Follow us
Search
Close this search box.

শান্ত সমাহিত রিনচেনপং

শান্ত সমাহিত রিনচেনপং

শিলিগুড়িতে সকাল সকাল ছোট্ট জলযোগ সেরে সিকিমের জোরথাংগামী একটা শেয়ার গাড়িতে উঠে বসলাম। বসার ব্যবস্থা ভালোই হল। রাতটা শিলিগুড়ির এক হোটেলে কেটেছে। গাড়ি ছাড়ল। কয়েকজন আঞ্চলিক যাত্রী। রাস্তায় যাত্রী ওঠানামা করবে। জেনেই উঠেছি। লোকাল সহযাত্রীদের সঙ্গে আলাপ বাড়তি পাওনা এমন যাত্রায়। শিলিগুড়ি থেকে জোরথাং ৮৩ কিলোমিটার। জোরথাং থেকে গাড়ি বদল করে যাব পশ্চিম সিকিমের কালুক। সেখান থেকে রিনচেনপং। কালুক থেকে রিনচেনপং ৩ কিলোমিটার। জোরথাং থেকে রিনচেনপং ৩৭ কিলোমিটার। পুজোর সময়। কলকাতায় পথ চলতে ইতিউতি ছাতিমের আঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। সেবকের রাস্তায় সোনালি রোদ্দুর।

ঘন্টা তিনেক লেগে গেল জোরথাং পৌঁছাতে। উত্তর ও পূর্ব সিকিমের তুলনায় দক্ষিণ সিকিমে বর্ষার বিপজ্জনক অভিঘাত অনেক কম। তবুও, কিছু খানাখন্দ তো থাকেই। রঙ্গিত নদীর তীর বরাবর দক্ষিণ সিকিমের এই জোরথাং বেশ বর্ধিষ্ণু শহর। প্রাত্যহিক গাড়ি চলাচলের আধুনিক টার্মিনাস থেকে গাড়ি ছাড়ছে নানা দিকের। টার্মিনাসের কাছেই এ টি এম রয়েছে দেখলাম। মকর সংক্রান্তির সময় জোরথাঙে বড় উৎসব হয়। মেলা বসে। সিকিমের নানা দিক থেকে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়।

জোরথাং

আঞ্চলিক মানুষজন আসন্ন ভাইটিকা উৎসব উপলক্ষ্যে ঘরে ফিরছে। গাড়ির আকাল। তিনতলা টার্মিনাস। যাত্রীপূর্ণ একেকটা গাড়ি হুস হুস করে নেমে আসছে। জানা গেল, প্রাইভেট গাড়ি পাওয়া যাবে না। আর সাধারণ গাড়িতে আমার ঠাঁই হবে না; ঠাঁই হবে না মানে, ভিড়ে ঠাসাঠাসি সে-গাড়িতে আমি যেতে পারব না। ট্রাইপড, বড় বড় ক্যামেরা হাতে দুই যুবক গাড়ির জন্য আমার মতোই হন্যে হয়ে ঘুরছিলেন। আলাপ হল। জানা গেল, আপাতত ওরা কালুকেই যাবেন। শেষপর্যন্ত ওদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বেশি টাকায় একটা মারুতি ওমনি ভাড়া করা গেল।

গাড়ি চলছে। কোনও কোনও বাঁক থেকে দেখা মিলছে তার। রুপোর মতো জ্বলছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। বাঙালি একত্রে বেড়াতে বেরলে যারপরনাই আত্মীয়। দুই যুবকের সঙ্গে ঠিকানা, ফোন নম্বর ইত্যাদি চালাচালি সারা হল। আবার দেখা হবে জানিয়ে কালুকে নেমে ওরা ভিন্ন পথ ধরলেন। সামনে এক তরুণ এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করায় সম্মতি জানালাম। গাড়ি রিনচেনপংয়ের পথ ধরল। একটু এগতে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও তার পারিষদবর্গের সুদীর্ঘ রেঞ্জ ভেসে উঠল বাঁদিকের দৃশ্যপট জুড়ে (কালুক থেকে রিনচেনপং যেতে)।

সারাদিন পরে গরম জলে ভালো স্নান হল। চা-টা খেয়ে চারিদিকটায় নজর দেওয়ার অবকাশ পাওয়া গেল। লাভ হল না বিশেষ। সন্ধ্যা নেমেছে রিনচেনপংয়ে। আকাশে একফালি চাঁদ। চারপাশটায় প্রচুর গাছগাছালি বোঝা যাচ্ছে। দূরের পুঞ্জাকৃতির আলোক বিন্দুগুলো পেলিং পাহাড়ের আলো, জানালেন এক হোটেল কর্মী । উল্টোদিকে আরেকটা হোটেলে অতিথিরা এসে পৌঁছলেন। রাস্তায় নেমে এলাম। ঝিঁঝিঁর কলতান এখানে সেখানে। আর দূরে আধো জোছনায় জলছবির মতো হিমালয়। বেশ ঠাণ্ডা। পরিবেশের গুণে আবশ্য ক্লান্তি উধাও। হোটেলের রেস্তোরাঁয় নৈশাহার সেরে একটু আগেভাগেই শয্যা নেওয়া গেল।

ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে, মোরগের ডাকে। পরে দেখেছি, রিনচেনপংয়ের প্রায় প্রতি বাড়িতেই মুরগি পালন হয়। পাহাড়ের ধাপে চাষবাস। বাড়িতে মুরগি পোষা অর্থনৈতিক কারণেই। অতিথিদের ফরমায়েস অনুসারে হোটেলগুলো থেকে মোরগ কেনা হয়। ডিম বাড়ির সদস্যদের প্রাণীজ প্রোটিনের যোগান দেয়।

অন্ধকার কাটেনি তখনো। একটা সমবেত প্রার্থনার সুর কানে এল। জালনায় এসে দাঁড়ালাম। একদল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী শ্রুতিমধুর প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে চলেছেন। রাতশেষে রিনচেনপংয়ের প্রথম দৃশ্য। অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। কাঞ্চনজঙ্ঘায় রঙের ছোপ লাগলো। একটা শান্ত, সুন্দর সকাল। এই শান্ত পরিবেশটাই রিনচেনপংয়ের বৈশিষ্ট্য। যেন সমাহিত হয়ে থাকে জায়গাটা।

কাঞ্চনজঙ্ঘা, পাণ্ডিম, সিম্ভো, মাউন্ট জপুনো, কাব্রু, রাথোং, জানো পর্বতের শৃঙ্গগুলির সমাহারে শায়িত বুদ্ধের অবয়বটি খুব স্পষ্ট রিনচেনপং থেকে। সান্দাকফু থেকে শায়িত বুদ্ধ অবাক করা রূপ দেখেছি। রিনচেনপং-কালুক থেকে দেখা দৃশ্যও কম যায় না। রিনচেনপং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও মাউন্ট কাব্রু, মাউন্ট পাণ্ডিম ও মাউন্ট কুম্ভকর্ণও খুব ভালো দেখা যায়।

ছবি: রিনচেনপং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। ফটো সৌজন্য: সুব্রত সামন্ত (অবকাশ.কম)

বেলা দশটা নাগাদ বিমল, পুরো নাম বিমল গুরুং, চলে এল গাড়ি নিয়ে। সাইটসিয়িং ঠিক বলব না। একটু ঘুরেফিরে দেখা আর কী জায়গাটা। রিনচেনপংয়ে শপিং ইত্যাদির সুযোগ নেই। হৈচৈ-ও নেই। কাছাকাছি আধা-শহর কালুক। এখানে কিছু দোকানপাট, রেস্তোরাঁ রয়েছে। হোটেল রয়েছে কয়েকটি।

বিমল প্রথমে নিয়ে গেল জঙ্গলে ঘেরা একটি জলাশয়ের কাছে। জলাশয়টি পয়জন পোখরি নামে পরিচিত। বিষ-পুকুর। গ্রীষ্মে, শীতে পোখরিতে জল থাকে না। দৃশ্যত জায়গাটা যে খুব আকর্ষণীয় এমন নয়। তবে ঐতিহাসিক দিক থেকে পয়জন পোখরির গুরুত্ব রয়েছে। সিকিমের চোগিয়াল রাজার সঙ্গে ব্রিটিশ বাহিনীর যুদ্ধ হয়েছিল এই অঞ্চলে। চোগিয়াল বাহিনীকে সমর্থন করে উপজাতীয় লেপচারা অঞ্চলে পানীয় জলের একমাত্র উৎস এই পোখরিতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। বিষাক্ত জল পান করে ব্রিটিশ বাহিনীর বেশিরভাগ সেনার মৃত্যু হয়। ব্রিটিশ সেনারা পিছু হটে। আঞ্চলিক গাছগাছড়া থেকে বিষ তৈরি করা হয়েছিল। আঞ্চলিক মানুষজনের মতে, জায়গাটি ভুতুড়ে, রাতবিরেতে এখানে কেউ আসে না।

রিনচেনপংয়ে বেড়াতে গেলে রিনচেনপং মনাস্ট্রির আঙিনায় গিয়ে দাঁড়াতেই হবে। ৫৫০০ ফুট উচ্চতায় রিনচেনপং মনাস্ট্রি চত্বর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য এককথায় অসাধারণ। এটি সিকিমের তৃতীয় প্রাচীনতম মনাস্ট্রি। গুম্পার মধ্যে রয়েছে অতি বুদ্ধ বা আদি বুদ্ধের বিরল মূর্তি। মূর্তির গাত্রবর্ণ নীল। ধ্যানে উপবিষ্ট বুদ্ধকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করেছেন এক নারী। আরেকটি মনাস্ট্রি আছে। গুরুং মনাস্ট্রি বা রিশুম মনাস্ট্রি নামে পরিচিত।

 

রিনচেনপং মনাস্ট্রি

 

বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম কালুকে। এই কালুক থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ পূর্ব হিমালয়ের দীর্ঘ রেঞ্জ দেখা যায়। তখন সন্ধ্যা। আগেই বলেছি, কিছু দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ আছে কালুকে। সেই এলাকাটায় খানিক ঘোরাঘুরি করে, দুর্দান্ত মোমো আর চা খেয়ে, রিনচেনপং ফেরার পথ ধরলাম।

রাস্তায় টিমটিমে আলো। ডাইনে গাছপালার ঘন জটলা। সেখানে চাপ চাপ অন্ধকার। আকাশে আধেক চাঁদ। দূরে সেই জলছবির মতো কাঞ্চনজঙ্ঘা। শব্দ বলতে শুধু ঝিঁঝিঁর কলতান আর ঘন্টিপোকা সৃষ্ট ধ্বনি। ঠিক যেন ঘন্টা বাজছে, এমনই আওয়াজ করে বড়সড় দেখতে পোকাগুলো। শহরের ঘূর্ণাবর্ত থেকে কতদূর এ সব জায়গা। আলোর ঝলকানি, শব্দের ঢক্কানিনাদ, অশান্তির পরিবেশ থেকে সরে এসে দুটো দিন এমন কোনও জায়গায় কাটিয়ে যেতে পারলে শরীর-মন পরিশুদ্ধ হয়।

কালুক

সঙ্গ নিয়েছে এক বিশালাকার সারমেয়। একটু আগে এক প্যাকেট বিস্কুট খেয়েছে। ওর সঙ্গ এই একলা পথে খানিকটা স্বস্তির। ভাবনাও একটা হচ্ছে। ও তো আসছে কালুক থেকে। তিন কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আবার কালুকে ফিরবে? পরে জানলাম,না, ও আমাদের হোটেল চত্বরেই থাকবে। হোটেল থেকেই ওর খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। এটাই রীতি। পাহাড়ের কঠিন জীবন। একের অন্যকে সাহায্য করাই সংস্কৃতি ও ধর্ম।

পরদিন সকালে প্রথমে রঙিন তারপর একটু বেলা বাড়তে ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। শায়িত বুদ্ধ কী স্পষ্ট। পাখি উড়ছে। গাছে গাছে ফুল। গাড়ি চলে এসেছে। কুকুরটি এসে দাঁড়িয়েছে কাছে। বুঝেছে, চলে যাচ্ছি। গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। হোটেলের এক কর্মী জানালো, আপনি চলে গেলেই ও কালুক ফিরে যাবে। এ ভাবেই ও কালুক-রিনচেনপং যাতায়াত করে। হাঁকডাক, ছটফটানি নেই। পরিবেশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে শান্ত। গাড়ির দিকে চেয়ে বসে রইল।

গাড়ি পেলিংয়ের পথ ধরল। রিনচেনপং থেকে পেলিং কমবেশি ৩৪ কিলোমিটার। পথে অপরূপ ডেন্টাম ভ্যালি এলাকায় গাড়ি দাঁড়াল খানিক। সেই অবসরে পাশের খেত থেকে তোলা সুমিষ্ট পোড়ানো ভুট্টা খাওয়া গেল। এখানে সেখানে প্রার্থনা পতাকা উড়ছে হিমেল বাতাসে। পথের ধার থেকে বাচ্চারা হাত নাড়ছে। মুখে অমলিন হাসি। পথের বাঁকে বাঁকে ঝিলিক দিয়ে উঠতে থাকল কাঞ্চনজঙ্ঘা।

প্রসঙ্গত, রিনচেনপংয়ে থেকেই বেড়িয়ে আসা যায় ছায়াতাল (১৮ কিলোমিটার), হি ওয়াটার গার্ডেন (১৩ কিলোমিটার)। বার্সে রডডেনড্রন স্যাংচুয়ারি (৩০ কিলোমিটার)। মার্চ-এপ্রিল মাসে রডডেনড্রন ফুলে ছেয়ে যায় গোটা বার্সে অঞ্চলটি। সিংসোর ব্রিজ রিনচেনপং থেকে ২৭ কিলোমিটার। সিংসোর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে উত্তরে গ্রাম। উত্তরে এখন সিকিমের জনপ্রিয় পর্যটন ঠিকানা। চাইলে ভ্রমণসূচিতে রিনচেনপংয়ের সঙ্গে উত্তরেকে যুক্ত করে নেওয়া যায়। অর্থাৎ উত্তরেতেও থাকার ব্যবস্থা করা যায়। উত্তরে, রিনচেনপং-কালুক, ছায়াতাল ও পেলিংকে অন্তভুর্ক্ত করে সপ্তাহখানেক সময় নিয়ে পশ্চিম সিকিম ভ্রমণের একটা সুন্দর পরিকল্পনা করা যায়।

ডেন্টাম ভ্যালি

রিনচেনপঙের কয়েকটি হোটেল

হোটেল ল্যান্ডস্কেপঃ ফোন- ৭৫৯৫৯-৭৯৫৪৭। হোটেল রিনচেনপং নেস্টঃ ফোন-৭৪৩২০-২১৫০৯। হোটেল রিনচেনঃ ফোন-৭৪৩২০-২১৫০৯। ডেনজং রেসিডেন্সিঃ ফোন- ৯০৫১৫-৪৩৬৫২। ইয়াং-সে রিট্রিটঃ ফোন-৯০০৭৬-০৬৬৩৫। ম্যান্ডারিন ভিলেজ রিসর্ট(কালুক), ফোন-৯৭৩৩০-৯২২৩০, ৮৬৭০৩-৭১৮২৬। গ্রিন হিল রিসর্ট (কালুক)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *