Follow us

মুসকো ভ্যালি, আড়ালে থাকা এক স্বর্গ

মুসকো ভ্যালি, আড়ালে থাকা এক স্বর্গ

প্রত্যেক সাবেক কলকাতাবাসীর বাড়িতেই একজন বাঁধা কাশ্মীরি শালওয়ালা থাকেন। অনলাইন শপিংয়ের যুগে তাদের সে রমরমা নেই বটে, তবে এখনও শীতের আগে আগে তাঁদের দেখা যায় পাড়ায় পাড়ায়। আমাদের বাড়িতেও ছিলেন একজন। নাম ইউসুফ চাচা। আমি জন্ম থেকে দেখে এসেছি মানুষটিকে। মা-পিসিমাদের সঙ্গে ছিল ওনার কারবার।

আমি তখন সবে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছি। সেবার চাচা এসে আমার হাতে ঝোলা থেকে আখরোট বের করে দিয়ে একটা ছবি দেখিয়েছিলেন। গাঢ় নীল আকাশ, দূরে লাইন করে একদল সোনালী পাহাড়, তার তলদেশ থেকে টানা ঘন সবুজ সমতল জমি, তার ঠিক মাঝ বরাবর একটা নদী বয়ে গেছে। সেদিন প্রায় ঘন্টাখানেক ছিলেন ইউসুফ চাচা। আর ওই একঘন্টা ধরে আমি শুধু ছবিটার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।

ব্যাস, সব চটকে গেল আমার। যেতেই হবে আমায় ছবির ওই জায়গাটায়। পরের একবছর পয়সা খরচ করে বাইরে টিফিন খাইনি, একটাও সিনেমা দেখিনি, খেলা দেখেছি রাম্পার্টে দাঁড়িয়ে, নেমন্তন্ন বাড়িতে গিফট না দিয়ে খেয়ে এসেছি, কিশোরকুমারের ফাংশন দেখিনি, আরো এমন অনেক কিছু করিনি। শুধু ঐ জায়গাটায় যাবো বলে। পয়সা জমাতে হবে যে।

পরের বছর যেদিন প্রথম এলেন ইউসুফ চাচা, সেদিনই ওনার হাতে হাজার দেড়েক টাকা তুলে দিয়ে জানিয়ে দিলাম, আমি যাব ওনার সঙ্গে, ওনার ওই ছবির দেশে। “আরে তবা তবা, রাক্খো রাক্খো আপনা প্যায়সা। যব হাম ওয়াপস যায়েঙ্গে তব তুম ভি যাওগে মেরে সাথ, ইয়ে ওয়াদা রাহা বেটা, ঔর ওহ জাগা তো মেরা সসুরাল হ্যায়। তুম বিলকুল নিশ্চিন্ত রহো। এক সাথহি যায়েঙ্গে।”

মার্চ মাসের শেষে ইউসুফ চাচার দলবলের সঙ্গে আমিও উঠে পড়লাম ট্রেনে। কলকাতা থেকে বেরিয়ে প্রায় পাঁচদিন পর পৌঁছলাম ইউসুফ চাচার গ্রামের বাড়িতে। চাচার পাঁচ ছেলেমেয়ের সঙ্গে আড্ডা মেরে, খেলে বেড়িয়ে, এদিক ওদিক ঘুরে আরো পাঁচ-ছ’টা দিন ঝড়ের মতো কেটে গেলো।

তারপর চাচার সঙ্গে চললাম তাঁর শ্বশুরবাড়ির গ্রামে। গেলাম, দেখলাম, আর মনটা ফেলে এলাম ওইখানেই। পথে অবিশ্বাস্য সুন্দর সোনামার্গ, ভয়ঙ্কর সুন্দর জোজিলা পার হলাম। ‘ম্যাকানাস গোল্ড’ সিনেমার কথা মনে পড়েছিল। দ্রাসে এসে রাতে থাকলাম। ভূগোল বইতে পড়েছি এতদিন। আজ মালুম পেলাম ঠান্ডা কাকে বলে! সন্ধ্যের পর থেকে দাঁতের ঠকঠকানি বন্ধ হচ্ছিল না।

এরপর পৌঁছলাম চাচার শ্বশুরবাড়িতে। এলাহি খাওয়াদাওয়া আর খাতিরদারি। পরিচয় হলো সুরু নদীর সঙ্গে, আর প্রথম দর্শনেই এই নদীর প্রেমে পড়লাম। তখন থেকেই লাদাখকে ভালোবেসে ফেলা। আর এখন তো সেটা গভীর প্রেমে পরিণত হয়েছে।

১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের আগে এই ভূভারতের তেমন কেউ জানতো না মুসকোহ বা মুসকো ভ্যালির কথা। যুদ্ধের সময় কাগজে টিভিতে ছবি দেখে চমকে উঠেছিলাম। আরে, এ তো সেই জায়গা! ইউসুফ চাচার শ্বশুরবাড়ি। ফোন করেছিলাম চাচাকে। জানালেন, “আর্মির লোকজন গোটা গ্রাম খালি করে সবাইকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেছে।”

সেই ভারত-পাক যুদ্ধের শেষে ২০০৩ থেকে ইন্ডিয়ান টুরিজম আর আর্মির যৌথ উদ্যোগে মুসকো ভ্যালি খুলে দেওয়া হয় পর্যটকদের জন্য।

কাশ্মীর আর লাদাখের রূপবৈচিত্র যে বিস্মিত করার মতো, সে-কথা নতুন করে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এখনো বেশ কিছু লুকোনো রূপের সিন্দুক আছে। সেই রুপরত্নের একটি হল এই মুসকো ভ্যালি।

মুসকো ভ্যালি। ফটো: লেখক

মুসকো ভ্যালিঃ কয়েকটি তথ্য

দ্রাসের অবস্থান লাদাখের কার্গিল জেলায়। দ্রাসকে লাদাখের প্রবেশদ্বার বলা হয়। মনুষ্য বসতি রয়েছে, বিশ্বের এমন শীতল অঞ্চলগুলির মধ্যে লাদাখের স্থান দ্বিতীয়। প্রথম স্থানটি রাশিয়ার ওইমইয়াকনের। দ্রাসের গড় উচ্চতা ১০,৮০০ ফুট। শীতে এখানকার গড় তাপমাত্রা মাইনাস ১২ ডিগ্রি। কখনো কখনো তাপমাত্রা নেমে আসে মাইনাস ১৭-১৮ ডিগ্রিতে। দ্রাসে প্রধাণত বাল্টিক ও দার্দিক উপজাতীয় মানুষের বসবাস। শ্রীনগর থেকে দ্রাসের দূরত্ব ১৪১ কিলোমিটার। সোনমার্গ থেকে দ্রাস ৬৩ কিলোমিটার, লাদাখ থেকে ৬০ কিলোমিটার। কাছেই জোজিলা পাস। মে থেকে সেপ্টেম্বর দ্রাস বেড়ানোর উপযুক্ত সময়।

দ্রাস। ফটো সৌজন্য: ইন্ডিয়া টিভি নিউজ।

 

দ্রাস। আরেক রূপে। ফটো সৌজন্য: এনজয় লে লাদাখ।

মুসকো ভ্যালি দ্রাস অঞ্চলের অন্তর্গত ১১,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এক অপরূপ উপত্যকা। উত্তুঙ্গ সব পর্বতে ঘেরা মুসকো ভ্যালি গ্রীষ্মে, বর্ষায় বুনো ফুলে ছেয়ে থাকে। মুসকো ‘বুনো টিউলিপের উপত্যকা’ বলেও পরিচিত। ১৯৯৯ সালে এই ফুলের উপত্যকাকে পায়ে পিষে পাকিস্তানের সেনারা ঢুকে পড়েছিল ভারতে। শুরু হয়েছিল আরেকটি ভারত-পাক যুদ্ধ, যা কার্গিল যুদ্ধ নামে পরিচিত।

দ্রাসের প্রধান বাজার এলাকা থেকে মুসকো ভ্যালি ৮ কিলোমিটার। সেখানে গিয়ে পড়া মানে বিস্ময়কর সৌন্দর্যের অন্দরমহলে প্রবেশ করা। সেই সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গত করছে উপত্যকার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত দ্রাস নদীটি।

চাষ-আবাদ ও পশুপালন এখানকার মানুষের প্রধান জীবীকা। পাকিস্তান সীমান্ত-ঘেঁষা পাহাড়, উপত্যকা, ফুল, নদীর সেই অচিন দেশে বসবাস করেন যাঁরা, তাঁদের জীবনযাপনের নানা ছবি চাক্ষুষ করাও মস্ত এক প্রাপ্তি।

দ্রাসে এখন অনেক হোটেল। থাকার অসুবিধ নেই।

কার্গিল শহর। ফটো সৌজন্য: গ্রেটার কাশ্মীর।

হেডার ফটো সৌজন্যঃ ট্র্যাভেল দি হিমালয়াস।

লেখকের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বরঃ ৮৯১০১ ৫৩০১৬।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *