Follow us
Search
Close this search box.

বিষ্ণুপুরে ১০২৬ বছরের দুর্গাপুজো

বিষ্ণুপুরে ১০২৬ বছরের দুর্গাপুজো

সহস্রাধিক বছরের প্রাচীন পুজো। প্রায় আবিশ্বাস্য, কিন্তু এটাই সত্য। বঙ্গের প্রাচীনতম দুর্গোৎসব। দেবী পূজিত হন মৃন্ময়ী নামে।। বাঁকুড়া জেলার মন্দিরনগরী নামে খ্যাত বিষ্ণুপুরের দলমাদল পাড়ায় দেবী মৃন্ময়ী মন্দিরে আয়োজিত হয় এ পুজো। সপ্তমীর ১৪ দিন আগে থেকে শুরু হয়ে যায় পুজো-প্রক্রিয়া। এ বারও হয়েছে। সুদীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী পুজোর কথা জানাচ্ছেন জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ ঠাকুর। জ্যোতিপ্রসাদবাবু শেষ মল্ল রাজা কালিপদ সিংহ ঠাকুরের পৌত্র।

সঠিক হিসেবে এই ২০২২ সালে বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের দুর্গোৎসব ১০২৬ তম বছরে পদার্পণ করল। সময় এগিয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বিশ্বযুদ্ধ, বিপ্লব, পরমানু বোমা, ভারতে ইংরেজ শাসন, স্বাধীনতার আন্দোলন, কত মোড় ঘোরানো ঘটানা ঘটে গিয়েছে গত হাজার বছরে। বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের দুর্গোৎসব চলেছে নদীর প্রবাহের মতো। দেবী দুর্গাই দেবী মৃন্ময়ী নামে পূজিত হন এখানে।

মৃন্ময়ী মন্দিরের পুজো-উৎসব উপলক্ষে জাগ্রত হয় মল্লভূমের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও গরিমা। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন পুজো দেখতে। আসেন বিদেশীরাও। নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সহস্রাধিক বছরের একটি ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রবাহের সাক্ষী থাকতে আসেন। জাঁকজমকের চেয়ে এ পুজোয় প্রাধান্য পায় দীর্ঘ লালিত আচার-অনুষ্ঠান, যার পরতে পরতে যুক্ত হয়ে থাকে প্রাচীন বাংলার লোক-ঐতিহ্য। যেমন মহামারীমুক্ত জীবনের জন্য থাকে পুজো, সামগ্রিক পূজা-পদ্ধতিরই একটি পর্যায় এট। এক সময় মহামারীর আকারে নানা রোগে উজাড় হয়ে যেত গ্রামের পর গ্রাম। পুজো তার বিরুদ্ধে একটা শুভ প্রার্থনা। আধুনিক কোভিডের যুগেও সেই প্রার্থনাই তো করে চলেছে মানুষ।

রাজা জগৎ মল্ল মৃন্ময়ী মন্দির স্থাপন করেন ৯৯৭ সালে। এটিই বিষ্ণুপুরের সবচেয়ে পুরনো মন্দির। মা মৃন্ময়ী রূপে শরতে দেবী দুর্গার পূজা শুরু হয় মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই।

প্রসঙ্গত, মল্ল বংশের মূল খুঁজতে হলে যেতে হবে রাজস্থানে। মহারানা প্রতাপ ও মল্ল বংশের গোত্র এক। প্রথম মল্লরা বাংলায় এসেছিলেন রাজস্থান থেকে। মল্ল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আদি মল্ল। সে ৬৯৪ সালের কথা। প্রথম রাজধানী বাঁকুড়ার লাউগ্রাম। আদি মল্লের পুত্র জয় মল্ল রাজধানী স্থানান্তরিত করেন বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে। বাড়তে থাকে মল্লরাজাদের শাসনাধীন এলাকা। ক্রমশ মল্লভূম প্রসারিত হয় সমগ্র বাঁকুড়া, বীরভূম মেদিনীপুর পুরুলিয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ-সহ গোটা রাঢ়বঙ্গে। পশ্চিমে ছুঁয়ে ফেলেছিল ছোটনাগপুর মালভূমিকে। মধ্যযুগে মল্লভূম হয়ে উঠেছিল বাংলার এক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। মল্ল রাজবংশের ৪৯ তম রাজা বীর হাম্বিরের সময়ে মল্লভূম এবং বিষ্ণুপুর উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিল।

১৬২২ থেকে ১৭৫৮ সালের মধ্যে বিষ্ণুপুরে টেরাকোটা শৈলীতে তৈরি মন্দিরগুলির খ্যাতি বিশ্বজোড়া। বৈষব ধর্মের প্রভাব রয়েছে মন্দিরগুলির গড়ে ওঠার পিছনে। বিষ্ণুপুরের জোরবাংলা মন্দির, শ্যামরাই মন্দির, রাসমঞ্চের মতো স্থাপত্য এখনো মানুষকে বিস্মিত করে চলেছে। রয়েছে টেরাকোটা শৈলীতে তৈরি আরও অনেক মন্দির।

বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির হস্তশিল্প, বালুচরী শাড়ির কদর দেশে-বিদেশে। বাংলার ধ্রুপদ সংস্কৃতির বিকাশে বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীতের ভূমিকাও কম কিছু নয়। এই ঘরানারও উদ্ভব মল্ল রাজাদের আমলে। বিষ্ণুপুর বাংলার একটি বিশিষ্ট পর্যটন কেন্দ্রও বটে।

যাইহোক, মৃন্ময়ী মন্দিরের পুজোর কথায় ফেরা যাক। পুজোর আয়োজন করে থাকেন একদা মল্ল রাজপরিবারের বর্তমান সদস্যরা। আপাত দেখনদারির কোনও প্রচেষ্টা থাকে না এ পুজোয়। ফল্গুর মতো বইতে থাকে বহু মানুষের শুভ কামনা। বংশ পরম্পরায় নানা সম্প্রদায়ের মানুষ পুজোর বিভিন্ন কজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও মা সারদা মৃন্ময়ী মন্দিরে এসেছিলেন।

এখানকার পুজো-অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায় সপ্তমীর ১৪ দন আগে থেকে। আরব্রা নক্ষত্রযুক্ত কৃষ্ণনবমীর দিন পুজোর সূচনা ঘটে। সুদীর্ঘ পুজো-ঐতিহ্য, প্রচলিত নানা আচার মেনে দশমী পর্যন্ত চলতে থাকে পুজোর পর্ব। সেই আদি মন্দির আর নেই। নতুন করে মন্দির তৈরি হয়েছে। যতদূর জানা গেছে, এই ১০২৬ বছরে মৃন্ময়ী মন্দিরে বাৎসরিক দুর্গোৎসবে, দেবী মৃন্ময়ীর আরাধনায় ছেদ পড়েনি। পুজোর আচারের মধ্যে ইতিহাসের অনেক উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে।

পুজো হয় মা মৃন্ময়ী দেবী, বড় ঠাকুরানী তথা মহাকালী, মেজ ঠাকুরানী বা মহাসরস্বতী, ছোট ঠাকুরানী তথা মহালক্ষী এবং অষ্টধাতুর বিশালাক্ষী দেবীর। দেবী বিশালাক্ষী অষ্টদশভূজা। বড় ঠাকুরানী, মেজ ঠাকুরানী এবং ছোট ঠাকুরানীর পটচিত্র পূজিত হয়। পটচিত্রের বিসর্জন হয়। দেবী মৃন্ময়ী মূর্তির বিসর্জন হয় না।

 

ওই যে আচারের কথা বলেছি তার নানা রকমফের। একটা উদাহরণ দিই, পুজোর বিষেশ নানা ক্ষণে কামান দাগা হয়। এ প্রথার দর্শনটি হল শব্দ-ব্রক্ষ্মকে স্মরণ করা। আরেকটি দিক, অতীতে পুজোর পর্ব সম্পর্কে দূরবর্তী মানুষকে অবহিত করা হত কামান দেগে। প্রথাটি চলছে। কামান দাগার কাজটি করে বিষ্ণুপুরের বাঁকা গ্রামের মহাদণ্ড পরিবারের সদস্যরা।

নানা কথা, নানা কাহিনি, নানা আচার, নানা প্রথা আর অসংখ্য মানষের শুভেচ্ছা আবর্তিত হয় এ পুজোকে কেন্দ্র করে। বিসর্জনে আকাশে ওড়ে নীলকন্ঠ পাখি।

 

ছবিঃ লেখক

বিষ্ণুপুর ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্যের জন্য ‘মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর‘ শীর্ষক লেখাটি দেখতে পারেন এই লিঙ্কেঃ https://torsa.in/in-winter-the-temple-city-is-bishnupur/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *