আড়াই হাজার বছর আগে নিরঞ্জনা নদীর পশ্চিম তীরে উরুবিল্ব গ্রামের একটি পিপুল গাছের নীচে দীর্ঘ ধ্যানের পরে সত্যের সন্ধান পান সিদ্ধার্থ । সেই নিরঞ্জনা বর্তমানে ফল্গু নদী। সেই উরুবিল্ব গ্রাম এখন দক্ষিণ-পশ্চিম বিহারের গয়া জেলার বুদ্ধগয়া। সারা পৃথিবীর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক তীর্থক্ষেত্র। অতীতের উরুবিল্ব গ্রাম এখন এক আন্তর্জাতিক মিলনক্ষেত্র। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বৌদ্ধধর্মাবলী মানুষ এখানে আসেন। সারা বছরই আসেন। প্রতিবছর ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে দলাই লামা মাসাধিকাল বুদ্ধগয়ায় বসবাস করেন ও সকালের প্রার্থনা পরিচালনা করেন।
নেপালের লুম্বিনীতে গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ বুদ্ধগয়ায়, বৌদ্ধধর্ম বিকাশের সূচনা বারাণসীর অদূরে সারনাথে আর গোরক্ষপুরের কাছে কুশীনগরে বুদ্ধের মহানির্বাণ। এই ৪টি জায়গাই সারা পৃথিবীর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র তীর্থ। তবে কালে কালে মহাতীর্থের রূপ নিয়েছে বুদ্ধগয়া। এখানকার পথেঘাটে পদচারণা মানে একটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, বহুজাতিক বাতাবরণের মধ্যে দিয়ে পথ চলা।
গৌতম বুদ্ধের স্মরণে সম্রাট অশোক একটি সৌধ তৈরি করেছিলেন বুদ্ধগয়ায়। সেই পুরোনো সৌধের কিছুটা অংশ এখনো রয়েছে। কুষাণ যুগে এখানে নতুন করে সৌধ তৈরি হয়। পাল-সেন যুগে সেই মহাবোধি মন্দিরের আমূল সংস্কার হয়। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেক্সান্ডার কানিংহ্যাম মহাবোধি মন্দিরের সংস্কার করেন। মন্দিরের বেশ বড়রকমের সংস্কার হয় বর্মার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আগ্রহে, ১৮৮২ সালে। বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দির এলাকা ২০০২ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পেয়েছে।
বুদ্ধগয়ায় রয়েছে চিনা মন্দির ও মনাস্ট্রি, জাপানি মন্দির, থাইল্যান্ডের মন্দির ও মনাস্ট্রি, তিব্বতী মনাস্ট্রি। ভিয়েতনাম, লাওস , শ্রীলংকা এবং বাংলাদেশও মনাস্ট্রি তৈরি করেছে এখানে। রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল বুদ্ধিস্ট হাউস। ফলে সারাবছরই বুদ্ধগয়ার পথঘাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ বিদেশী পর্যটকে গমগম করে। এখানকার কাফে, রেস্তোরাঁগুলিতে থাই, ভুটানিজ, তিব্বতী খাবার মেলে।
বেড়িয়ে দেখা
মহাবোধি মন্দির
১৭০ ফুট উচ্চতার পিরামিড আকৃতির মহাবোধি মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে রয়েছে সোনার জলে গিলটি করা কালো পাথরে তৈরি উপবেশনরত বুদ্ধের বিশাল মূর্তি। ডান হাতটি মাটি স্পর্শ করে আছে। বিশ্বাস করা হয়,এই অবস্থানেই গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। মূল মন্দিরের চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে অনেক স্তুপ। গত ২৫০০ বছরের মধ্যে নানাসময় তৈরি হয়েছে স্তূপগুলি। মন্দির ঘিরে যে রেলিং রয়েছে তা খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে তৈরি হয়েছিল এবং এই রেলিং ইতিহাসের বিচারে এক অমূল্য সম্পদ।
বোধিবৃক্ষ
যে পিপুল গাছের নিচে বসে ধ্যান করে দিব্যজ্ঞান অর্জন করেন গৌতম, সম্ভবত তার পঞ্চম প্রজন্মের গাছটি রয়েছে মহাবোধি মন্দিরের অদূরেই। গাছের নীচে পদ্মাকার বজ্রাসনে বসে পূর্বদিকে মুখ করে ধ্যান করেছিলেন বুদ্ধদেব।
অনিমেষলোচন চৈত্য
বিশ্বাস করা হয় যে, মহাজ্ঞান লাভ করার পরে বুদ্ধ কৃতজ্ঞতাবশতো চোখের পলক না ফেলে এক সপ্তাহ পিপুল বৃক্ষ অবলোকন করেছিলেন। পরে এখানে তৈরি হয় চৈত্য। এছাড়াও দ্রষ্টব্য বুদ্ধের স্মৃতিধন্য চক্রমানা (বুদ্ধের ধ্যানস্থল), রত্নগিরি প্রভৃতি স্থান।
দেখবেন ৮০ফুট উচ্চতার বুদ্ধমূর্তি, পদ্মপুকুর, বুদ্ধকুন্ড, চিনা মন্দির ও মনাস্ট্রি ,বার্মিজ মন্দির,ভুটানের বৌদ্ধ মনাস্ট্রি ,জাপানি মন্দির,থাইল্যান্ডের মন্দির ও মনাস্ট্রি, তিব্বতী মনাস্ট্রি,ইন্টারন্যাশনাল বুদ্ধিস্ট হাউস, আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম, বুদ্ধগয়ার কেন্দ্রস্থল থেকে ২ কিলোমিটার দূরে সুজাতার গ্রাম, দুঙ্গেশ্বরী পাহাড় (সড়কপথে ২২ কিলোমিটার) ও ৩ কিলোমিটার দূরের মৈত্রেয় প্রজেক্ট।
যাওয়ার পথ
বুদ্ধগয়ার নিকটবর্তী রেলস্টেশন গয়া। দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। স্টেশন থেকে ট্যাক্সি বা অটো ধরে বুদ্ধগয়ায় পৌঁছনো যাবে। হাওড়া-গয়া এক্সপ্রেস, মুম্বাই মেল(ভায়া গয়া), পূর্বা এক্সপ্রেস(ভায়া গয়া) প্রভৃতি ট্রেন গয়া যাচ্ছে। আছে আরও ট্রেন। একটু সময় হাতে থাকলে বারাণসীর সঙ্গে বুদ্ধগয়া ভ্রমণ জুড়ে নেওয়া যেতে পারে। বারাণসী থেকে দীক্ষাভূমি এক্সপ্রেস, রাঁচি এক্সপ্রেস, হামসফার সুপারফাস্ট, পূর্বা এক্সপ্রেস,গঙ্গা সাটলেজ এক্সপ্রেস,বুদ্ধপূর্ণিমা এক্সপ্রেস প্রভৃতি ট্রেন গয়া জংশন আসছে ।
বুদ্ধপূর্ণিমা এক্সপ্রেস, নীলাচল এক্সপ্রেস, শব্দভেদী এক্সপ্রেস, জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেস প্রভৃতি ট্রেন গয়া জংশন থেকে বারাণসী যাচ্ছে। রেলপথে গয়া-বারাণসী দূরত্ব ২২০ কিলোমিটার।
সড়কপথে
রাজগীর (৭৮ কিমি), পাটনা (১৩৫ কিমি), নালন্দা (১০১ কিমি),বারাণসী (২৫২ কিমি) থেকে বুদ্ধগয়া সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে। সড়কপথে কলকাতা-বুদ্ধগয়া দূরত্ব ৪৯৫ কিমি। মহারানী ট্রান্সপোর্ট, মহারাণী এক্সপ্রেস, ঐতিয়ানা ট্রাভেলস প্রভৃতি পরিবহন সংস্থার কলকাতা-গয়া বাস সার্ভিস আছে। তথ্যের জন্য দেখতে পারেন এই ওয়েবসাইটটি www.redbus.in .
থাকার ব্যবস্থা
বুদ্ধাগয়ায় থাকার জন্য রয়েছে বিহার রাজ্য পর্যটন উন্নয়ন নিগমের হোটেল সিদ্ধার্থ বিহার (০৬৩১) ২২০০৪৪৫, ৮৫৪৪৪১৮৪০৬ এবং সুজাতা বিহার (০৬৩১) ২২০০৪৪৫, ৮৫৪৪৪১৮৪০৬। বেসরকারি হোটেল: হোটেল অজাতশত্রু – ৯৭৯৮৮৮১২২৩,৯৭৭১২৭০৭৭৭। হোটেল বোধগয়া গৌতম – ৮৭৯৭৭২১৩২৩, ৯৬৩১৬৫৬০৫১। হোটেল হেরিটেজ – (০৬৩১)২২০০২০২। হোটেল ঘরানা (০৬৩১)২২২৫৫১২, ৯৪৭০৪১৬৫৬৩। হোটেল তাজ দরবার (০৬৩১) ২২০১১৭৮, ৯৪৭১০০২২৯৩। শান্তি বুদ্ধ গেস্টহাউস – ৯০৯৭১৭০০৭৫, (০৬৩১) ২২০০১২৯।
মহাবোধি রেস্টহাউস, ভুটান রেস্টহাউস,তিব্বত রেস্টহাউস, বার্মিজ মনাস্ট্রি, ইন্টারন্যাশনাল বুদ্ধিস্ট হাউস, বিড়লা ধর্মশালার মতো জায়গাগুলিতেও থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সাধারণত ডোনেশনের বিনিময়ে থাকার ব্যবস্থা হয়।