ডি ভি সি-র উচ্চপদের চাকরি থেকে আগাম অবসর নিয়েছেন বেড়ানোর জন্য। সুব্রত ঘোষ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পেশা থেকে এখন ভ্রমণের আঙিনায়। বেড়ান বছরভরই। সঙ্গী স্ত্রী পাপিয়া ঘোষ। দু’জনে মিলে বেরিয়ে পড়েন দেশের নানা প্রান্তের বিভিন্ন ভ্রমণ ঠিকানার উদ্দেশে। এবার জানাচ্ছেন অরুণাচল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয় পর্বে থাকছে অরুণাচলের তাওয়াং বেড়ানোর কথা। প্রথম পর্বের ‘ভ্রমণ অরুণাচলে’ লেখাটি পড়তে পারেন এখানে https://torsa.in/arunachal-assam-travel/
আজ ২৫ এপ্রিল। ২৩ এপ্রিল ভালুকপং হয়ে অরুণাচল প্রদেশে ঢুকে পড়েছি। ভালুকপং থেকে দিরাং। গতকালের রাত কেটেছে দিরাংয়ে। আজ গন্তব্য তাওয়াং। সঙ্গে গাড়ি রয়েছে। ব্রেকফাস্ট সেরে সকাল ৯টা নাগাদ দিরাং থেকে তাওয়াংয়ের উদ্দেশে রওনা হওয়া গেল।
পথের উচ্চতা বাড়তে থাকল। আমরা সেলা পাসে পৌঁছালাম। ১৩,৭০০ ফুট উচ্চতায় এই সেলা গিরিপথের মাধ্যমে দিরাং, ভালুকপং, গুয়াহাটির সঙ্গে তাওয়াংয়ের যোগাযোগ রক্ষিত হয়। এটি ১৩ নম্বর জাতীয় সড়ক। সেলা পাসের উপরের দিকে সেলা লেক ও প্যারাডাইস লেক দেখলাম। অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ। তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মালম্বীদের কাছে এই পার্বত্য হ্রদ দুটি অত্যন্ত পবিত্র বলে গণ্য হয়।
১৯৬২-র চিন-ভারত যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ান যশোবন্ত সিং রাওয়াত চিনা বাহিনীর সঙ্গে প্রবল পরাক্রমের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিহত হন যুদ্ধক্ষেত্রে। এই বীর সেনানীর স্মরণে ওয়ার মেমোরিয়াল তৈরি হয়েছে। যশোবন্ত সিং মরনোত্তর মহাবীর চক্র সম্মানে ভূষিত হন। ১০,৯৬০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত যশোবন্ত গড় ওয়ার মেমোরিয়াল দেখলাম। লোকমুখে নানা গল্প প্রচলিত রয়েছে এই বীর সেনানীকে নিয়ে।
যশোবন্ত গড় থেকে আমাদের গাড়ি জং জলপ্রপাতের পথ ধরল। তাওয়াং শহরের ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে নুরানং নদী থেকে এই জলপ্রপাতের উৎপত্তি। জং জলপ্রপাতের আরেক নাম নুরানং ফলস। ৩২৮ ফুট উচ্চতা থেকে ঝাঁপ দিয়েছে প্রপাতটি। জলপ্রপাত দেখে আমরা তাওয়াংয়ের পূর্ব নির্দিষ্ট হোটেলে পৌঁছালাম।
এই এপ্রিলের শেষে তাওয়াংয়ে দিনের তাপমাত্রা ১১ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। আর রাতের গড় তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। পরের দিন, ২৬ এপ্রিল, সকালের জলযোগ সেরে বেরিয়ে পড়লাম তাওয়াং বেড়িয়ে দেখতে। আঞ্চলিক গাড়ি ভাড়া করতে হয়। ভাড়া নিয়েছিল ৬ হাজার টাকা।
তাওয়াং ভ্রমণে আমরা প্রথমে গেলাম তাওয়াং মনাস্ট্রিতে। ভারতের বৃহত্তম মনাস্ট্রি। প্রকৃত নামটি বড়সড়। তিব্বতি ভাষায় তাওয়াং মনাস্ট্রির নাম ইংরেজি বানানে ‘Gaden Namgyal Lhatse’. অতীতে তিব্বতের লাসার সঙ্গে এই মনাস্ট্রির ধর্মীয় যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়। তাওয়াং মনাস্ট্রি তৈরি হয়েছে ১৭’শ শতকের শেষের দিকে। মনাস্ট্রির অবস্থানটি ইন্টারেস্টিং। মানচিত্রে দেখলাম, তাওয়াং চু বা তাওয়াং নদী উপত্যকায় এই মনাস্ট্রি। কাছেই তিব্বত তথা চিন ও ভুটানের সীমানা।
চিনের যে একটা আগ্রাসী নজর আছে তাওয়াং তথা অরুণাচলের একটা অংশের দিকে তা আমাদের অজানা নয়। ভারতনিবাসী বর্তমান দলাই লামা তাওয়াংয়ে এলে চিন অসন্তোষ প্রকাশ করে। লাদাখ সীমান্তে চিনা সেনার তৎপরতা বাড়ে তখন। তিব্বত চিনের অধিকারে আসার পর থেকে চিন তাওয়াংকে তাদের এলাকা বলে দাবি করে।
তাওয়াং অরুণাচল প্রদেশের তিব্বত তথা চিন-ঘেঁষা একটি জেলা। তাওয়াং শহর এই জেলার সদরদপ্তর। এ শহরের সর্বত্রই তিব্বতি সংস্কৃতির প্রভাব চোখে পড়ে। ঐতিহাসিক দিক থেকে এই তাওয়াং ছিল তিব্বতেরই অংশ। ১৯১৪ সালের সিমলা চুক্তি অনুসারে তাওয়াং-সহ তিব্বতের একটি অংশ ব্রিটিশ ভারতের অধিকারে আসে। মনপা উপজাতির লোকজনের দেখা পাওয়া যায় তাওয়াং অঞ্চলে। আগে এঁরা ছিল ভবঘুরে উপজাতি গোষ্ঠী। তাওয়াংয়ের মনপারা এখন একটু থিতু হয়েছে। এখনও মনপাদের একটা বড় অংশের জীবীকা পশুচারণ।
তাওয়াং মনাস্ট্রির উত্তরে শান্ত পরিবেশের মধ্যে শাক্যমুণি বুদ্ধের সুদীর্ঘ মূর্তি দর্শন হল। মূর্তিটির উচ্চতা ২৬ ফুট। এখান থেকে তাওয়াং চু উপত্যকাটি খুব সুন্দর দেখা যায়। তাওয়াং শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে সবুজে ঘেরা উরগেলিং মনাস্ট্রি দেখতে গিয়েছিলাম। এটি ষষ্ঠ দলাই লামা স্যাঙ্গিয়াং তাশির জন্মস্থল। জন্ম ১৬৮৩ সালে। তাঁর পিতা তাশি তেনজি এখানে বসবাস করতেন বলে জানা যাচ্ছে। মনাস্ট্রির পরিবেশটি বড় শান্তিদায়ক।
১০,০০০ ফুট উচ্চতায় তাওয়াং শহরটা শান্তশিষ্ট। বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির নিশান ওড়ে শহর জুড়ে। আঞ্চলিকদের মধ্যে তিব্বতি ভাষা বহুল প্রচলিত। হিন্দি, ইংরেজি চলে। পোশাক-পরিচ্ছদেও তিব্বতীয় ঘরানা লক্ষ্য করা যাবে। তিব্বতে না গিয়েও তাওয়াংয়ে আসলে তিব্বতের স্বাদটা পাওয়া যায়। তাই পর্যটনের রমরমা তাওয়াংয়ে। স্বাদের কথা যদি বলতেই হয় তাহলে, প্রকৃতই তিব্বতীয় থুকপা, মোমো পাওয়া যাবে তাওয়াংয়ে। চাইনিজ খাবার আকছার পাওয়া যাবে রেস্তরাঁগুলোয়। মনপাদের খাবারে বেশ করে লঙ্কা ব্যবহার করা হয়। আঞ্চলিক চিজও ব্যবহৃত হয়।
এদিন সন্ধ্যায় তাওয়াংয়ের ওল্ড মার্কেটে ঢুঁ মেরেছিলাম। স্যুভেনির সংগ্রহ করতে হলে এই বাজারটিতে একবার যেতেই হবে। শীতবস্ত্র, দুর্দান্ত কারুকাজের সব চাইনিজ ক্রকারি, জাঙ্ক জুয়েলারি, প্রেয়ার হুইল, হস্তশিল্প সামগ্রীর ছড়াছড়ি এখানে। মঙ্গলবার জনপ্রিয় ওল্ড মার্কেট বন্ধ থাকে। আরও দুটি বাজার আছে তাওয়াং শহরে। নেহরু মার্কেট ও নিউ মার্কেট।
কাল যাব বুমলা পাস। সেখন থেকে চিন সীমান্তে। সে কথা পরের পর্বে।
ফটো
১) সেলা লেক।
২) সেলা পাস।
৩) প্যারাডাইস লেক।
৪) যশোবন্ত গড়।
৫) জং জলপ্রপাত।
৬) তাওয়াং মনাস্ট্রি।
৭) ষষ্ঠ দলাই লামার জন্মস্থল।
৮) তাওয়াংয়ে হস্তশিল্প সম্ভার।
তাওয়াংয়ে হস্তশিল্পের সম্ভার ফটো সৌজন্যঃ ScoopWhoop
অন্য সবক’টি ফটো তুলেছেন লেখক।