Follow us
Search
Close this search box.

এ বছর এপ্রিলে কাশ্মীর বেড়ানোর কথা -শেষ পর্ব

এ বছর এপ্রিলে কাশ্মীর বেড়ানোর কথা -শেষ পর্ব

আগের দিন বাংগাস ভ্যালি বেড়িয়ে রেসওয়ারিতে ফিরে এসেছিলাম। সূচি অনুসারে লোলাব ভ্যালি যাওয়ার দিন আজ। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। প্রচুর বরফের কারণে গুরেজের পথ ওয়ান-ওয়ে করে দেওয়া হয়েছে। একদিন গাড়ি গুরেজে যাবে। পরের দিন গুরেজ থেকে গাড়ি শুধু ফিরবে। তাই আগে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের গুরেজ উপত্যকা থেকে বেড়িয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

গুরেজ উপত্যকার পথে

আজ ১১ এপ্রিল। আমরা গুরেজ উপত্যকার পথে রওনা হলাম। বান্দিপোরা জেলা অতিক্রম করে ট্রাকবল চেকপোস্টে সমস্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে রাজদান পাসে পৌঁছলাম। এখানে এসে একইসঙ্গে আমরা অভিভূত ও আমি খানিক শঙ্কিতও। ড্রেজার দিয়ে বরফ পরিষ্কার করে রাস্তা তৈরি করা থাকলেও এবং চারিদিকের এই জমাট বরফের দৃশ্য দৃষ্টিনন্দন হলেও ফিরতি পথে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে, সে কথা ভেবেই দুশ্চিন্তা। আরও খানিকটা এগিয়ে দেখা গেল, বিশাল তূষারধসে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। অগত্যা তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পরে ভয়ে ভয়ে বাকি পথ পেরিয়ে সন্ধ্যার মুখে গুরেজ পৌঁছালাম।

গুরেজের কাকা প্যালেস নামের হোটেলটি ওই সুদূরে সত্যিই অনবদ্য। পরিষেবা, গাইডেন্স যদি একটা দিক হয়, অন্যদিকে মানুষগুলোর সুন্দর ব্যবহার, খাওয়াদাওয়া, পরিকাঠামো, সবই প্রশংসার যোগ্য বলে মনে হয়েছে।

১২ এপ্রিল প্রাতরাশ সেরে আমরা সেখপুরার উদ্দেশে রওনা হলাম। রাস্তার অবস্থা ঠিক থাকলে চাকওয়ালি পর্যন্ত অর্থাৎ পাকিস্তানের আওতাধীন কাশ্মীরের বর্ডার পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ আছে পারমিশনের ভিত্তিতে। যাইহোক, প্রথমে গুরেজ উপত্যকার তুলেইল নামের একটা জায়গাতে পৌঁছে আমরা হতবাক হয়ে পড়লাম। আমরা সৌন্দর্যাহ্ত। চারপাশের দৃশ্যাবলী এক আবিষ্কার।

তুলেইল উপত্যকা

দৃশ্য শুধু দৃশ্য নয়, একটা ভালোলাগার, ভালোবাসার অনুভব জাগ্রত হয়। মানুষের হানাহানিকে এই তুষারমণ্ডিত পাহাড়গুলো দেখে। নদী বহে চলে। তুলেইল থেকে সেখপুরায় পৌঁছে নদীর পারে বেশ কিছুটা সময় ঘোরাঘুরি করে, লাঞ্চের পরে হাব্বা খাতুন পাহাড়ের নীচে এক মনোরম পরিবেশে একটা ঝোরার উৎস দেখে গুরেজে ফিরে এলাম। হাব্বা খাতুন পাহাড়ের নামকরণ নিয়ে আঞ্চলিক নানা গল্প প্রচলিত আছে।

গুরেজ উপত্যকা সম্পর্কে বিশদে জানতে পাবেন এই লিঙ্কেঃ https://torsa.in/in-the-gurez-valley-on-the-pakistan-border/

রোজার সময় এখন। ইজাজ রোজা রেখেছে। উপবাসের মধ্যে সারাদিন গাড়ি চালিয়েও ইজাজের হাসিমুখ। ইজাজ কাশ্মীরের ভূমিপুত্র। শান্ত, সুন্দর ছেলেটি। ইজাজের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং পুলিশ ও সেনা কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ১৩ এপ্রিল ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমরা পথে। রাজদান পাস অতিক্রম করে পৌঁছেছিলাম লোলাব ভ্যালিতে।

লোলাব ভ্যালি

পথে আমরা কাশ্মীরের বিখ্যাত উলার লেক দেখলাম। কুপওয়ারা টাউন লোলাব ভ্যালিতে প্রবেশের এন্ট্রি পয়েন্ট। অবাক করা সবুজ পশুচারণ ভূমি, নদী, বনভূমি লোলাব উপত্যকাকে আরেক রূপে এঁকেছে।

এবার আমাদের ফেরার পালা। ঠিক করলাম, যদি সম্ভব হয় তাহলে সোজা শ্রীনগরে গিয়ে বিশ্রাম নেব। তাই-ই করা হল। বুকিং ছাড়াই শ্রীনগরের এক হোটেলে এসে উঠলাম।

পূর্ব পরিকল্পনার খানিকটা রদবদল করে ১৪ এপ্রিল সকালে অহরবল জলপ্রপাত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। শ্রীনগর থেকে ঘন্টা দুয়েকের দুরত্ব। পুলওয়ামা ছাড়িয়ে সোপিয়ান জেলায় অবস্থিত এই জায়গায় না আসলে কাশ্মীর বেড়ানো অসম্পূর্ণই থেকে যেত। অহরবলের জলপ্রপাতটিকে ‘কাশ্মীরের নায়াগ্রা’ বলা হয়। অহরবলের দৃশ্যপট ছবির মতো। ইচ্ছে হয় এখানে একটা রাত কাটানোর, কিন্তু সুযোগ না থাকায় আমাদের শ্রীনগর ফিরে আসতে হল।

১৫ এপ্রিল সকাল সকাল আমরা দুধপাতরির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম শ্রীনগর থেকে। বাদগাম জেলার দুধপাতরি পৌঁছাতে ঘন্টা দুয়েক সময় লাগল। এটা কাশ্মীরের আর একটা উৎকৃষ্ট স্থান, যার সঙ্গে কিছুটা যুসমার্গের, আর কিছুটা বরফবিহীন বাংগাস উপত্যকার মিল পেলাম। তুষারাবৃত পাহাড়ের চূড়াগুলো যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। দুধ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত জায়গাটা। তাই দুধপাতরি বা দুধপাথরি।

দুধপাতরি

১৬ এপ্রিল। আমাদের আজকের গন্তব্য সোনমার্গ। সকাল সকাল রওনা হয়ে সাড়ে এগারোটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সোনমার্গে। আমাদের মধ্যে অনেকে ওখান থেকে বালতাল পর্যন্ত গেলেন। বাকিরা সোনমার্গের সৌন্দর্যে অবগাহন করলেন। আমি অনেকবারই সোনমার্গে এসেছি, কিন্তু এবারের মতো এত বরফ আগে কখনও দেখিনি। তাই খাজিবাস গ্লেসিয়ারের আলাদা আকর্ষণ অনুভব করলাম না। নতুন করে বলার মতো, জোজিলা টানেলের কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। আগে সোনমার্গ আসতে হলে সিন্ধু নদীর ডান পাশ দিয়ে আসতে হতো, এখন জোজিলা টানেলের কাজের জন্য বাম পাশ দিয়ে আসতে হয়। সোনমার্গ তার সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে চিরযৌবনা।

গুলমার্গ আর বুটাপাতরির উদ্দেশ আমাদের যাত্রা শুরু হল ১৭ এপ্রিল সকালে। যে কোনও কারণেই হোক আমার কাছে বরফবিহীন গুলমার্গ অতো আকর্ষণীয় নয়। তবে গুলমার্গ পৌঁছনোর আগের দশ মিনিট রাস্তার সৌন্দর্য অনবদ্য। গুলমার্গে ভ্রমণার্থীদের জমায়েত ভালোই। আমরা আলাদা গাড়িতে গুলমার্গ থেকে বুটাপাতরির উদ্দেশে রওনা হলাম আর প্রতি মুহূর্তে পথের দৃশ্যপট পরিবর্তিত হতে থাকল।

বুটাপাতরি

শ্রীনগরের এতো কাছে বা গুলমার্গের নাকের ডগায় যে এরকম একটা স্বর্গ আছে না আসলে হয়তো জানতেই পারতাম না। সবুজ ঘাসের গালিচায় ফুলের এত বৈচিত্র্য, রংয়ের এত বাহার, হাতের নাগালে বরফের হাতছানি, প্রকান্ড সব গাছের মাঝে বাঙ্ময় নৈঃশব্দ, স্বর্গ কি এর চাইতেও সুন্দর হতে পারে? আজ বুঝি কেন কাশ্মীরকে ভূস্বর্গ বলা হয়। সত্যি সত্যিই কাশ্মীর ভ্রমণ জীবদ্দশায় স্বর্গ ভ্রমণ।

বাকি দুদিন অর্থাৎ ১৮ ও ১৯ এপ্রিল শ্রীনগরের নানা দর্শনীয় স্থান, যেমন মানসবল লেক, ক্ষীরভবানী মন্দির, হজরতবাল, শালিমার গার্ডেন, নিশাতবাগ, চশমাশাহি, পরিমহল, হরিপর্বত, শিকারা ভ্রমণ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে আমাদের এবারের কাশ্মীর ভ্রমণের সমাপ্তি ঘটল।

ক্ষীরভবানী মন্দির

এই মুহূর্তে আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন ভারতবাসি, কিন্তু কাশ্মীরের আবেশে মোহগ্রস্ত হয়ে আছি। তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক হিসেবে কিছু দেশ বা কিছু মানুষ আমাদের সার্বিক দৈন্যতা নিয়ে মজা করতে পারে, কিন্তু প্রাকৃতিক দিক থেকে বা ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে ভারতবর্ষের জুড়ি মেলা ভার, আরেকবার এই উপলব্ধি হল।

আজ ২০ এপ্রিল, ২০২৩, আমাদের ১২ জনের মাইক্রো সংসার শ্রীনগর থেকে বিমানে ওঠার সাথে সাথে বৃহৎ সংসারের সঙ্গে মিশে গেল। আবারও কাশ্মীর ভ্রমণের ইচ্ছা বুকে নিয়ে বিমানের আসনে শরীরটা এলিয়ে দিলাম।

ফটোঃ লেখক

লেখকের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরঃ 9433456266, 9007966182

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *