Follow us
Search
Close this search box.

বর্ষাস্নাত কোরাপুটে

বর্ষাস্নাত কোরাপুটে

সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ (২০২৪)। শালিমার স্টেশন থেকে সকাল ৯-১৫’র ধৌলী এক্সপ্রেসে চড়ে ভুবনেশ্বরে পৌঁছালাম বিকেল সাড়ে চারটেয়। সাড়ে ৩ ঘন্টার যাত্রাবরতি। সন্ধ্যা ৭-৩৫’এ এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ১৮৪৪২-হীরাকুণ্ড এক্সপ্রেস ভুবনেশ্বর থেকে যাত্রা করল।

সকাল ন’টায় দক্ষিণ ওড়িশার কোরাপুটে। বুকের ভিতরটা ঝিলিক দিয়ে উঠল। পাহাড়, জলপ্রপাত, নদী অরণ্যের দেশ। বৃষ্টিধৌত কোরাপুট খুব সবুজ এখন। আদিবাসীদের আপন ভূমি। প্রাচীন সংস্কৃতি। কোরাপুট একের মধ্যে বহু। কোরাপুট স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দুরের হোটেল রাজ রিজেন্সি থেকে পাঠানো গাড়ির চালকের আহ্বানে হোটেল অভিমুখে যাত্রা করা গেল।

দক্ষিণ ওড়িশার ‘ট্রাইবাল বেল্ট’ নামে চিহ্নিত অঞ্চলের একাংশ কোরাপুট ওড়িশার একটি জেলা। জেলার প্রধান শহরের নামও কোরাপুট। প্রাচীন কোরাপুটে নল রাজাদের শাসন ছিল। তেরশ শতকের বেশ খানিকটা সময়ে কাশ্মীর থেকে আসা সূর্যবংশীয় রাজাদের শাসন চলেছে কোরাপুটে। সতেরশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে ব্রিটিশদের নজরে এসেছিল কোরাপুট। উন্নয়নের কাজকর্ম শুরু করেছিল ইংরেজরা। ১৭শ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশরা কোরাপুটকে স্বাস্থ্যকর জায়গার স্বীকৃতি দিয়েছিল।

হোটেলে চেক-ইনের পরে স্নানাদি ও সকালের জলযোগ সেরে দেওমালি ভিউ পয়েন্টের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। দেওমালি ওড়িশার সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ (৫৭৮০ ফুট)। কোরাপুট শহর থেকে দেওমালি ৬০ কিলোমিটার। পূর্বঘাট পর্বতমালার অংশ দেওমালি। অবস্থান কোরাপুট জেলার পত্তাঙ্গি ব্লকে। যাওয়ার রাস্তাটি চমৎকার। শেষ ১০ কিলোমিটার তো আসাধারণ। একেবারে প্রকৃতির অভ্যন্তরে পৌঁছে যাওয়ার পথ।

ভিউ পয়েন্টে যখন পৌঁছালাম, তখন ঝোড়ো হাওয়া বইছে। তাপমাত্রা ১৬-১৭ ডিগ্রি। হাওয়ার জন্য আরও ঠান্ডা লাগছিল। সবুজের রাজ্যপাট দেখে শহুরে চোখ আরাম পায়। পাহাড়েই গা বেয়ে বেয়ে উড়ে যাচ্ছে মেঘের দল। এমন জায়গায় ওড়ে মানুষের মনটিও।

এবার যাব জলপ্রপাত দেখতে। রানি দুদুমা জলপ্রপাত। দেওমালি ভিউ পয়েন্ট থেকে রানি দুদুমা জলপ্রপাতের দূরত্ব ৪৮ কিলোমিটার। সুন্দর সেই পথে পাশের এক শান্ত রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ হল। প্রপাত-সংলগ্ন এলাকার একটা জায়গা গাড়ি থামল। সেখান থেকে হাঁটাপথ। ৬০০ মিটার মতো। বাঁধানো রাস্তা ধরে। কোথাও কোথাও সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়া। তিন-ধারার দুদুমার বর্ষায় রানির মতোই মেজাজ। তবে এই জলপ্রপাতটি প্রায় সারা বছরই বেগবতী থাকে বলে জানা গেল।

কোরাপুট ফিরে সন্ধ্যায় গেলাম জগন্নাথ মন্দিরে। কোরাপুট শহরের বিশেষ আকর্ষণ এই মন্দির চত্বরটি। নীলাশৈল নামের একটি টিলার ওপর মন্দির চত্বর। শ’খানেক সিঁড়ি বেয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছাতে হয়। এখানেও সাড়ম্বরে রথযাত্রা আয়োজিত হয়ে থাকে। মন্দির স্থাপিত হয়েছে ঊনবিংশ শতকে। পরে আরও নানা দেবদেবীর মূর্তি স্থাপিত হয়েছে মন্দিরের চৌহুদ্দির মধ্যে। জায়গাটি মনোরম। কোরাপুটের জগন্নাথ মন্দির ‘সবারা শ্রীক্ষেত্র’ নামে পরিচিত। সবারা নামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে দক্ষিণ ওড়িশা ও সমুদ্র তীরবর্তী উত্তর অন্ধ্রপ্রদেশে। সবারা শ্রীক্ষেত্রর সঙ্গে ওতপ্রতো যুক্ত রয়েছে আদিবাসী আচার ও সংস্কৃতি। জাতি, বর্ণের কোনও ভেদাভেদ নেই এখানে। সন্ধ্যারতি দেখলাম জগন্নাথ মন্দিরে। মূল জগন্নাথ মন্দিরের পাশেই একটি আদিবাসী সংস্কৃতি-বিষয়ক সংগ্রহশালা রয়েছে। সন্ধ্যা ৬টায় বন্ধ হয়ে যায়। পরে সংগ্রহশালাট দেখার সংকল্প নিয়ে এদিন হোটেলে ফিরলাম।

আজ ১৭ সেপ্টেম্বর। ব্রেকফাস্ট সেরে বেড়িয়ে পড়লাম। স্বর্গদ্বার গুহা দেখতে যাব। কোরাপুট থেকে দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। রাস্তা ভালো। গুহার প্রায় ২ কিলোমিটার আগে গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হল। গুহার মুখ পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। বাঁধানো রাস্তা, হাঁটতে অসুবিধা হয় না। গুহার ভিতরটা অন্ধকার, পিচ্ছিল পথ। ভিতরে ঢোকার ঝুঁকি নেওয়া গেল না। গুহার মুখ পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সেখানে দেবদেবীর কিছু ছবি রয়েছে। এক পুরোহিতও উপবিষ্ট রয়েছেন দেখলাম।

স্বর্গদ্বার কেভের কাছেই গুপ্তেশ্বর শিবের মন্দির। ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গনা, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ভক্তরা আসেন এই মন্দিরে। মন্দির দেখে এসে পড়লাম স্রোতবতী গুপ্তগঙ্গা নদীর তীরে। আঞ্চলিকরা বলেন সাবেরি ঘাট।

ফিরতি পথে লাঞ্চ সারার পরে দুদুমা জলপ্রপাত, কোলাব ড্যাম, কফির বাগিচা দেখে কোরাপুট ফিরে চলে এলাম জগন্নাথ মন্দির-সংলগ্ন মিউজিয়ামে। আঞ্চলিক বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী নানা সামগ্রী সংরক্ষিত রয়েছে এখানে। বিবৃত হয়েছে তাঁদের ইতিহাস,সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক। সুন্দর একটি লাইব্রেরি রয়েছে মিউজিয়ামে। আদিবাসি-বিষয়ক মূল্যবান সব বই, দলিলপত্র রয়েছে সেখানে। ছোট কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই গ্রন্থাগারটি। ভালো লাগলো মন্দিরের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা।

আগামীকাল ওড়িশার সীমানা পেরিয়ে ছত্তিশগড় রাজ্যে ঢুকে পড়ব। জগদলপুর যাব। বর্ষার চিত্রকোট জলপ্রপাত হাতছানি দিচ্ছে। সে বেড়ানোর কথা জানাব পরের লেখায়।

ফটো (উপর থেকে যথাক্রমে)-
১। কোলাব নদী, ২। ট্রাইবাল মিউজিয়ামের প্রবেশদ্বার, ৩। দেওমালি ভিউ পয়েন্ট, ৪। রানি দুদুমা জলপ্রপাতের সামনে লেখক, ৫। কোরাপুটের জগন্নাথ মন্দির, ৬। দুদুমা জলপ্রপাতের ধারা।

ফটো তুলেছেন লেখক ও পাপিয়া ঘোষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *