ক্রিসমাসের দার্জিলিঙে উৎসবের আবহ। রোমান্টকতার আরেক মাত্রা পেয়ে যায় শহরটা। ১৫ ডিসেম্বর থেকে বর্ষবরণ পর্যন্ত প্রবল ঠান্ডার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে সেই আমেজ, উষ্ণতা, উচ্ছ্বলতা। পাড়ায় পাড়ায় গিটার, গান। বয়স্কদের মুখে লামাসুলভ হাসি। শহরটা বেশ সেজে ওঠে। ঘিঞ্জি হয়েছে দার্জিলিং। তা হোক। ধুপিবনের কুয়াশা, রোমান্টিক কাঞ্চনজঙ্ঘা, মলে জমায়েত, বাতাসিয়া লুপে টয় ট্রেনের হুইসল, ঘুমের বৌদ্ধ মন্দিরে প্রার্থনা, ভোরের টাইগার হিল, এ পুরনো হবার নয়। প্রচুর মানুষের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে বেশ লাগে।
ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে, ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আমলেই ৬,৭০০ ফুট উচ্চতার দার্জিলিং পাহাড় ইংরেজদের নেকনজরে এসেছিল। তারপর ক্রমশ দার্জিলিং শহরকে যত্নের সঙ্গে একটি হিল স্টেশনের রূপ দিয়েছিল ইংরেজরাই। ফলে দার্জিলিং শহরে ক্রিসমাস ও নিউ ইয়ার উদযাপনের একটা সুদীর্ঘ ঐতিহ্য আছে।
এদিন সকালের প্রথম গন্তব্য হতে পারে সেন্ট অ্যান্ড্রিউজ চার্চ। এখানে ক্রিসমাস মর্নিং মাসে অংশগ্রহণ করা যায়। ক্রিসমাস ক্যারোল হয়। সেন্ট অ্যান্ড্রিউজ চার্চ দার্জিলিংয়ের প্রাচীনতম চার্চ। হেরিটেজ অ্যাংলিকান চার্চ। স্থাপিত হয়েছিল ১৮৪৩ সালে। এখানে প্রথম ধর্মীয় আচার বা ‘সার্ভিস’ আয়োজিত হয়েছিল ১৮৪৪ সালে। অগ্নিকাণ্ড, ভূমিকম্পে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই স্কটিশ গির্জাটি। আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে । দার্জিলিং মলের কাছেই (মল রোড) এই চার্চটির অবস্থান।
আগ্রহীরা বেড়িয়ে দেখতে পারেন দার্জিলিংয়ের অন্য চার্চগুলিও। দার্জিলিং স্টেশনের কাছেই রয়েছে আরেকটি স্কটিশ চার্চ, সেন্ট কলম্বাস ক্রিক। লেবং রোডে রয়েছে সেন্ট জুড ক্যাথলিক চার্চ। চক বাজারে ইমাকুলেট কনসেপশন চার্চ। মল রোডের কাছেই রয়েছে রোমান ক্যাথলিক চার্চ। লোরেটো কনভেন্টের একটি অংশ এই চার্চটি। দার্জিলিংয়ের নর্থ পয়েন্ট এলাকায় রয়েছে সেক্রেড হার্ট চার্চ। অন্য চার্চগুলির তুলনায় সেক্রেড হার্ট চার্চের গঠনশৈলী ভিন্নতর, সেটা চোখে পড়বে।
সাধারণত এ সময়ের দার্জিলিং রৌদ্রকরোজ্জল হয়ে থাকে। ঘন সবুজ পাইনের বন। ইতিউতি কুয়াশার জটলা। সকালে দার্জিলিংয় শহরের হেথা-হোথা থেকে আঞ্চলিক বেকারিতে তৈরি কেক, কুকিজের সুঘ্রাণ ভেসে আসে।
মেজাজি ইংলিশ ব্রেকফাস্ট করতে হলে কেভেন্টার্সে ঢুকে পড়তে পারেন। স্মোকড সসেজ, সালামি, বেকন, চিজ ওমলেট, বাটার টোস্ট, টেবিলে খাদ্যের প্ল্যাটার-সহ পরিবেশিত হয় নস্টালজিয়া। ১৯১১ সালে সুইডিশ ডেয়ারি ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কেভেন্টার্সের উদ্যোগে এই হেরিটেজ রেঁস্তোরাটির প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। সত্যজিৎ রায়ের গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদা ও তাঁর সাগরেদ তোপসে এই রেঁস্তোরার রুফটপে বসে হট চকোলেট খেতে ভালোবাসে।
দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক ক্লক টাওয়ারের কাছে নেহরু রোডে আরেক শতবর্ষ প্রাচীন বেকারি ও কাফে গ্লেনারিজ। স্যান্ডউইচ, পিৎজা, কেক আর উৎকৃষ্ট মানের দার্জিলিং চায়ের সুনাম দীর্ঘদিনের। গ্লেনারিজে ঢোকার মুখেই শীতবস্ত্র বিক্রির বিপণির সারি। প্রয়োজনে শপিংটাও হয়ে যেতে পারে।
ভোররাতে উঠে প্রবল ঠান্ডায় টাইগার হিল গেলে, ফেরার পথে বাতাসিয়া লুপে তো খানিক সময় কাটানোই যায়। অন্যথায় দার্জিলিং থেকে একটা গাড়ি নিয়ে ৫ কিলোমিটার দূরের বাতাসিয়া লুপে চলে যাওয়া যেতে পারে। পার্ক, কাঞ্চনজঙ্ঘা, টয়ট্রেনের মোড় ফেরা ভালো লাগে। বাতাসিয়া লুপ এলাকায় সকালের দিকটায় কার্যত মেলা বসে। গরম মোমো তো বটেই, মায় আলুর চপ পাওয়া যাবে।
কিংবা মলের নীচের রাস্তা ধরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়ি, অধুনা সংগ্রহশালার পাশ দিয়ে ঢালু রাস্তা ধরে, ভুটিয়া বস্তির মধ্যে দিয়ে দার্জিলিংয়ের প্রাচীন মনাস্ট্রিটি দেখে আসতে পারেন। দার্জিলিংয়ে থাকলে চিড়িয়াখানা আর পাশের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে না গিয়ে তো পারা যায় না। চিড়িয়াখানায় ভিড় হবে। গাড়ি ভাড়া করে দার্জিলিং শহর-সংলগ্ন বিভিন্ন টুরিস্ট পয়েন্ট বেড়িয়ে আসা যায়।
গান্ধি রোডের ডেকেভাস, ওয়াচ টাওয়ারের কাছাকাছি কুঙ্গা, লাডেন লা রোডের পার্ক রেঁস্তোরা, গ্লেনারিজ বা কেভেন্টার্স, গান্ধি রোডের নিরামিষ ভোজনালয় লুনার রেঁস্তোরা, লাঞ্চের জন্য রেঁস্তোরার অভাব হবে না।
লাডেন লা রোডের রিঙ্ক মলে (জিপিও-র উল্টোদিকে) নাথমুল্লাসের টি-শপের চায়ে চুমুক দিলে দার্জিলিংয়ের আঘ্রাণ পাবেন। দার্জিলিংয়ের হেরিটেজ টি স্টোর এটি। প্রতিষ্ঠা ১৯৩১ সালে।
সুরা রসিকদের গন্তব্য হতে পারে জোয়েস পাব। দার্জিলিংয়ের আইকনিক পাব বলা চলে। অবস্থান ক্লক টাওয়ারের কাছাকাছিই, ডঃ এস এম দাশ রোডে। একটা ব্রিটিশ স্টাইল আছে এই পুরনো পাবটির গঠনে। সন্ধ্যায় সঙ্গীতের আসর জমে। গ্লেনারিজের পাব দি বাজ। গান্ধি রোডের পুলিশ পয়েন্টের কাছে ব্রিটিশ আমলের প্ল্যান্টার্স ক্লাবের কেতাদুরস্ত বারটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। ক্লাব স্থাপিত হয়েছিল ১৮৬৮ সালে। হ্যাঁ, মনে রাখতে হবে দার্জিলিংয়ের কোনও পাব বা বার বেশি রাত্রি পর্যন্ত খোলা থাকে না।
বড়দিনের সন্ধ্যায় গ্লেনারিজের বাইরে ক্রিসমাসের ক্যারোলে গলা মেলাতে পারেন। ঢুকে পড়তে পারেন গ্লেনারিজের রেঁস্তোরায়। রোস্টেড ডাক, স্টেক, অ্যাপেল পাই, পাম পুডিং শীতের রাতে চমৎকার। গ্লেনারিজের স্পেশাল ক্রিসমাস কেক নিয়ে ফিরতে পারেন।
রহিসি ডিনার সারতে চাইলে শতবর্ষ প্রাচীন বিলাসবহুল হোটেল মেফেয়ারে ঢুকে পড়তে পারেন। দার্জিলিংয়ের রাজভবনের উল্টোদিকে ব্রিটিশ গঠনশৈলীর এই হোটেলের অবস্থান (ফোনঃ ৩৫৪ ২২৫ ৬৩৭৬)।
পড়তে পারেন