দক্ষিণে বকখালি, পশ্চিমে ফ্রেজারগঞ্জ, পুবে বঙ্গপোসাগর; এই চৌহুদ্দির উত্তর-পূর্বাংশে হেনরি আইল্যান্ড বা হেনরিজ আইল্যান্ডের অবস্থান। কলকাতার থেকে ১৪০ কিলোমিটার। হেনরি সাহেবের দ্বীপের সমুদ্র তীরে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিস্তৃত মৎস্য প্রকল্প এলাকা। প্রকল্প এলাকাটিই একটি পর্যটন কেন্দ্র। একের পর এক মাছ চাষের জলাশয়। পানকৌড়ির ঝাঁক। জলাশয়ের পার ধরে হেঁটে বেড়ানোর পথ। প্রকল্প এলাকার মধ্যে দিয়েই সৈকতে যাওয়ার রাস্তা। সেই রাস্তার শেষাংশে ম্যানগ্রোভের হালকা জঙ্গল। তারপর সমুদ্র।
বর্ষায় সেই সমুদ্রে, মাছ চাষের বিশাল বিশাল জলাশয়গুলিতে, সবুজ এলাকা জুড়ে বৃষ্টিপাতের দৃশ্য ও শব্দের সঙ্গত অন্যরকম তো বটেই। একটি ওয়াচটাওয়ার রয়েছে সৈকতে, সেখান থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য মন ভালো করে দেবে। ভাটায় সমুদ্র খানিক দূরে চলে যায়। বর্ষায় ধূ ধূ সেই সমুদ্রের রুং, রূপ আরেক জগৎ। সৈকতে আটকে পড়া ছোট ছোট জলে আটকে পড়া জ্যান্ত শামুক চোখে পড়বে।
উনবিংশ শতকের শেষদিকে ব্রিটিশ সার্ভেয়র হেনরি সাহেব যখন এই অঞ্চলে জমি সমীক্ষায় গিয়েছিলেন, তখন অঞ্চলটি জুড়ে ম্যানগ্রোভের ঘন জঙ্গল। বুনো শুওর, হরিণ, মেছো বিড়াল, সাপখোপের, বাঘেদের আপনভূমি। হেনরি সাহেবের নামানুসারেই পরে ভূখণ্ডটি হেনরি আইল্যান্ড নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
এখন অবশ্য বন্য জীবজন্তুর সে রমরমা নেই হেনরি আইল্যান্ডে। তা বলে প্রাণের অভাব নেই এখানে। পাখি আছে নানা কিসিমের। শুধু মাছরাঙাই কতরকমের। শীতে হেনরিজ আইল্যান্ডে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখির সমাবেশ ঘটে। শীতের মরসুমেও হেনরি সাহেবের দ্বীপটি খুব সুন্দর।
মেছো বিড়াল, বুনো শুয়োর আছে এখানকার সৈকত তীরের জঙ্গলে। সৈকত লাল কাঁকড়ার বিচরণভূমি। আর আছে মাছ। প্রকল্প এলাকার জলাশয়গুলিতে রুই কাতলা ভেটকি ভাঙ্গড় ট্যাংরা, চিংড়ি প্রভৃতি মাছের চাষ হয়। সকালে মাছ ধরা দেখা যায়।
বর্ষায় আকাশজোড়া মেঘ, বৃষ্টি, পাখপাখালির উড়ে যাওয়া, মেঘের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়া আলো, দিনমানেও এক অদ্ভুদ নৈঃশব্দ, রাতে জলে চাঁদের আলো, জলের ছল ছল, সবমিলিয়ে হেনরি সাহেবের দ্বীপ ছোট্ট ছুটিতে অবসর যাপনের এক আদর্শ জায়গা।
হেঁটে বেড়ান সৈকতে কিংবা মৎস প্রকল্পের জলাশয়গুলোর ধার দিয়ে দিয়ে। জলে ঘাই দেবে বড় মাছ। উড়ে যাবে পানকৌড়ির ঝাঁক। গাছের মগডালে ফুলের মতো বকের গুচ্ছ। হঠাৎ হয়তো আবিষ্কার করবেন গোল্ডেন প্লোভার বা হোয়াইট ওয়াগটেল বা সি-ঈগল।সৈকতে যাওয়ার বাঁধানো রাস্তাটির দু’পাশে লতাগুল্মের ঝোপঝাড়। তারপর সেই কাঠের সেতুটি। নৈঃসব্দ ভেদ করে পাখির ডাক ভেসে আসে। তারপর গা ছমছমে জঙ্গল। সেতুর নীচে জলে কাদায় ছোট ছোট কাঁকড়া চোখে পড়ে। তারপর দাইনে, বাঁয়ে আদিগন্ত সৈকত।
হেনরিজ আইল্যান্ড থেকে বকখালি ৫ কিলোমিটার, ফ্রেজারগঞ্জ ৭ কিলোমিটার। হেনরজ আইল্যান্ডে থেকেই সময় করে বেড়িয়ে আসা যায়।
যাওয়ার পথ
সড়ক পথে কলকাতার ধর্মতলা থেকে বকখালি ১৩৫ কিলোমিটার। ধর্মতলার বাসগুমটি থেকে দিনের বিভিন্ন সময়ে দক্ষিনবঙ্গ পরিবহণের বাস ছাড়ে বকখালির উদ্দেশে। বকখালি পৌঁছে একটা টোটো নিয়ে ৫ কিলোমিটার দূরের হেনরিজ আইল্যান্ড চলে যাওয়া যায়। নিজেদের গাড়ি নিয়ে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে কাকদ্বীপ হয়ে সরাসরি হেনরিজ আইল্যান্ড পৌঁছানো যায়। সেক্ষেত্রে বকখালির কিছুটা আগে মূল রাস্তা থেকে গাড়ি বাঁ-দিকের রাস্তায় ঢুকবে। হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদীর ওপর সেতু তৈরি হয়েছে। ফলে গাড়ি বার্জে তোলার দরকার হবে না। রেলপথে যেতে চাইলে শিয়ালদহ-নামখানা লোকাল ট্রেন ধরে নামখানা স্টেশনে পৌঁছানো যায়। স্টেশনের বাইরে থেকে প্রাইভেট গাড়ি পাবেন। বাসে যেতে চাইলে টোটো করে চলে আসুন হাতানিয়া-দোয়ানিয়ার অপর পাড়ে, বাসস্ট্যান্ডে। ওখান থেকে বকখালি, ফ্রেজারগঞ্জ যাওয়ার বাস পাবেন। হাতানিয়া-দোয়ানিয়া পারের বাসস্ট্যান্ড এলাকা থকে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি হেনরিজ আইল্যান্ড চলে আসতে পারেন।
থাকার ব্যবস্থা
থাকার ব্যবস্থা মৎস প্রকল্প এলাকার মধ্যে, রাজ্য মৎস উন্নয়ন নিগম পরিচালিত ‘ম্যানগ্রোভ গেস্টহাউস কমপ্লেক্স’ ও ‘সুন্দরী গেস্টহাউস কমপ্লেক্স’-এ। দুটি কমপ্লেক্স-ই মন জুড়ানো প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে অবস্থিত। উভয় কমপ্লেক্সেই রয়েছে রেস্তোরাঁ। ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার, সবই পাওয়া যাবে। ড্রাইভারের জন্য স্বল্প খরচে থাকার ব্যবস্থা আছে।
ম্যানগ্রোভ কমপ্লেক্সটি প্রকল্প এলাকায় প্রবেশপথের কাছাকাছি। সুন্দরী কমপ্লেক্স এই প্রবেশপথ থেকে খানিকটা দূরে। সমুদ্র সৈকতের কাছাকাছি। সঙ্গে গাড়ি থাকলে সুবিধা হবে, বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে।
গেস্টহাউসে না থাকলেও প্রকল্প এলাকাটি ঘুরে দেখা যায়। এ ব্যবস্থাটি কিছুদিন স্থগিত রাখা হয়েছিল কোভিডের কারণে। এখন চালু রয়েছে।
ফোনঃ ম্যানগ্রোভ গেস্টহাউস কমপ্লেক্স ৯৪৭৪৭৩৫৪৪৩, ৯৬৭৯৩০৪২১৫, ৯৭৩৪২০৪৪১৩। সুন্দরী গেস্টহাউস কমপ্লেক্স ৯৪৭৪৭৩৫৪৪৩, ৯০৯৩৫৪২০৭৭, ৯৬৭৯৩০৪২১৫।