Follow us
Search
Close this search box.

গঙ্গোত্রী থেকে তপোবন ট্রেক

গঙ্গোত্রী থেকে তপোবন ট্রেক

২০১৯-এর ১২ অক্টোবর। হাওড়া-দিল্লি পূর্বা এক্সপ্রেস ছাড়ল সময়মতোই। দলে আমরা পাঁচজন। চলেছি গঙ্গোত্রী চিরবাসা ভোজবাসা গোমুখ তপোবন ট্রেকিংয়ে। সরাসরি দেরাদুনের টিকিট পাওয়া যায়নি। তাই প্রথম গন্তব্য দিল্লি। সেখান থেকে দেরাদুন। ১৩ অক্টোবর নিউ দিল্লি থেকে দুপুরের দেরাদুনগামী শতাব্দি এক্সপ্রেসে উঠে বসলাম। অনলাইনে টিকিট কাটা ছিল আগেই। রাতে দেরাদুন পৌঁছে গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের গেস্টহাউসে উঠলাম। রাতটা দেরাদুনেই কাটলো।

১৪ অক্টোবর সকাল সকাল আমাদের যাত্রা শুরু হল গঙ্গোত্রীর উদ্দেশে।
গাড়ির ব্যবস্থা করা ছিল আগেই। দেরাদুন থেকে গঙ্গোত্রী, পাড়ি দিতে হবে ২৪২ কিলোমিটার পথ। বলে রাখি, দেরাদুন থেকে গঙ্গোত্রী যাওয়ার বাসও পাওয়া যাবে। মুসৌরির প্রান্ত ঘেঁষে গাড়ি পৌঁছালো তেহরি। দীর্ঘ তেহরি ড্যাম ও বিশাল জলাধার খুব সুন্দর। এরপর চিন্যালীসৌর, ধারাসু, উত্তরকাশী ও হরশিল হয়ে সন্ধ্যায় গঙ্গোত্রী পৌঁছানো গেল। চিন্যালীসৌর থেকে গঙ্গোত্রীর দূরত্ব ১৩১ কিলোমিটার। এই অংশের গোটা রাস্তার সমান্তরালে বয়ে চলেছে ভাগীরথী। কত বাঁক সে নদীর, নদীখাতের কত আকার, কোথাও কোথাও নদীখাতের গভীরতা দেখে বুক কেঁপে যায়। বয়ে চলেছে সবুজ স্ফটিক রঙের প্রাণদায়ী বারিধারা। হরশিলে দেখলাম বিশাল বিশাল আপেল বাগিচা। দেরাদুন থেকে গঙ্গোত্রী পৌঁছাতে ১২ ঘন্টা সময় লাগল। এরমধ্যে অবশ্য বার দুয়েক গাড়ি থামাতে হয়েছিল খাওয়াদাওয়া ইত্যাদির জন্য।

চিন্যালীসৌর থেকে ভাগীরথীর প্রবাহ।

গঙ্গোত্রীতেও জিএমভিএন-এর গেস্টহাউসে ঘর বুক করা ছিল। একেই ১১২০০ ফুট উচ্চতা, তার উপর অক্টোবর মাস। ঠান্ডার তীব্রতা যেন শরীরে সূচ বেধাঁতে লাগল। দীর্ঘ যাত্রার পরে শরীরও বিশ্রাম চাইছিল। রাতের খাওয়া সেরে ঢুকে পড়লাম লেপের নীচে।

সকালে উঠে ভাগীরথীর হিমশীতল জলে স্নান করলাম। শরীর যেন অসাড় হয়ে গেল খানিকক্ষণের জন্য। তারপর, আহা কী আরাম। শরীরের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। মনেও কী এক স্ফূর্তি। পুজো দিলাম গঙ্গোত্রী মন্দিরে। আর কয়েকদিন পরেই, দশেরার দিন মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে। আবার খুলবে এপ্রিলে, অক্ষয় তৃতীয়ার দিন। এ দিনটা (১৫ অক্টোবর) আমরা গঙ্গোত্রীতেই থেকে যাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য, শরীরকে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। খানিকটা সাইটসিয়িংও হল। সূর্যকুণ্ড, জলমগ্ন শিবলিঙ্গ প্রভৃতি দেখা হল। আর চোখের সামনে ভেসে রইল গঙ্গোত্রী উপত্যকার শান্ত সৌন্দর্য।

গঙ্গোত্রী থেকে আমাদের ট্রেকিং শুরু হল ১৬ তারিখ। গাইড়, পোর্টাররা পৌঁছে গিয়েছিল আগেই। এরা সকলেই দেখলাম নেপালি। ট্রেকিংয়ের সিজনে গাড়োয়ালে চলে আসে। আবার অক্টোবরের শেষে, নভেম্বরে ফিরে যায় যে যার বাসস্থানে। দুই কিলোমিটার হাঁটার পরে চেকপোস্টে পৌঁছালাম। বন বিভাগের চেকপোস্ট। গঙ্গোত্রী ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশদ্বারে চেকপোস্টের অবস্থান। আমাদের সকলের সঙ্গে থাকা মালপত্র তল্লাসী করা হল। প্ল্যাস্টিকের ক্যারিব্যাগের মতো সামগ্রীর ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যাইহোক, তল্লাসী শেষ হল সন্তোষজনকভাবেই।

গঙ্গোত্রী শহর,উল্টোদিকের পাহাড় থেকে দেখা।

ফের পথ চলা শুরু হল। পাইনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ। হালকা জঙ্গল ক্রমশ ঘন হয়ে উঠতে থাকল। চিরবাসায় যাওয়ার পথে তিনটে হিমালয়ান থরের দেখা পাওয়া গেল। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরের দিকে উঠছে। আমাদের গাইড বলল, দলে আরও কয়েকটি থর ছিল, তারা আরও আগে উপরে উঠে গেছে। তাই এরা তাড়াতাড়ি ওঠার চেষ্টা করছে। হিমালয়ান থর ছাগল আকৃতির বড়সড় স্তন্যপায়ী জন্তু। উত্তর হিমালয়ের বিভিন্ন পাহাড়ের ঢালে এদের দেখা যায়। থর দেখতে পেয়ে আমরা উৎফুল্ল। চেকপোস্ট থেকে ৯ কিলোমিটার ট্রেক করে আমরা পৌঁছালাম চিরবাসায়। পাইন বৃক্ষ আঞ্চলিক ভাষায় চির। চিরবাসার আসাধারণ সুন্দর, সবুজ উপত্যকা, ভাগীরথীর বয়ে চলার শব্দ; সব মিলিয়ে যেন অপরূপ এক স্বর্গীয় সুষমা বিছিয়ে রেখেছে চতুর্দিকে।

চিরবাসা থেকে পাইন, ফার, জুনিপার, স্প্রুস প্রভৃতির মতো কনিফার বৃক্ষরাজির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলার পরে প্রকৃতি ক্রমশ পাল্টে যেতে লাগল। বৃহৎ বৃক্ষরাজির বদলে লতা-গুল্মের ঝোপ-ঝাড় বেশি করে চোখে পড়তে থাকল। বড় বড় পাথরখণ্ড এড়িয়ে পথ করে নিতে হচ্ছে।

চিরবাসার পথে।

আগের থেকে অনেক বেশি চড়াই পথে হাঁটছি। মাঝে মাঝে হাঁপ ধরে যাচ্ছে। একসময় পৌঁছালাম ভোজবাসা বা ভূজবাসায়। দেখলাম ভোজ বা ভূজ বৃক্ষ। প্রাচীণকালে এই গাছের পাতা (ভূর্জপত্র) লেখার জন্য ব্যবহৃত হত। একদিনে সবমিলিয়ে ১৮ কিলোমিটার পথ হাঁটা হয়েছে। পা-দুটো বিশ্রাম চাইছিল। ভূজবাসার উচ্চতা ১২৪০০ ফুট। ঠাণ্ডা আরও তীব্র। আজ ভূজবাসাতেই টেন্টে রাত্রিবাস। গরম গরম খাবার খেয়ে ঢুকে পড়লাম স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে।

গঙ্গোত্রী থেকে ভুজবাসার পথে।

সকালে উঠে দেখি রাতে পড়া শিশির জমে বরফে পরিণত হয়েছে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল যেন বরফের হালকা চাদরে ঢাকা পড়েছে। সকলের হাতে ধূমায়িত চা। তবে মুহূর্তে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে গরম চা। গাইডের তাড়ায় দ্রুত তৈরি হয়ে নিতে হল। ‘পথে এবার নামো সাথী’, গেয়ে উঠল এক সঙ্গী। আমরা পথে নামলাম।

কিছুটা এগিয়ে নদী। ভাগীরথী। ভয়ঙ্কর স্রোত। নদী পেরলাম হাতে টানা রোপওয়েতে চড়ে। এই পদ্ধতিতে নদী পারাপারে প্রধান অবলম্বন মনোবল। ভূজবাসা থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার হেঁটে আমরা গোমুখ হিমবাহের প্রান্তে এসে পৌঁছালাম। বিশ্ব-উষ্ণায়ণের জেরে এই হিমবাহ যে এখন বেশ ভঙ্গুর তা স্পষ্ট বোঝা যায়। হিমবাহের নানা অংশে সেই ভঙ্গুরতার চিহ্নগুলো প্রকট হয়ে রয়েছে। এখানে সেখানে বড় বড় ফাটল। প্রায় ৩০ কিলোমিটার লম্বা এবং ২ থেকে ৪ কিলোমিটার চওড়া এই হিমবাহ। বিশাল এই হিমবাহ গঙ্গায় জল সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

গোমুখের পথে

হিমবাহের সমান্তরালে হাঁটছি আমরা। কষ্টকর চড়াই পথ। কোথাও কোথাও ৬০ থেকে ৭৫ ডিগ্রি চড়াই পথ বেয়ে উঠতে হচ্ছে। প্রাণশক্তির সঙ্গে ইচ্ছেশক্তির পরীক্ষা নিচ্ছে কঠিন পথ। এভাবে পাঁচ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এলাম। সব কষ্টের শেষেই মনে হয় ভালো কিছু অপেক্ষা করে থাকে। আমরা দেখলাম গাড়োয়াল হিমালয়ের অপরূপ শিবলিং পর্বত। চোখ ফেরানো যায় না সেই সৌন্দর্য থেকে। মাউন্ট শিবলিং ছাড়াও এ পথে চোখে পড়বে সুদর্শন পর্বত, কেদার ডোম, মাউন্ট মেরু ও সুমেরু এবং মাউন্ট বাসুকী। আজ ১৭ অক্টোবর। আমরা তপোবন পৌঁছোলাম। শিবলিং পর্বতের পাদদেশে বিস্তৃত প্রান্তের মধ্যে আমাদের ক্যাম্প প্রস্তুত হল। এই ভূ-প্রান্তর কিন্তু ঘাসে ঢাকা নয়। পাথুরে জমি। কোথাও কোথাও অল্পসল্প ঘাসের দেখা পাওয়া যেতে পারে। প্রবল ঠান্ডা। জায়গাটার উচ্চতা ১৪৩০০ ফুট। রাতে অনেক সময়েই তাপমাত্রা নেমে যায় শূণ্য ডিগ্রির নীচে।

রাতে যথারীতি তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়েছিলাম। ঘুমিয়েও পড়েছিলাম প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। রাত তখন ক’টা কে জানে। পতপত শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। দেখি, ক্যাম্পের সমগ্র ঘেরাটোপ প্রবল কাঁপছে। বাইরে বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ। বুঝলাম ঝড় উঠেছে। একে রামে রক্ষে নেই, শুরু হল তুষারপাত। সবাই উঠে বসেছি। ঝড়ের তাণ্ডবের সঙ্গে প্রবল হতে থাকল তুষারপাতও। এরইমধ্যে আমাদের গাইড এসে অভয় দিয়ে গেল। ক্যাম্পের খুঁটিগুলোকেও ঠোকাঠুকি করে গেল। সত্যিই এঁদের কর্তব্যপরায়ণাতা দেখে অবাক হতে হয়। ঝড়ের বেগ খানিক কমতে আবার শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। সকালে উঠে আবাক কাণ্ড, ঝড়বৃষ্টির চিহ্ন নেই, আকাশ পরিষ্কার, ক্যাম্পের চারপাশে বরফের স্তূপ। রং ধরল শিবলিং শৃঙ্গে। ধীরে ধীরে সোনালী রোদ্দুরে ছেয়ে গেল চারপাশ। এক কথায় চমৎকার আবহাওয়া।

গোমুখ থেকে তপোবনের পথে।

১৮ অক্টোবর দিনটি আমরা তপোবনেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বিশ্রাম এবং একটু ঘুরেফিরে দেখার ইচ্ছে। পাঁচ কিলোমিটার ট্রেক করে আমরা কালাপাথথর নামের একটা জায়গায় গিয়েছিলাম।

তপোবনে মাউন্ট শিবলিং-এর পাদদেশে আমাদের ক্যাম্প।

এবার ফেরার পালা। তবে ফেরার পথেও আমরা তাড়াহুড়ো করিনি। ১৯ অক্টোবর তপোবন থেকে আমরা চলে এলাম চিরবাসায়। রাত্রিবাস হল চিরবাসাতেই, ক্যাম্পে। ২০ অক্টোবর চিরবাসা থেকে ৯ কিলোমিটার হেঁটে চলে এলাম গঙ্গোত্রী। ওইদিনই আমরা নেমে এলাম হরশিলে। দু-দিন ছিলাম হরশিলে। উত্তরাখণ্ড-হিমাচল সীমান্তে হরশিলের অবস্থান। মাঝে রয়েছে একটা পাহাড়। ২১ তারিখেও আমরা হরশিলে। হরশিলের একটি চিত্র মাঝে মাঝেই আমার মনে ভেসে ওঠে। হরশিলের হোটেলের টয়লেটে ঢুকেছি। টয়লেটের জানলায় প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ফলন্ত আপেল গাছের ডাল। ওই জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে পেড়ে নেওয়া যায় পাকা আপেল। হাত নিশপিশ করছিল গোটা দুয়েক আপেল ছিড়ে নেওয়ার জন্য। শেষপর্যন্ত নিরস্ত করেছিলাম হাত দুটোকে।

২২ অক্টোবর আমাদের গন্তব্য উত্তরকাশী। পথে বিপত্তি। বিশাল এক গাছ উপড়ে পড়েছে। সেনাবাহিনী থেকে গাছ কেটে রাস্তা পরিষ্কার করা হল। সময় লেগে গেল প্রায় চার ঘন্টা। তবে সময় নষ্ট হচ্ছে বলে মনে হয়নি। রাস্তার ধারে বসে ভাগীরথীর প্রবাহ দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে সময় কেটে গেল। এ দিনটা ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে উত্তরকাশীর পথে পথে ঘুরে বেড়ালাম।

২৩ তারিখ চলে এলাম দেরাদুন। রাতের উপাসনা এক্সপ্রেসে গৃহপানে যাত্রা। শিবলিং পর্বত, হিমবাহ, তুষারপাত, ভাগীরথীর প্রবাহ, আপেল বাগান, সব চলমান ছবির মতো ভেসে বেড়াতে লাগল বন্ধ চোখের সামনে। ট্রেন চলতে থাকল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *