সালের, বিষ্ণুপুর মেলা ২৩ থেকে ২৭ ডিসেম্বর। বিষ্ণুপুরের রাসমঞ্চ সংলগ্ন ময়দান মেলার মূল কেন্দ্র।

মেলার সময়ে বিষ্ণুপুর শহর জমজমাট। ভ্রমণার্থীরা আসেন। বাঁকুড়ার গ্রামগুলি থেকে হস্তশিল্প সামগ্রীর পসরা নিয়ে আসেন কারিগররা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এবং বিদেশ থেকেও পর্যটকরা বিষ্ণুপুরে আসেন। বাঁকুড়ার টেরাকোটার শিল্প, স্থাপত্য দেখতে আসেন। টেরাকোটা বিষয়ে গবেষণার জন্য আসেন।

আলাপ-পরিচয় হয়। বিষ্ণুপুর ঘরানার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হয়। মাটির আঘ্রাণ পাওয়া যায় বিশ্বখ্যাত টেরাকোটা শিল্পে, রাঁধুনিপাগল বা কালো নুনিয়া চালে, বালুচরি শাড়িতে, দশাবতার তাসে, পটচিত্রে।

মেলা প্রাঙ্গন সরগরম থাকে হরেক ইভেন্টে। নাটক, যাত্রা, সঙ্গীত, নৃত্য, নানা প্রতিযোগিতা। খাবারদাবার। সবমিলিয়ে মেলার সময় বিষ্ণুপুর সরগরম। বাঁকুড়ার ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ। সঙ্গে ভ্রমণ। এবার ৩৭তম বছরের মেলা। তবে সারা শীতকালটাই বিষ্ণুপুর বেড়ানোর আদর্শ ঋতু।

বেড়িয়ে দেখা বিষ্ণুপুর

বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর যথার্থই এক মন্দিরনগরী। সারা বিষ্ণুপুর জুড়ে ছড়িয়ে আছে কত যে মন্দির। সামগ্রিকভাবে বিষ্ণুপুর বিশ্বের সর্ববৃহৎ পোড়ামাটি তথা টেরাকোটা শৈলীর মন্দির চত্বর। কলকাতা থেকে রেলপথে দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার। ট্রেনে বা সড়কপথে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টার মধ্যে বাঁকুড়া জেলার মহকুমা শহর বিষ্ণুপুরে পৌঁছনো যায়। সড়কপথে আসানসোল, দুর্গাপুর , বর্ধমান, পানাগড়ের সঙ্গেও সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে বিষ্ণুপুরের।

খ্রিষ্টীয় যুগের সূচনার অনেক আগেই বাঁকুড়া অঞ্চলে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল। এখানকার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সে প্রমাণ দেয়। মধ্যযুগে শক্তিশালী মল্ল রাজত্বে বৈষ্ণব ধর্ম ও সুফী দর্শনে প্লাবিত হয়েছিল মল্লভূমি। পরবর্তীকালে বৈষ্ণব ধর্ম, সুফি আদর্শ, জৈন ও বৌদ্ধ দর্শন , হিন্দু ধর্ম এবং কৌম ধর্মাচরণের মিলমিশের মধ্যে দিয়ে দারুণ সৃষ্টিশীল এক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে বাঁকুড়ার বাঁকুড়া জুড়ে।

বিষ্ণুপুরী ঘরানার সংগীত, বালুচরী ও স্বর্ণচরী শাড়ি, দশাবতার তাস, পাঁচমুড়াতে টেরাকোটার হস্তশিল্প সামগ্রী, বিকনা ও খাতরার ডোকরা শিল্প, কেঞ্জাকুড়া ও ছান্দারের কাঠ খোদাই ও মিশ্র ধাতু শিল্প, কেঞ্জাকুড়া ও সোনামুখীর সুতির পোশাক, ছাতনার গালার পুতুল, বেলিয়াতোড়ের পটচিত্র, এ সবই মল্লভূমির সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের ফসল। বাঁকুড়া জেলার সমস্ত হস্তশিল্প সামগ্রীরই যোগান পাবেন বিষ্ণুপুরে।

 

 

 

 

মন্দির ভ্রমণ

জোড়বাংলা  মন্দির

মন্দিরটি যেন পরস্পর-সংলগ্ন দুটি কুটির। চূড়া একটিই। লালমাটির ইট দিয়ে তৈরি মন্দিরের গায়ে রয়েছে চমৎকার অলংকরণ। বাংলার মন্দির নির্মাণশৈলীর এক বিশিষ্ট উদাহরণ। মল্ল রাজা রঘুরাম সিং ১৬৫৫ সালে মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন।

 

রাসমঞ্চ

বিষ্ণুপুরে ইটের তৈরি সবচেয়ে পুরনো স্থাপত্য এই রাসমঞ্চ। ১৬০০ সালে তৈরি করেছিলেন রাজা বীর হাম্বির। পোড়ামাটির ব্লক দিয়ে তৈরি বিরাট এক মঞ্চের ওপর তৈরি হয়েছে এই মন্দিরটি। পিরামিড আকৃতির উচ্চাংশের নীচে চারদিক ঘিরে রয়েছে কুটির আকৃতির নির্মাণ। রাস উৎসবের সময় অন্যান্য মন্দির থেকে বিষ্ণুর মূর্তি এনে রাখা হতো রাসমঞ্চে।

রাধাশ্যাম মন্দির

চারদিকে উঁচু পাঁচিলে ঘেরা বিরাট এক চত্বরে মন্দিরটির অবস্থান। মল্ল রাজা চৈতন্য সিংহ গঠনশৈলীতে খানিকটা স্বাতন্ত্র এনে এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন ১৭৫৮ সালে। চারকোনা আকৃতির একরত্ন মন্দিরের ওপরে রয়েছে একটি গম্বুজ। মন্দিরটির বাইরের দেওয়ালে রয়েছে চমৎকার সব রিলিফের কাজ। পৌরাণিক ও মহাকাব্যিক নানা দৃশ্য এবং জ্যামিতিক নানা প্যাটার্ন ব্যবহৃত হয়েছে মন্দিরের অলংকারের কাজে।

 

শ্যামরাই মন্দির

পঞ্চরত্ন বা পঞ্চ-চূড়া মন্দির এটি। বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলির মধ্যে একটি বিশেষ আকর্ষণ এই শ্যামরাই মন্দির । মন্দিরের ভিতরে ও বাইরে দুর্দান্ত সব টেরাকোটার কাজ রয়েছে। কৃষ্ণলীলা, রাধাকৃষ্ণের প্রেম এবং রামায়ণ ও পৌরাণিক নানা কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে টেরাকোটার প্লেটের মাধ্যমে। রাজা রঘুনাথ সিংহ ১৬৪৩ সালে মন্দিরটি তৈরি করিয়েছিলেন।

মদনমোহন মন্দির

মল্ল রাজা দুর্জন সিংহ দেব ১৬৯৪ সালে এই মন্দিরটি তৈরি করিয়েছিলেন। এক চূড়ার এই মন্দিরের গায়ের সূক্ষ্ম টেরাকোটার অলংকরণ খুঁটিয়ে দেখবার মতন।

 

মৃন্ময়ী মন্দির

বিষ্ণুপুরের প্রাচীনতম মন্দির এটি। রাজা জগৎ মল্ল ৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই মন্দিরটি। দেবী দুর্গা এই মন্দিরে দেবী মৃন্ময়ীরূপে পূজিত হন। মন্দিরটির সংস্কার হয়েছে, তবে প্রাচীন দেবী মূর্তিটি একই আছে। বাংলার প্রাচীনতম দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় এখানেই। নয় নয় করে এখানকার দুর্গাপূজার বয়স হলো ১০২৩ বছর।

ষাঁড়েশ্বর ও শৈলেশ্বর মন্দির

বিষ্ণুপুর শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে দিহর এলাকায় এই দুই মন্দিরের অবস্থান। ল্যাটেরাইট পাথরে তৈরি মন্দির দুটি ওড়িয়া দেউল নির্মাণশৈলীতে গড়া। শিবরাত্রি ও গাজন উৎসবে মন্দির চত্বরে প্রচুর জনসমাগম হয়।

গড় দরজা

মুর্চা পাহাড়ের কাছেই গড় দরজা। বিষ্ণুপুরের রাজাদের শাসনকার্য পরিচালিত হতো যে জায়গা থেকে সেখানে ঢুকতে হলে এই বিশালাকার গড় দরজা পেরতে হতো। বিরাট এলাকা জুড়ে এই গড় দরজা। রাজার সেনারা এখন থেকে শত্রু-হানা প্রতিরোধ করতো।

সংগ্রহশালা

পুরাতত্ব, শিল্পকলা ও ইতিহাসে আগ্রহীদের আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকীর্তি ভবনে আসতেই হবে। দশ থেকে দ্বাদশ শতকের ভাস্কর্য, প্রায় ৫০০০ পাণ্ডুলিপি, টেক্সটাইল-সহ বিভিন্ন ধরণের পুরনো হস্তশিল্প সামগ্রী খুঁটিয়ে দেখার যায় এই সংগ্রহশালায়।

দলমাদল কামান

মল্ল রাজত্বে ধাতুশিল্পেরও যে প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল তার প্রমাণ দেয় দলমাদল বা দলমর্দন কামানটি। ৩০০ বছর আগে তৈরি ৩.৮ মিটার লম্বা কামানটিতে এখনো জং ধরেনি। ১৭৪২ সালে ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে বাংলায় মারাঠা তথা বর্গী আক্রমণের সময় কামানটি ব্যবহার করা হয়েছিল। লোকশ্রুতি, স্বয়ং দেবতা মদনমোহন দলমাদল কামানটি দেগে বর্গীদের হাত থেকে বিষ্ণুপুরকে রক্ষা করেছিলেন।

লালবাঁধ

দিগন্ত ছোঁয়া লালবাঁধ একটি কৃত্রিম জলাশয়, তৈরি করেছিলেন মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ সিং। আপাতভাবে এটি একটি বিরাটাকার জলাশয়। কিন্তু ইতিহাস আর লোকশ্রুতি মিলেমিশে আজও রহস্যময়তার বাতাবরণ ছেয়ে আছে লালবাঁধ জলাশয়টিকে। লোক পরম্পরায় কথিত আছে, রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ একদা লালবাঈয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। পরে ওই বৃহৎ জলাশয়টি খনন করান এবং নাম দেন লালবাঁধ। লালবাঈয়ের সঙ্গে রাজার প্রেমে প্রজামহলে শোরগোল ওঠে। পরে রাজার মৃত্যু, রাজ্যের বিপত্তির জন্য প্রজারা লালবাঈকে দায়ী করে লালবাঁধের জলেই বজরা সমেত তাঁকে ডুবিয়ে মারে। কোনও কোনও চাঁদনী রাতে নাকি লালবাঈয়ের বজরার ছায়া দেখা যায় লালবাঁধের জলাশয়ে (জনশ্রুতি)।

পোড়ামাটির হাট

বিষ্ণুপুর পর্যটন মানচিত্রে পোড়ামাটির হাট অপেক্ষাকৃত এক নতুন সংযোজন। জোড়বাংলা মন্দিরের সামনের প্রাঙ্গনে প্রতি শনিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই হাট বসে। বাঁকুড়ার বিভিন্ন প্রান্তের হস্তশিল্পীরা তাঁদের পসরা নিয়ে আসেন এই হাটে। বাউল ও টুসু গানে, ধামসা – মাদলের বোলের তালে, আদিবাসী নৃত্যে মেতে ওঠে হাট চত্বর। এখান থেকেই সংগ্রহ করতে পারবেন বাঁকুড়ার নানা হস্তশিল্পসামগ্রী।
বিষ্ণুপুর মন্দিরের শহর। এই শহর ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে রয়েছে মধ্যযুগীয় আরো মন্দির। একটু সময় নিয়ে বেড়িয়ে দেখতে পারলে টেরাকোটা শিল্পের এই পীঠস্থানটিকে আরো ভালো করে জানা-বোঝা যাবে।

ঘুরে দেখার ব্যবস্থা

বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন মন্দির ও অন্যান্য দ্রষ্টব্য ঘুরে দেখার জন্য রিক্সা বেশ ভালো একটি যান। রাশমঞ্চের কাছাকাছি হোটেলে থাকলে, পায়ে হেঁটেও মূল দ্রষ্টব্যের অনেকগুলি দেখে নেওয়া যায়। ঘুরে দেখবার জন্য প্রাইভেট গাড়িও ভাড়া করা যেতে পারে। বাঁকুড়ার বিখ্যাত টেরাকোটার ঘোড়া তৈরির গ্রাম পাঁচমুড়া । দূরত্ব ২২ কিলোমিটার, হাতে সময় থাকলে বেড়িয়ে আসতে পারেন। বিষ্ণুপুর ভ্রমণের সঙ্গে যুক্ত করে নেওয়া যেতে পারে মা সরদার জন্মস্থান জয়রামবাটী (৪৩ কিলোমিটার) ও শ্রী রামকৃষ্ণদেবের জন্মস্থান কামারপুকুর (জয়রামবাটী থেকে সাড়ে ৭ কিলোমিটার), মুকুটমণিপুর (৮৩ কিলোমিটার), শুশুনিয়া পাহাড় (১৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে প্রায় ৬৭ কিলোমিটার), ঝিলিমিলি (৯৬ কিলোমিটার) ও বিহারীনাথকে (৯৩ কিলোমিটার)।

 

যাওয়ার পথ

শালিমার ষ্টেশন থেকে আরণ্যক এক্সপ্রেস, সাঁতরাগাছি স্টেশন থেকে রূপসীবাংলা এক্সপ্রেস, হাওড়া থেকে শিরোমনি ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার, হাওড়া-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার, বিষ্ণুপুর জংশন যায়। বর্ধমান, দুর্গাপুর, মেদিনীপুর বা খড়্গপুর পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে সেখান থেকে বাসেও বিষ্ণুপুর যাওয়া যায়।
কলকাতার ধর্মতলা চত্বর থেকে সিএসটিসি অথবা এসবিএসটিসি-র বাস বিষ্ণুপুর যায়।

রেলপথের চেয়ে সড়কপথের দূরত্ব কম। কলকাতা থেকে বাসে বিষ্ণুপুর পৌঁছতে সময় লাগবে সোয়া ৪ ঘন্টা।
নিজেদের গাড়ি নিয়ে গেলে, কলকাতা,ডানকুনি,দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে শ্যাওড়াফুলি – তারকেশ্বর রোড ধরে আরামবাগ হয়ে বিষ্ণুপুর পৌঁছতে পারেন।

থাকার ব্যবস্থা

বিষ্ণুপুরে থাকার জন্য রয়েছে অনেক হোটেল, লজ। কিছু হোটেল, লজের তালিকা পাবেন নীচের লিঙ্কে।

https://torsa.in/accommodations/

উপর থেকে প্রথম দুটি ফটো সৌজন্যঃবিষ্ণুপুর মেলা ও উৎসব কমিটি।

ইমেল (বিষ্ণুপুর মেলা)-bspmela@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *