লাভা থেকে যাত্রা করে আলগাড়া হয়ে রেশি রোডে পড়লাম। লাভা ব্লকের আলগাড়া কালিম্পংয়ের আরেকটি পর্যটন এলাকা হয়ে ওঠার পথে গুটি গুটি এগোচ্ছে তখন। সে বছর দুয়েক আগেকার কথা। এখন অনেকেই আলগাড়ায় থেকে কালিম্পং বেড়াচ্ছেন। কালিম্পং শহর থেকে কাছাকাছি হওয়ায় একটা শহুরে ভাব আছে আলগাড়ার। ছোট একটা বাজার আছে এখানে। কালিম্পং বেড়ানোর জন্য সুবিধাজনক পয়েন্টও বটে। আলগাড়া থেকে বাঁয়ে ডেলো পার্ক হয়ে কালিম্পং শহর ১৫ কিলোমিটার।
আমাদের যাত্রা উল্টোদিকে, পেডং অভিমুখে। অক্টোবর মাস। লাভায় খুব ঠান্ডা ছিল রাতে। নেওড়া ভ্যালির অরণ্যের সান্নিধ্যের কারণে লাভায় ঠান্ডা একটু বেশিই থাকে। এখন হালকা ঠান্ডাকে চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে সকালের কাঁচা-সোনা রোদ্দুরের পথ ধরে রামধুরা ছাড়িয়ে চলেছি। পথের ধারে ধারে অনেক ফুল ফুটে রয়েছে। রামধুরার রংবেরঙের হোমস্টে, রঙিন ছাতা দেখতে বেশ লাগে। কালিম্পং পাহাড়ের আরেকটি পর্যটন মহল্লা হিসেবে রামধুরা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় এখান থেকে।
ঠিক কোথায় যাচ্ছি সঠিক জানি না। কোনও এক গ্রামে যাচ্ছি এটুকু জানা আছে মাত্র। ড্রাইভারও সে জায়গা চেনে না।
ইচ্ছেগাঁও পাহাড়ের পথ ধরে নেমে এল তেনজি। পরিচিত নেপালি তরুণ তেনজি শেরপা। তেনজির হোমস্টে রয়েছে ইচ্ছেগাঁও পাহাড়ের টঙে। কালিম্পং, দার্জিলিং, সিকিমে প্যাকেজ টুর করায়। বিনয়ী কিন্তু সপ্রতিভ ছেলে। তেনজিই আমাদের কোনও এক অজানা গ্রামে থাকার ব্যবস্থা করেছে।
এক শেষ-বিকেলে রিশপ থেকে অনেক নীচে পাহাড়ের খাদের মধ্যে কিছু বাড়িঘর, বসতির ভারী কুয়াশা ও মেঘের মধ্যে তলিয়ে যেতে দেখেছিলাম। প্রবল একটা কৌতূহল ভর করেছিল আমার মধ্যে। সে রাতে ফোন করে তেনজিকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলাম। কারা থাকে ওখানে? কী ভাবে থাকে? ওখানকার মানুষগুলোর জীবীকা কী? কী ভাবে যাতায়াত করে? প্রশ্নের তোড়ের মুখে অবিচলিত তেনজি ওরকম একটা জায়গায় থাকতে চাই কিনা জানতে চেয়েছিল। না ভেবেচিন্তে ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছিলাম।’হো জায়গা’, জানিয়েছিল তেনজি।
ইচ্ছেগাঁও পাহাড়ে ওঠার রাস্তা পেরিয়ে খানিক এগিয়ে রেশি রোড থেকে ইউ-টার্ন নিয়ে বাঁ-দিকের একটা উৎরাই পথ ধরল তেনজির বাইক এবং তাঁর পিছন পিছন আমাদের গাড়ি। পাকদণ্ডী পথ বেয়ে গাড়ি নামতে থাকল ক্রমাগত। রাস্তার ধারে ধারে হরেক বুনো ফুল। জঙ্গুলে পরিবেশ। মোরগের ডাক মানুষের বসতির কথা জানান দিচ্ছে। মাঝে মাঝেই গাছগাছালির মধ্যে থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখছি। পরে জেনেছি, ওই ধোঁয়া গরম জলের উনুনের উদ্গীরণ। পাথর, কাঠের তৈরি একটা ছাউনির মধ্যে শীতের দিনে জল গরম করা হয় এই অঞ্চলে। গৃহস্থালীর নানা কাজে লাগে সেই উষ্ণ জল। জঙ্গলের কাঠ জ্বালানি।
তীক্ষ্ণ উৎরাই পথ। গাড়ির চালক ছেলেটি গজগজ করতে থাকে। ইঞ্জিন বন্ধ, বেশির ভাগ রাস্তায় গাড়ি এমনিই গড়িয়ে চলল। প্রচুর ফুল রাস্তার দু’পাশে। চলতে চলতে অকস্মাৎ ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি থামল একটা উঠোন মতো জায়গায়। আর রাস্তা নেই। বাঁয়ে সদ্য রং করা দোতলা একটা বাড়ি। সামনে তো জঙ্গল বলে মনে হচ্ছে। ছোট একটা গ্রিন হাউসে নানাবিধ ক্যাকটাস প্রতিপালিত হচ্ছে দেখা গেল।
মাথায় নেপালি টুপি সেট করতে করতে দুটি সারমেয়-সহ এক প্রৌঢ় দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন। তেনজি পরিচয় করিয়ে দিল, সন্তোষ থুলং, থুলুং হোমস্টের মালিক। পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন এক প্রৌঢ়া মহিলা। কাঁধ থেকে আড়াআড়ি ঝুলছে ছোট্ট সুদৃশ্য একটি মোবাইল ফোনের ব্যাগ। বোঝা গেল, ইনি গৃহকত্রী। একটি সাইনবোর্ড নজরে এল, সেখানে লেখা ‘থুলুং হোমস্টে’। জানা গেল, পাহাড় ঢালের এ গ্রামের নাম শিরিশে গাঁও।
মালপত্র নিয়ে গেলেন সন্তোষ থুলংয়ের পরিবারের সদস্যরা। বাড়ির দোতলায় তিনটি ঘর। সন্তোষজি জানালেন, আমরা তিনটি ঘরই ব্যবহার করতে পারি। চমকিত হলাম। এমন অফার তেমন পাওয়া যায় না। এখন আর কোনও অতিথি নেই অবশ্য হোমস্টেতে। সুন্দর করে সাজানো ঘরগুলো। সঙ্গে চমৎকার একটি ব্যালকনি। তেনজি জানালো, ব্যালকনি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবে। এখন সে কুয়াশার আড়ালে। ইতিমধ্যে সন্তোষ থুলংয়ের পুত্রবধু কুকিজ-সহ চা দিয়ে গেলেন। চা খেয়ে তেনজি বিদায় নিল। সে ফিরে যাবে ইচ্ছেগাঁওয়ে।
চা-পর্ব সেরে নীচে নেমে এলাম। নীচের একটা ঘরকে ড্রয়িং রুমের রূপ দেওয়া হয়েছে। অতিথিরা সেখানে আড্ডা দিতে পারেন। সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের থাকার জন্য কয়েকটি ঘর। একদিকে রান্নার ঘর। থুলুং দাজুর ছোট ছেলে ও তাঁর স্ত্রী রান্নার কাজে ব্যস্ত। পরিচয় হল।
বাড়ির তল থেকে ধাপ চারেক নীচে একটা বাগান মতো। নেমে এলাম বাগানে। বড় বড় সাইজের কুমড়ো ফলে রয়েছে। স্কোয়াশ, বড় আকারের শশা, পাহাড়ি লঙ্কা ফলেছে।
আরেকটু হেঁটে গেলে একখন্ড প্রায় সমতল জমি। তার এক কিনারে ছবির মতো একটা ছোট্ট বাড়ি। তারপর আবার পাহাড়ের ঢাল। বোঝা গেল, সন্তোষ থুলুংয়ের বাড়ি ও হোমস্টের অবস্থান পাহাড়ের ঢালে। এক-একটা ঢালে এরকম দু’একটা করে বাড়ি। এই পাহাড় ঢালের প্রায় সব বাড়ির সঙ্গে বড় এলাচের একটা করে বাগান রয়েছে। এ অঞ্চলের মূল্যবান অর্থকরী ফসল বড় এলাচ। গাড়ি থেকে নামার সময়ে থুলুংদের বাড়ির উল্টোদিকে বড় এলাচের বাগান দেখেছি। ওটা থুলুং পরিবারেরই বাগান। ফেরার পথ ধরলাম। একটা পায়ে চলা পথ ঢুকেছে জঙ্গলে। ঘড়িতে বেলা দেড়টা তখন। জঙ্গল থেকে প্রবল ঝিঁঝিঁর কলতান ভেসে আসছে।
মধ্যাহ্নভোজনের ডাক পড়ল। খাওয়ার টেবিলে বসে চমৎকৃত হলাম। বাড়িতে তৈরি ঘি, পোস্ত-ছড়ানো উচ্ছে ভাজা, ডাল, স্কোয়াশের একটা পদ, ডিম, দু’ রকমের আচার। বাড়ির বাগান থেকে শশা ও কাঁচালঙ্কা এল। সন্তোষ থুলুংয়ের স্ত্রী খাওয়াদাওয়ার তদারকি করলেন। পাহাড়ের হোমস্টেগুলিতে সাধারণত দুপুরের পাতে ডিম ও রাতে চিকেনের পদ থাকে। আমিষের পদ এখানেও সেরকম। নিরামিষ পদগুলিতে এই নেপালি পরিবারের রন্ধন শৈলীর উদ্ভাবনার পরিচয় পাওয়া যেতে থাকল দুই বেলা। পরের দিন দুপুরে দুর্দান্ত রাই শাক খেয়েছিলাম। থুলুং পরিবারের দুটো গরু আছে। খাওয়ার পাতে যথেচ্ছ ঘিয়ের সরবরাহ বজায় থাকে সকাল থেকে রাতের খাওয়ায়।
একে একে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় হল। সন্তোষ থুলুংয়ের দুই পুত্র। ছোট পুত্র ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছে। ওঁরা অতিথিদের জন্য রান্নার কাজটা করে থাকেন। এই যুগলকে রন্ধন শিল্পী বললে অত্যুক্তি হয় না। সন্তোষ থুলুংয়ের এই ছোট পুত্রের দুই ছেলে। তাদের মধ্যে বড়টি বিবাহিত। সদ্য পিতা হয়েছে সে। সন্তোষ থুলুংয়ের সদ্যজাত সেই প্রপৌত্রকে কোলে নিয়ে এগিয়ে এলেন এক যুবতী। গর্বিত মা। কালিম্পংয়ের আরেক পাহাড়ে তাঁর বাপের বাড়ি। সন্তোষ থুলুংয়ের ছোট নাতি তখন কালিম্পং শহরে থেকে উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনা করছে। ছুটিতে বাড়ি এসেছে।
সন্তোষ থুলুংয়ের এই দুই পৌত্র ও তাদের বাপ তথা সন্তোষ থুলুংয়ের ছোট পুত্র, যাকে বলে ফুটবল পাগল। ভালো খেলোয়াড় হিসেবে তাঁদের বেশ সুনাম ও পরিচিতি রয়েছে এলাকায়। ইচ্ছেগাঁওয়ে ওঠার পথে তাঁদের খেলার মাঠ দেখেছি পরে। একতলার একটা ঘরে তাঁদের অর্জিত অনেক কাপ, শিল্ড রক্ষিত রয়েছে। সন্তোষ থুলুংয়ের অবিবাহিত বড় পুত্র পারিবারিক কাজে আপাতত বাড়ির বাইরে।
জানা গেল, থুলুংরা আগে থাকতেন অন্য পাহাড়ে। সেখানে ধসে তাঁদের বাড়িটি গুঁড়িয়ে যায়। অতঃপর বার্মেক এলাকার এই শিরিশে গাঁওয়ে তাঁদের ঠাই হয়। সন্তোষ থুলুং কালিম্পংয়ের সরকারি সিঙ্কোনা প্লানন্টেশন বিভাগে চাকরি করতেন। অবসর নেওয়ার পরে এই শিরিশে গাঁওয়ের বসত বাড়িটিকে হোমস্টের রূপ দিয়েছেন।
এখন থুলুং পরিবারের কেউ চাকরি করে না। বলা ভালো, চাকরিবাকরির ধার ধারে না সন্তোষ থুলুংয়ের পরবর্তী প্রজন্মের কেউ। বড় এলাচের চাষ থেকে পারিবারিক আয়ের একটা বড় অংশ আসে। শিলিগুড়ি থেকে ক্রেতারা এসে এখানকার বাড়ি বাড়ি থেকে বড় এলাচ সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। ঘি বিক্রি হয় কালিম্পংয়ের বাজারে। শাক-সব্জির অনকটাই পাওয়া যায় বাড়ির বাগান থেকে। ক্যাকটাস বিক্রি হয়। মুরগি পালন হয় বাড়িতে। মৌমাছি পালনের বাক্স রাখা আছে ইতিউতি। মধু বিক্রি হয়। আর আছে এই হোমস্টের আয়। প্রায় স্বনির্ভর একটি পরিবার। এরকম পরিবার আরও আছে এখানে।
পরের দিন সকালে উঠে জঙ্গলে গিয়েছিলাম। উঁচু উচুঁ গাছ থেকে যেন কুয়াশার নিশান উড়ছে। নীচে আলো-ছায়ার জাফরি। লতাগুল্ম। বুনো ফুল। পাখির ডাক। এক নাগাড়ে সেই ঝিঁঝিঁ-র কলতান। জঙ্গলের ভিতরে একটা গা-ছমছমে পরিবেশ। গুটি গুটি বেরিয়ে এলাম জঙ্গল থেকে।
ঘি-মাখানো গরম হাতরুটি আর সবজি দিয়ে তোফা ব্রেকফাস্ট সারা হল। সন্তোষজি একটা গাড়ি ডেকে দিলেন। সেই গাড়িতে চড়ে চললাম ‘ইচে গাঁও’ মানে উঁচু গ্রাম তথা ইচ্ছেগাঁওয়ে । এবার চড়াই পথ ধরে রেশি রোডে উঠে আসার পালা। শিরিশে গাঁওয়ের রাস্তায় সকালে আর বিকেলে একটি জিপ যাতায়াত করে। ওই থুলুং হোমস্টে পর্যন্তই জিপটা আসে দু’বেলায়। আঞ্চলিক পরিবহণের ব্যবস্থা। অন্য দিকে জিপটি যায় কালিম্পংয়ের বাজার পর্যন্ত।
ইচ্ছেগাঁওয়ের পাহাড় বেয়ে গাড়ি উঠছে। পথের পাশে পাশে সিঙ্কোনা গাছের জঙ্গল। পথে বেশ কিছু চিপসের প্যাকেট চোখে পড়ল। কিছু পর্যটকের গাড়ি থেকে প্ল্যাস্টিকের জলের বোতল, খাবারের প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলার অভ্যাস কার্যত অসুখে পরিণত হয়েছে। এই অভ্যাস পরিত্যাগ না করলে সমূহ ক্ষতি। এ ক্ষতি শুধু আঞ্চলিক অধিবাসীদের নয়, পর্যটকদেরও। প্ল্যাস্টিক পাহাড়ে ধসের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।
ইচ্ছেগাঁও পাহাড়ের মাথায় অনেক হোমস্টে, ছোট ছোট রেস্তোরাঁ, স্যুভেনির শপ। পাহাড় শীর্ষের এই বসতিতে যেন একটা উৎসবের পরিবেশ। ভ্রমণার্থীরা আসছেন, ফিরছেন। হোমস্টেগুলি ব্যস্ত। তেনজি তাঁর হোমস্টের বারান্দায় বসিয়ে খুব ভালো চা খাওয়ালো। পরিষ্কার আবহাওয়ায় ইচ্ছেগাঁও থেকে চমৎকার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। ইচ্ছেগাঁও থেকে ট্রেক করে কালিম্পংয়ের আরেক জনপ্রিয় পর্যটন ঠিকানা সিলারিগাঁও যাওয়া যায়। গড়ে ৪০ মিনিটের মতো সময় লাগে। উল্টোটাও করা যেতে পারে। সিলারিগাঁও থেকে ট্রেক করে ইচ্ছেগাঁও আসা।
তেনজি ও ইচ্ছেগাঁওয়ের আরও কয়েকজন হোমস্টে মালিকের সঙ্গে খানিক আড্ডা দিয়ে শিরিশে গাঁওয়ে ফিরলাম। একটা বাঁকে গাড়ি ছেড়ে দিলাম। উৎরাই পথে বাকিটুকু হেঁটে ফিরব। প্রায় জনহীন রাস্তা। রোদ্দুরে ঝলমল করছে চারিদিক। রাস্তার ধারে ধারে ফুলের মেলা। শব্দ বলতে সেই ঝিঁঝিঁ-র নিটোল কলতান। কাঞ্চনজঙ্ঘা কুয়াশার আড়ালে। শেরিশে গাঁও থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন পাইনি শেষপর্যন্ত। তা হোক, হিমালয়ের পাদদেশের লুকিয়ে থাকা গ্রামটি দেখা হচ্ছে ।
হোমস্টেতে ফিরতেই সন্তোষজি হাতে তুলে দিলেন মাটিমাখা কিছু বড় এলাচ। আহা, এ এক মহার্ঘ্য উপহার। হোমস্টের চৌহুদ্দির মধ্যেই একটি কমলালেবুর গাছের পরিচর্যা করছিলেন সন্তোষজি। ওই একটিই গাছ। তাতে ছোট ছোট ফল ধরেছে। সন্তোষজি জানালেন, গ্রীষ্মে নীচের উপত্যকা থেকে ময়ূরের দল এসে এই গাছটিতে হামলা চালিয়েছে। অন্যান্য গাছের বীজ নষ্ট করেছে। এটা শুনে হাসতে গিয়েও সন্তোষজির ব্যাজার মুখ দেখে সামলে নিলাম নিজেকে। ময়ূর বাহিনীর হামলার কাল্পনিক একটা দৃশ্য মনের চোখে ভেসে ওঠায় হাসি পেয়েছিল। কিন্তু এই পাহাড়ে, পাহাড়ের গ্রামে গ্রামে এটা ঘোর বাস্তব ও একটা সমস্যা তো বটেই। সাম্প্রতিক কালে ভয়ঙ্কর ঝাল লঙ্কা ‘ডালে খুরসানি’র চাষে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে ময়ূরের হানা। উৎপাদন কমেছে কালিম্পং, দার্জিলিংয়ে। বনে ওদের খাবার কম পড়েছে কিনা, কোন খাবারের জন্য ওরা তাড়া খেয়েও লোকালয়ে আসে, এগুলো নিয়ে সমীক্ষা, গবেষণার দরকার রয়েছে বলেই তো মনে হয়।
যথারীতি সন্তোষজির ছোট ছেলে ও তাঁর স্ত্রী রান্নার কাজে ব্যস্ত। রান্না হয় গ্যাসেই। প্রয়োজনে কাঠের উনুন ব্যবহৃত হয়। সে উনুন গড়া রয়েছে রান্নার ঘরেই। জ্বালানি হিসেবে শুকনো কাঠ ব্যবহৃত হয় সেই হাতে গড়া উনুনে। সে কাঠ মজুদ রাখতে হয়। থুলুং পরিবারের বাড়িতেও জল গরমের একটা ঘেরাটোপ আছে। অতিথিদের জন্য গরম জল সরবরাহ হয় সেখান থেকেই।
রান্নাঘরে উনুনের পাশের দেওয়াল থেকে দড়ির মতো শুকনো মাংস ঝুলছে দেখলাম। প্রসঙ্গত, নেপালিরা শূকর ও মোষের মাংস খেয়ে থাকেন (গরু নয় কিন্তু)। থুলুং হোমস্টের অতিথিদের মুরগির মাংসই পরিবেশন করা হয়। তবে কেউ শূকরের মাংস খেতে চাইলে পাবেন। বাড়িতে পারিবারিক মেহমান আসবে বিকেলে। তাঁদের আপ্যায়নের প্রস্তুতি চলছে। নীচে কলঘরের চালে কিছু মাংস শুকোতে দেওয়া হয়েছে চোখে পড়ল।
সন্তোষজির নাত-বৌ ছেলেকে নিয়ে রোদ্দুরে বসেছে। তার স্বামী, মানে সন্তোষজির বড় নাতি জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে ফিরল। ছোট নাতি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বেরিয়েছে। সন্তোষ থুলুংয়ের স্ত্রী মুরগির খাঁচা পরিষ্কার করছেন। পারিবারিক কর্মপ্রবাহের একটি তাৎক্ষণিক চিত্র। দার্জিলিং, কালিম্পং, সিকিমে প্রচুর হোমস্টে রয়েছে। কিন্তু এই ঘরোয়া পরিবেশটা পাওয়া যায় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। অনেক হোমস্টেই কার্যত হোটেলের ছোট সংস্করণ।
বিকেলে শিরিশে গাঁওয়ের রাস্তায় খানিক হেঁটে বেড়ালাম। নৈঃশব্দ এখানকার মন্ত্র যেন। নানা বর্ণের ফুলেরা রূপকথা বলে।
তারপর চা খেতে খেতে আর সন্তোষ থুলুংয়ের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল। সন্তোষ থুলুং একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। তিলে তিলে পরবর্তী তিন প্রজন্মের জন্য জীবীকার ব্যবস্থা করে চলেছেন। এবং সেই সৃষ্টির কাজটা যে তিনি উপভোগ করছেন, সেটা বোঝা যায় তার মৃদু হাসিতেও। রিশপ থেকে অনেক দূরের যে আলোর বিন্দুগুলো দেখেছিলাম, তার একটা হয়তো এই থুলুং পরিবারের আলো। এমন আরও কতো আলোর দিশা রয়েছে।
পরের দিন সকালে তেনজির পাঠানো গাড়ি হাজির। থুলুং পরিবারের সদস্যরা জড়ো হলেন। তাঁদের বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। চড়াই পথ ধরে গাড়ি এসে পড়ল রেশি রোডে। পিছন ফিরে তাকিয়েছিলাম একবার। কোথায় কী। ঘন কুয়াশার আড়ালে চলে গেছে শিরিশে গ্রাম –
উপর থেকে ৩ ও ৬ নং ফটো সৌজন্যঃ থুলুং হোমস্টে।
অন্যান্য ফটো তুলেছেন লেখক।
শেষ ফটোটি সিলারিগাঁওয়ের। শেরিশে গাঁও থেকে রামধুরা, ইচ্ছেগাঁও, পেডং, সিলারিগাঁও, রিশপ, লাভা, ঝান্ডিদাড়া, কালিম্পং শহর বেড়িয়ে নেওয়া যায়। কালিম্পং মোটর স্ট্যান্ড থেকে থেকে শেরিশে গাঁও প্রায় ২১ কিলোমিটার।
ফোনঃ থুলুঙ হোমস্টে-৯৪৩৩৮ ২৬৪৮০।
তেনজি শেরপা-৭০৯৮৭ ৮৩২৮৭।