(শেষ পর্ব)
তপোবনের প্রান্তর থেকে শিবলিং আর মেরু পর্বত
….কিছুক্ষণ ধরে কানে একটা ধাতব সুরেলা শব্দ আসছিলো। ঘুমটা ভাঙতেই বুঝলাম ঘন্টা বাজছে। খুব পরিচিত একটা চন্দন ধুপের গন্ধও নাকে এলো। মুশকিল হলো, চোখ খুললে আমি আর মটকা মেরে পড়ে থাকতে পারি না। উঠে পড়লাম। জ্যাকেটের ওপর সালটা জড়িয়ে বাইরে এলাম। অন্ধকার। জম্পেশ ঠান্ডা। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। ঠিক গঙ্গোত্রি হিমবাহের ধারে এসে দাঁড়ালাম। ভাগীরথী রেঞ্জের দিকে তাকিয়ে আটকে গেলো চোখ। টকটকে সিঁদুরে লাল হয়ে গেছে ভাগীরথী। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন, ভাগীরথীর মাঝখানে বড় প্রদীপ দাঁড় করিয়ে রাখলে যেমন দেখতে লাগে ঠিক তেমন শেপ। বাঁদিকে নন্দনবনের পাশে রক্তবর্ণ গ্লেসিয়ার সত্যিই রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। পাশে চতুরঙ্গী গ্লেসিয়ারও সাজো সাজো হয়ে উঠছে ।
এই চতুরঙ্গী-র সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। আমার প্রেমিকাদের লিস্টে একদম ওপরের দিকে আছে চতুরঙ্গী। সে কথা পরে কখনো সময় করে বলবোখুনি। সামনে গঙ্গোত্রি হিমবাহ সর্পিল শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে আছে।এবার তপোবনের দিকে ফিরে তাকিয়ে আর চোখ সরছে না আমার। শিবলিঙ্গের প্রায় ত্রিভুজাকৃতি মাথার ধারগুলো যেন গলানো সোনা। চোখ ঝলসে যাচ্ছে। আরে, ওটা কি! শিবলিঙ্গের বাঁদিকের রিজের ওপর কি যেন আছে, এত দূর থেকে বুঝতে পারছি না। আস্তে আস্তে নরম আলো এসে পড়লো রিজের ওপর। আরে, এ তো এক পাল কস্তুরী মৃগ। আগেও দেখেছি অনেকবার, কিন্তু এতগুলো একসাথে দেখিনি। পাশ থেকে সাটারের শব্দ পেয়ে তাকিয়ে দেখি রামুবাবু ইন অ্যাকশন। পাশে নিমাই। ইসারায় কথা বলতে বারন করলাম। শুধু চোখ খোলা রেখে মন ক্যামেরায় ছবি তুলে রাখো। আরো কিছুক্ষণ কাটিয়ে পুরো আলো ফুটে যাবার পর ফিরে এলাম আশ্রমে।
সবাই চায়ের কাপ হাতে বসে বসে আড্ডা মারছে আর বাবা ছিলিম সাজছে। আমায় দেখে বললো..কি রে, আগুনলাগা দেখে এলি?.. হুম, তুমি এটা কি করছো?.. প্রসাদ বানাচ্ছি বাবা। … কি বানাচ্ছো, পাতা না গুলি?.. দুটো মিশিয়ে রে। খাবি তো? ..আগে চা খেয়ে আসি, বলে ভেতরে গিয়ে মা কে বললাম, চা জুটবে একটু? এই যে বাবা, বলে প্রায় এক মগ চা ধরিয়ে দিলেন হাতে। অর্ধেকও খাইনি, ফাটা বাঁশ চেল্লাতে শুরু করেছে, কি রে, কোথায় গেলি বাবা! আরে, আমি তো বসেই আছি রে। আয় বাপ আমার। মালটা তো বহুত জ্বালাচ্ছে! বললাম, কে বসে থাকতে মাথার দিব্বি দিয়েছে, খাও না তুমি।.. না রে বাবা, তুই ধরিয়ে প্রসাদ করে দে না রে।.. মনে মনে বললাম বহুত ভড়ংবাজি জানো তুমি বাবা। কলকেটা নিয়ে ধরালাম। দু তিনটে টান মারতেই বলে উঠলো, ওরে থাম থাম, যা ফুক মারছিস তাতে তো আমার কপালে ছাই ছাড়া কিছুই জুটবে বলে মনে হয় না রে। ধুর, ছিলিমটা ধরিয়ে দিয়ে আবার বেরিয়ে গেলাম আশ্রমের বাইরে।
এখন রোদে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। ঝকঝক করছে সব। উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করতে করতে শিবলিঙ্গের বরফ গলা জল থেকে যে ছোট্ট নদীটা নালার মত বয়ে চলেছে তার পাশে যেতেই দেখি বাঙ্গালি মা মাথার ওপর লোহার বালতিটাকে মুগুরের মত ঘোরাচ্ছে। তারপর ওই বালতি জোরে নালায় জমে যাওয়া বরফের ওপর আছড়ে মেরে জল বের করে সেই জল বালতিতে ভরে নিজের মাথায় ঢালছেন। সরে এলাম ওখান থেকে। খানিকক্ষণ নিজের মনে ঘুরে আবার ফিরে গেলাম আশ্রমে। খিদে পাচ্ছে। ফিরে এসে দেখি মায়ের পুজো হয়ে গেছে। প্রথমে ফল প্রসাদ আর তারপর পরোটা কড়াইশুঁটি দিয়ে আলুরদম আর হালুয়া। চার পাঁচটা পরোটা মেরে দিলাম। খেতে খেতে বাবাকে বললাম, সারাটা দিন করবোটা কি? নতুন কিছু একটা বলো দেখি! বাবা সামনের প্রান্তরটার শেষে শিবলিঙ্গের যে রিজ-ওয়ালটা রয়েছে তার মাথাটা দেখিয়ে বললো, ওর ওপারে আকাশদীপ সরোবর আছে। যেখানে রোজ শিব-পার্বতী স্নান করেন। যা দেখে আয়, মন ভরে যাবে। দাদু আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, কি বলছে রে, ঢপ মারছে না তো! তো!। চল না, দেখা যাবে, আর যদি ঢপ হয় তো ফিরে সবাই মিলে ক্যালাবো আজ ফাটা বাঁশকে।
চললাম সবাই সে দিকে। সামনের প্রান্তরটা বেশ বড়। প্রায় আধঘণ্টা লাগলো পেরিয়ে আসতে। সামনে এসে দেখি পুরো ওয়ালটাই স্ক্রি ভর্তি। মানে ঝুরো মাটি, বালি আর ছোট ছোট নুড়ি পাথরের তৈরি। ফলে দু-পা উঠলে হড়কে তিন-পা নেমে আসতে হয়। শুরু করলাম দুগ্গা বলে। প্রায় চল্লিশ মিনিট কসরতের পর আমি আর নূপুর রিজের মাথায় উঠে এলাম। বাকিরা মাঝপথে হ্যাচরপ্যাচর করছে। প্রায় ছশো ফুট ওপরে এখন আমরা তপোবন থেকে। কী দেখছি জানিনা বুঝিয়ে বলতে পারবো কি না। ওপারে ভাগীরথী রেঞ্জ ঝকঝক করছে। নীচে নন্দনবনের পুরো প্রান্তরটা দেখা যাচ্ছে। চতুরঙ্গী আর রক্তবর্ণ হিমবাহ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়। মাঝে গঙ্গোত্রি হিমবাহের অনেকটা দেখা যাচ্ছে। কি যে ভয়ঙ্কর সুন্দর কি বলবো। তাকিয়ে থাকলে গা-টা কেমন শির শির করে, কিন্তু না তাকিয়েও থাকা যায় না। তপোবনের মাঠ দূর অবধি হলুদ ঘাসে ভরা। অসাধারণ লাগছে এখানে থেকে। আর রিজের ওপারে ছোট, মাঝারি, বড় ও বিশাল সব বোল্ডারের সমুদ্র। তেমন একটা বোল্ডারে পা ছড়িয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছিলাম আমি। একে একে বাকিরা এসে পড়েছে। এবার বোল্ডার টপকে টপকে সামনে কিছুটা এগিয়ে পুরো “থ” হয়ে গেলাম। সামনে পান্না সবুজ রঙের মাঝারি এক সরোবর। চারিদিকে বোল্ডারের রাজত্বের ভেতর। সরোবরে বরফের ছোট বড় চাঁই ভাসছে। পিছনে আর বাঁদিকে উত্তুঙ্গ পর্বত শিখর। সত্যি এমন জায়গা না হলে শিব-পার্বতীর স্নান হবে কি করে। প্রথম পাঁচ মিনিট কেউ কোন কথা বলিনি। যাকে বলে স্পেলবাউন্ড অবস্থা। তারপর রামু, মনু আর নিমাইয়ের ক্যামেরা চলতেই থাকলো। নূপুর হাঁটু অবধি জলে নেমে জপ করলো বোধহয়। তারপর আঁচলা করে পেট ভরে জল খেলো। প্রায় ঘন্টা খানেক কাটিয়ে এবার ফেরার পথে পা বাড়ালাম। আর মনে মনে বাবাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালাম। এবার এখান থেকে নামাটা অনেক কঠিন। রামু আর রানা বেশ ভয় পেয়ে আছে। আম নূপুরকে বললাম, তুই রানাকে নিয়ে নাম, আমি রামুকে দেখে নিচ্ছি। রামুকে বললাম, যদি ভয় করে তো চোখ বন্ধ করে থাকবি। আর আমি যেমন বলবো তেমন পা বাড়াবি। রামু বলল, এখন আর ভয় নেই, তুমি সঙ্গে থাকলে কোনও ভয় থাকে না। মিনিট সাতেকে আমি আর রামু নীচে পৌঁছে গেলাম। বাকিরাও একে একে চলে এলো। সবাই আশ্রমের দিকে পা বাড়ালাম। আজকের সকালটা মনে থাকবে আজীবন।

তপোবনে বাঙালি বাবার আশ্রম। এই ছবিটা আমার প্রাণের বন্ধু ও দাদা শঙ্কর ব্যানার্জির তোলা–লেখক
সামনের তপোবনের প্রান্তর পেরিয়ে বাঙালি বাবার আশ্রমে ফিরতে ফিরতে ভাবছি শুধু, কি দেখলাম একটু আগে! গোটা শরীর মন কেমন যেন ভারশূন্য লাগছে। সাংসারিক সমস্ত বিষয়ে আর যেন কোনও আসক্তি নেই।
কি রে, কেমন লাগলো? ফাটা বাঁশ চেঁচিয়ে জিগ্যেস করলো। সবাই তো লাফিয়ে উঠে বলতে লাগলো যার যার মত করে। আমি বাবাকে বললাম, প্রণাম ট্রনাম আমার আসে না। কাউকে প্রণাম করি না আমি। আলিঙ্গনও চট করে কাউকে করি না। আজ তোমায় একটা আলিঙ্গন করবো একটা অসাধারন সকাল আমায় উপহার দিয়েছ বলে। কথা শেষ হলো কি হলো না, বাবা আমায় নিজেই জড়িয়ে ধরলো।.. যা যা, আর দেরি করিসনি। সন্ধ্যাবেলায় আবার পুজো আছে। এতক্ষণ তোদের মা ভোগ রান্না করেছে। আজ দুপুরে যা হোক একটু মানিয়ে নে বাবা। রাতে খুব ভালো খাওয়াবো আজ। একটু হেসে ভেতরে এলাম। হাত ধুয়ে বসে গেলাম খেতে। পরোটা, আলু চচ্চরি, টোম্যাটো চাটনি, হালুয়া। এটা নাকি মানিয়ে নেওয়া! আরে আমার চোদ্দোগুস্টির কেউ ভেবেছে তপোবনে বসে এমন খাবার জুটবে! রাতে ভালো খাওয়াবে বললো। বুঝতেই পারছি এলাহি আয়োজন হয়েছে। বেলা তিনটে নাগাদ মা আবার সেই লোহার বালতি হাতে বেরিয়ে গেলেন চান করতে। কি করে যে রোজ এই কাজটা করেন একমাত্র উনিই জানেন! আমরা প্যান্টের পকেট থেকে হাত বার করতে পারছি না, আর উনি গেলেন বরফ ভাঙা জলে চান করতে। উনি বেরিয়ে যেতেই ফাটা বাঁশ ডাক দিলো, ও অমল, বাবা এদিকে আয় একবার। উফ, জ্বালিয়ে মারছে তো! গেলাম, বললো, বানাবো নাকি এক ছিলিম? বললাম, বানাও, আমি না বললে যেন বানাবে না! তুই যদি খাস তো বানাবো, না হলে একটা সাদা লাঠি নেবো তোর থেকে। একটা সিগারেট দিলাম বের করে, নিজেও একটা ধরালাম। আজ সাতটা থেকে সাড়ে আটটা তোরা আমার সাথে থাকবি। একটা অদ্ভুত জিনিস যদি দেখতে চাস তো। মাথা নেড়ে থাকবো বললাম।
গুহার বাইরে পাথরের রকটায় রোদ রয়েছে। বসলাম প্রথমে, তারপর ভেতর থেকে ম্যাট্রেসটা নিয়ে এসে পেতে উপুড় হয়ে শুলাম। রোদের কম্বল গায়ে দিয়ে চোখ বুজে আছি আরামে। মনে হচ্ছে কেউ যেন হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পরম যত্নে সারা গায়ে। সাড়ে চারটেয় চা এলো, সঙ্গে আমার আনা উজ্জ্বলার চানাচুর। নাঃ, আর বাড়ি ফেরার ইচ্ছেই নেই। এখানেই থেকে যাবো ভাবছি। একটু পরেই পাঁচালি পড়তে শুনলাম মায়ের গলায়। আস্তে আস্তে আলো পড়ে আসছে। নরম সোনালী আলো ঢেউ খেলে গেছে গোটা অঞ্চলটায়। বাবাকে বললাম,আমি একটু ঘুরে আসছি। কেউ খোঁজ করলে বলো তুমি জানো না, কেমন। কিছু না বলে ছোপ ধরা দাঁত বার করে হাসলো শুধু। আমি বেরিয়ে গেলাম।
গঙ্গোত্রি হিমবাহের ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকখানি চলে এসে একটা বড় পাথরের ওপর বসলাম। রোদের রং সোনালী থেকে গোলাপী হয়ে গেছে ততক্ষণে। আমার ঠিক এক ফুটের মধ্যেই ভয়ঙ্কর সুন্দর গঙ্গোত্রি হিমবাহ। কি যে তার রূপ তা কি করে বোঝাই। একই অঙ্গে এতো রূপ দেখিনি তো আগে। বাঁদিকে কোনাকুনি উল্টোদিকে ভাগীরথী রেন্জ। তাকিয়ে থাকলেই মনে হয়, ডাকছে যেন। গোটা আকাশটা অদ্ভুত ইন্ডিগো ব্লু রঙের। শুধু ভাগীরথীর মাথার কাছে ছোট্ট এক টুকরো কুন্ডলি পাকানো হাল্কা লাল রঙের মেঘ যেন আরো সুন্দর করে তুলেছে সমগ্র দৃশ্যপটকে। ঠিক যেন মেক আপ আর্টিস্টের শেষ তুলির টান দিয়েছে কেউ। আর ডানদিকে গঙ্গোত্রি হিমবাহ অনেকটা এঁকেবেঁকে গিয়ে ঘুরে গেছে চৌখাম্বার দিকে। তপোবনের গোটা প্রান্তর এখন লালচে সোনালী রঙের। শিবলিঙ্গের লালচে মাথার পাশে বিশাল বড় চাঁদ উঁকি মারতে শুরু করেছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেছে আমার। মাত্র পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যেই কত রঙের খেলা যে দেখলাম কি বলবো! সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে। আর বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো মনটা। হয়তো বাবার থেকেই জেনেটিকালি পাগলামোটা এসেছে আমার মধ্যে এটা ভেবে। এখন প্রায়ই খুব মিস করি বাবাকে। আমার কথাগুলো আমার অনুভূতিগুলো কাকে বলবো আমি! বলতে গিয়ে দেখেছি হয় লোকে প্রচন্ড বোর হয় আর না হলে পাগল ভাবে আমায়। বাবা, তুমি কি বুজতে পারো আমার কথা? দেখতে পাও আমায় তুমি?
অন্ধকার নেমে আসছে খুব দ্রুত। উঠে পড়লাম। যত তাড়াতাড়ি অন্ধকার নামছে তার থেকে অনেক তাড়াতাড়ি পারদ নামছে পাল্লা দিয়ে। এবার একটা সিগারেট ধরিয়ে আশ্রমের দিকে চলতে শুরু করলাম টর্চ জ্বালিয়ে। তপোবনের যেখান থেকে হিমবাহ পেরিয়ে নন্দনবন যেতে হয় ঠিক সেখানে আসতেই একটা শব্দ পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। কান পেতে রয়েছি আবার শোনার অপেক্ষায়। হ্যাঁ, একটা গোঙানি শুনতে পাচ্ছি। চেঁচিয়ে বললাম,কঈ হ্যায় ইঁহা?.. ইয়েস, হেল্প মি প্লিজ.. আওয়াজটা গ্লেসিয়ারের ভেতর থেকে আসছে। কি করি! আবার চেঁচিয়ে বললাম, হোল্ড অন। আই এ্যম কামিং উইদিন ফাইভ মিনিটস। বলে এক দৌড়ে আশ্রমে চলে এসে নিমাইকে ডাকলাম। বললাম, বড় রোপ আর দুটো আইস অ্যাক্স নিয়ে চল আমার সঙ্গে। বাবা শুনে বললো, দাঁড়া দাঁড়া বাবা আমার, তারপর রামমমম বলে চিৎকার করলো। রাম এসে হাজির। বললো, রাম যেমন বলবে তেমন করবি তোরা। এই হিমবাহের প্রতিটি ইঞ্চি চেনে ও। বেরিয়ে গেলাম রামকে সঙ্গে নিয়ে। তাড়াতাড়ি পৌঁছে আওয়াজ দিলাম মুখে। ওপাশ থেকে কাতর শব্দ ভেসে এলো, প্লিজ হেল্প মি আউট। এবার নিমাইকে দু হাতে দুটো বড় টর্চ জ্বেলে রাখতে বলে রোপ নিয়ে আমি আর রাম শব্দ অনুসরণ করে নেমে গেলাম গ্লেসিয়ারের ওপর। বারো চোদ্দো ফুট যাবার পরেই রাম ডাক দিলো, ওমলদা, ইধার মে আ যাও।.. তারপরেই শুনলাম কাকে যেন বলছে হিন্দিতে.. ফির আ গ্যায়ে হো মরনে কে লিয়ে! ওউর কিতনে বার কৌসিস করোগে তুম মরনে কা! এগিয়ে গিয়ে দেখি একটা ক্রিভাসের মধ্যে এক বিদেশী ঝুলছে। একটা হাত দিয়ে একদিকের বরফের ফাটল আঁকরে ধরে আছে আর একদিকে পিঠের রুকস্যাকটা আটকে আছে। স্যাকটাই বাঁচিয়ে দিয়েছে ওকে। তাড়াতাড়ি ওকে তুলে নিলাম ওপরে। যত সহজে বললাম ব্যাপারটা অতটা সহজ নয় মোটেই। ঘাম বেরিয়ে গেছে আমার আর রামের। নিমাই শুধু টর্চ ধরেই টেনশনে ঘেমে গেছে। প্রায় সাত ফুট হাইট মানুষটার। চেক প্রজাতন্ত্রের লোক। প্রায় দুশো বার ‘ থ্যাংকস’ বললো। নিয়ে এলাম আশ্রমে। বাবা ওকে দেখেই এই মারে তো সেই মারে! পরে শুনলাম প্রায় মাস খানেক আগে এখানে এসে দিন পনেরো ছিলো। রোজ এই পাহাড় ঐ গ্লেসিয়ার করে বেড়াতো। দুবার ক্রিভাসে পড়ে মরতে মরতে বেঁচেছে। দিন দশেক আগে বাঙালি বাবা ভাগিয়ে দিয়েছিলো। আজ আবার ফিরে এসেছে। সব শুনে হাসবো না কাঁদবো! যাই হোক ওকে চার পাঁচটা কম্বলে মুড়িয়ে শুইয়ে দিলাম। আর একজগ গরম চা দিলাম খেতে। আবার থ্যাংকস শুনলাম।
একগাদা ফল, নারকোল নাড়ু আর মালপোয়া প্রসাদ এলো। চোখের পলক পড়তে না পড়তে নেই কিচ্ছু, প্লেট ফাঁকা। সাতটা বাজে প্রায়। বাইরে এলাম। চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে, জ্বলজ্বল করছে শিবলিং। এ দৃশ্য যে দেখেনি সে বুঝবে না যতই বোঝাই না কেন। বসে আছি রকের ওপর, চাদরটা জড়িয়ে। কেমন একটা ঘোর লেগে আছে। একটু পরে আস্তে আস্তে বাকি সবাইকে নিয়ে বাবা বাইরে এসে লাইন দিয়ে বসলো। বললো কেউ যেন কোনোও রকম শব্দ না করে। আরো একটু পরে মা-কে দেখলাম দু হাতে দুটো পাত্র নিয়ে সামনের মাঠে রেখে এলেন। বাবা ওই দিকে ইসারা করলেন। তাকিয়ে আছি সবাই। মিনিট পনেরো পর প্রথমে একটা শিয়ালের মত দেখতে প্রাণী এলো তার ঠিক পরেই একটা বেশ বড় সাইজের সাপ এলো। দুজনেই নিজের নিজের পাত্র থেকে কি সব খেল প্রায় সাত আট মিনিট ধরে। তারপর আগে সাপটা চলে গেলো। তারপরেই শিয়ালের মত দেখতে প্রাণীটা আস্তে আস্তে চলে গেলো। অনেকক্ষণ পরে এরা রোজ আসে কিনা জানতে চাইলাম। না রে, শুধু পূর্ণিমার দিনে আসে প্রতিমাসে। কী বলবো, এমনও হয়! ঠান্ডা ক্রমশই বাড়ছে। একে একে সব ভিতরে চলে গেলো। আমি বসে আছি একা। আর ভাবছি। কি অদ্ভুত একটা দিন কাটলো আজ আমার জীবনে! ঘটনাবহুল, চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভাবছিলাম যে আমার যা যোগ্যতা তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছি আমি। সত্যিই তো এতো কিছু তো পাবার কথা নয় আমার। আরে আমি তো নিজে জানি আমি কি মাল। তাও! কি করে! প্রকৃতির অসীম করুনা আমার ওপর। না হলে এ তো হবার কথা নয়। প্রকৃতিকে কি থ্যাঙ্কস দেওয়া যায়? জানি না আমি। আমার একমাত্র উপাস্য হলো প্রকৃতি। আর কোনো কিছুতে বিশ্বাস করি না আমি। তাই তো বেশিদিন থাকতে পারি না কলকাতায়। বার বার ছুটে আসতে হয়।
..ওরে ভেতরে আয় বাবা অমল। ঠান্ডা লাগাসনি রে, আবার ফাটা বাঁশের গলা। একটু শান্তি দেবে না লোকটা! ভেতরে চলে এলাম। বাবা মায়ের খাওয়া হয়েছে? মাথা নেড়ে না বলতেই আমি উঠে গেলাম ভেতরে মায়ের ঘরের বাইরে। মা বলে ডাকলাম। বোধহয় শুয়েছিলেন। বলো বাবা। আপনি এখনো উপোস ভাঙেননি! আমার সামনে এখুনি যদি খেতে না বসেন তো আমরা কেউ কিছু খাবো না আজ বলে দিলাম। তোমাদের না খাইয়ে আমি কি করে খাই বাবা বলো?.. ওসব জানিনা। আপনাকে এখুনি খেতে হবে ব্যাস। অন্য দিন হলে বলতাম না মা। আজ আপনি উপোসি আর পরিশ্রান্ত। আজ কোনও কথা শুনবো না। আপনি আগে খাবেন, তবে আমরা খাবো। ..দ্যাখো পাগলের কান্ড.. বাবা উঠে এসেছে। বললো, খেয়ে নাও তুমি। আজ বড় শক্ত জায়গায় পড়েছো গো। আজ আর ছাড় পাবে না।
সামনে বসিয়ে খাওয়ালাম ওনাকে। তারপর বললাম, শুয়ে পড়ুন আপনি মা। আমরা বাবাকে খাইয়ে দেবো ঠিক।
এবার শুরু হলো আড্ডা। এই করতে করতে বাবা বললো কেউ একটা গান গা না বাবা। তাপসের গলা বেশ ভালো। তাপস গাইলো ‘তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করো…’ । অপূর্ব…
এবার আমায় ধরেছে বাবা গাইবার জন্য। মেরেছে রে। বললাম, হিন্দি ছাড়া তো জানিনা কিছু বাবা। খাইকে পান চলবে? কি বুঝলো জানিনা, বললো.. সব চলবে, গা বাবা তুই, গাইলাম আমিও খান দুয়েক কিশোর কুমারের বাংলা গান। রাত প্রায় দশটা। খেতে বসে চক্ষু চড়কগাছ। লুচি, ছোলার ডাল নারকোল দিয়ে, আলু ফুলকপির ডালনা, ছানার তরকারি, আমস্বত্তের চাটনি, সুজির পায়েস। এই হলো কপাল.. কয়েকদিন আগে আমার ফেসবুকের এক নতুন বন্ধু বলেছেন আমার নাকি দারুণ কপাল বেড়ানোর ব্যাপারে। আমি বলছি, কপালের জোর তো আছেই। কিন্তু সেটা খাওয়ার। তপোবনে বসে লক্ষ্মীপুজোর দিনে এমন ভোগ ক’জন আজ ওবধি খেয়েছে শুনি?
এগারোটা বেজে গেলো শুতে শুতে। একটু আগে সিগারেট খেতে বাইরে গিয়েছিলাম। গোটা তপোবনে আলোর বন্যা বইছে।
শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম আবার একই কথা। অনেক বেশি পেয়েছি। আমি যা চেয়েছি তার থেকে কয়েক হাজার গুন বেশি। বিশ্বাস করো, আর কিচ্ছু চাইবার নেই। ভরিয়ে দিয়েছো আমায় তুমি… ধীরে ধীরে শুয়ে পরলাম চতুরঙ্গী হিমবাহের ওপরেই। ঠাণ্ডা, ভিষণ ঠাণ্ডা, কিন্তু কি অপার শান্তি… নাও না আমায় তোমার করে…
আজই তপোবনে আমাদের শেষ দিন। ঘুম ভাঙার পর থেকেই মনটা ভালো নেই। আটটা নাগাদ জলখাবার খেয়ে বাইরে বেরনোর মুখে বাঙালি বাবা বললো, একটু কথা আছে বাবা তোদের সাথে। কথা দে, আমার কথা ফেলবি না। বললাম, আগে শুনি তোমার কথা, তারপর তো ঠিক করবো ফেলবো না তুলে রাখবো, বলে ফেলো, শুনি। দ্যাখ বাবা, কত কষ্ট করে থাকি এখানে সে তো তোরা দেখলি। শীতের ছ’মাস নীচে নেমে যাই, কিন্তু আমাদের স্থায়ী কোন জায়গা নেই। আজ এখানে কাল ওখানে করে কাটে। আমি জানি, লালবাবাকে তোরাই কলকাতায় একটা আস্তানা করে দিয়েছিস। তেমনি আমাকেও একটা জায়গা ঠিক করে দে না বাবা। দাদু আমায় টোকা মেরে ফিসফিস করে বললো, কি বুঝলি?.. বোঝার কিছু নেই রে, এটা হবারই ছিল।
এবার তাপস বললো, দেখুন বাবা, লালবাবাকে এর ভেতর জড়াবেন না। ওনার সাথে আমাদের সম্পর্ক ২৫ বছরেরও বেশি। এই যে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ একটু পুন্যের আশায় এত পরিশ্রম করে এত কষ্ট করে আসে এই কঠিন পথে, এত মানুষকে এত বছর ধরে রাতের আশ্রয় আর মুখের খাবার জুগিয়ে চলেছেন বিনা চাহিদায়, এ কী সোজা কথা! অনুদান হিসাবে যে যা দেয় তাই নেন, তার আবার রসিদও দেন। তার ভেতরেই আবার এমন মানুষও দেখেছি আমরা, রাত কাটিয়ে, খাবার খেয়ে সকালে কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে চুপচাপ, অনুদান দেবার ভয়ে। সুতরাং লালবাবার সাথে গুলিয়ে ফেললে তো হবে না। ওই লোকটার কোনও চাহিদা নেই, কোন ভণ্ডামি নেই, কোন ভড়ং নেই। আপনার কথা আমরা শুনলাম। ফিরে গিয়ে চিন্তাভাবনা করে দেখি কি করতে পারি। এখন এই নিয়ে আর কোন কথা হবে না। এই বলে সবাই বাইরে চলে গেলো। দেখলাম, বাঙালিবাবার মুখটা কেমন আস্তে আস্তে কঠিন হয়ে উঠলো। আমি বাইরে যাবার আগে বললাম, বাবা, গুলি দেবে একটা? কোঁচোড় থেকে একটা পুরিয়া বের করে আমার হাতে দিলো।
আমি সোজা এসে তপোবনের প্রান্তরে শিবলিঙ্গের মুখোমুখি মাটিতে থ্যেবড়ে বসে একটা সিগারেটে পুরিয়া বানালাম। দাদু এসে পাশে বসে সিগারেটটা নিয়ে টানতে টানতে বললো.. তোর অনুমানটাই মিলে গেলো তা হলে। প্রথমদিন থেকেই অত খাতির তা হলে এই কারণে। বললাম, ঠিকই আছে রে। ওকে খারাপ বলার আগে নিজেদের কথা ভাব একবার। আমরা সবাই কি প্রথমদিন থেকেই এটা বুঝিনি যে বাবার একটা কোনো ধান্দা আছে বলেই এত খাতির করছে আমাদের? সবাই কমবেশি বুঝেছিলাম। কিন্তু তাও তিনদিন ধরে লাগাতার চোব্যচোষ্য খেলাম তো সবাই! এটা তো বলিনি কেউ যে না বাবা এত আয়োজন করো না। দুপুরে খিচুড়ি আর রাতে ডাল রুটি হলেই হবে আমাদের। তার মানে আমরাও তো সুযোগ নিয়েছি, কি বল?
দুপুরে খেয়ে উঠেছি সবে, এমন সময় বাইরে অনেকগুলো গলার আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে দেখি দশজনের একটা দল খিদিরপুর থেকে এসেছে । মাসিমা পিসিমা পিসেমশাই ছাড়াও দুই ভাইঝি ভাইপো আর ভাইপোর এক বন্ধু আছে দলে। ভালো লাগলো দেখে। আলাপ জমে গেলো পাঁচ মিনিটে। গল্প, আড্ডা, হাসি মজায় কোথা দিয়ে যে সময় কেটে গেলো! সন্ধ্যাবেলায় আন্তাকসারি হলো জোর। অনেক রাত অবধি আড্ডা চললো। একটু কষ্ট করে শুতে হলো কেবল। কোন ব্যাপার নয়। দিব্যি কেটে গেলো রাত।
পরদিন সকাল ঠিক নটায় জলখাবার খেয়ে নিচে নামতে শুরু করার আগে বাঙালিবাবা আর মা কে প্রণাম করার যেন প্রতিযোগিতা হলো একচোট। আমায় বললো, আয়, বলে দুহাত বাড়িয়ে দিলো। আবার একটা বোঁটকা গন্ধওয়ালা আলিঙ্গন পেলাম আমি। তপোবন থেকে গোমুখ অবধি মাসিমা পিসিমাদের হাত ধরে ধরে নামিয়ে আনলাম। হিমবাহের ফাটলগুলো হাঁ হয়ে আছে। দুই ভাইঝিকে হাত ধরে নামানোর উৎসাহ কারুর কারুর একটু বেশিই মনে হলো। গোমুখে প্রায় ঘন্টাব্যাপী ফোটোসেশন চললো। তার মধ্যে ওপর থেকে বিশাল এক বরফের চাঁই ভেঙ্গে পড়লো। সৌভাগক্রমে কারুর কিচ্ছু হয়নি। তারপর নেমে চললাম নীচের দিকে। ভুজবাসায় লালবাবার সঙ্গে দেখা করলাম। তারপর টা টা করে চললাম নীচে নেমে। চীরবাসা থেকেই জোরে বৃষ্টি শুরু হলো, সঙ্গে প্রবল হাওয়া। ঝড়ের গতিতে নেমে এলাম গঙ্গোত্রি। বৃষ্টি বেড়েই চললো। রাতে দারুন খিচুরি বানিয়ে খাওয়ালো মনু।
ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে শুয়ে পড়লাম একটু তাড়াতাড়িই। চোখ বুজে আসছে, কিন্তু ঘুম নেই চোখে। বারবার শুধু বিভিন্ন দৃশ্য ভেসে ভেসে উঠছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। কি মুশকিল বলুন তো। কোন মানে হয়! সবারই কি এমন হয়? কই, ওই তো কেমন নিশিন্তে ঘুমোচ্ছে সবাই। আর আমায় গঙ্গোত্রি রক্তবর্ণ চতুরঙ্গী শিবলিং ভাগীরথী আকাশদীপ অমরগঙ্গা সবাই মিলে হাতছানি দিয়ে ডাকছে কেন যে কে জানে! কি জ্বালা বলুন তো। আরে বাবা, এত লোক তো আছে, নাকি? যা না বাবা, আমায় একটু রেহাই দিয়ে অন্য কাউকে ধর না বাবা। এমন করলে কি আর ঘুম আসে চোখে…
(প্রথম পর্বের লেখাটি হলো : অমৃতধারার সন্ধানে )